নতুন অর্থমন্ত্রীর কাছে পাহাড়সম প্রত্যাশা
৮ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:৫০
নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কেমন হবেন, সেটি এখন বলা খুবই কঠিন। তার অতীতের কিছু রেকর্ড নিয়ে সামান্য বিতর্ক থাকলেও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে কিছু ভালো রেকর্ডও আছে। তবে নতুন মন্ত্রণালয়ে কাজ শুরুর আগেই তাকে নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে ফেলা যায় না।
অর্থ মন্ত্রণালয় এমন একটি মন্ত্রণালয়, যেটির সঙ্গে প্রায় সব মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত। তাই সব নাগরিকের স্বার্থ জড়িত এই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। এ রকম মুহূর্তে একজন নাগরিক হিসেবে অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কী কী আশা করি, সেটি তো বলাই যায়। সে প্রসঙ্গেই নতুন সময়ের প্রত্যাশা তুলে ধরছি।
১। দেশের সবাই জানেন, ব্যাংক খাত ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে আছে। আবুল মাল আবদুল মুহিত এই খাতের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই করতে পারেননি। শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট একসঙ্গে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি দেখিয়েছে। হিসাবের বাইরে থাকা ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। ঘোষিত ঋণখেলাপির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ব্যাংক খাতের ওপর এমন অনাস্থা খুব নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এই ঘটনাগুলো ১০০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, এটা হয়তো সত্যি। পুরো দায় মুহিতের নেই, এটা হয়তো সত্যি। তবে অর্থ খাতের শীর্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি দায় পুরোপুরি অস্বীকার করতেও পারেন না। সম্মিলিত সদিচ্ছায় এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব অনেকটাই।
২। ব্যাংক খাত শুধু অর্থ লোপাট সম্পর্কিত ঝুঁকিতে নেই। প্রতিযোগিতার ঝুঁকিতেও আছে। গবেষক ও ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যাংক থাকায় ভালো ব্যাংকগুলোও গ্রাহক ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যাংকগুলো। অস্থিরতার বাজারে তুলনামূলক উচ্চ সুদের কথা বলে তারা আমানত সংগ্রহ করছে। পরবর্তী সময়ে সেই অর্থ লোপাট করে দিচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৮টি। সরকারি খাতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ৬ টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি ৯টি বিদেশি ব্যাংক দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আরও ব্যাংক খোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত হতে পারে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
দেশে চাহিদা-জোগান হিসাব করে যেকোনো বাজার তৈরি করা উচিত। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক খোলার এই খেলা বন্ধ করে ব্যাংক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করায় মনোযোগী হওয়া উচিত।
৩। রাজস্ব সংগ্রহ নিয়ে বহু উৎসব চলেছে মুহিতের সময়। করমেলার মতো আয়োজনে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীিদের কর দিতে উৎসাহী করা গেছে, এটা ভালো দিক। তবে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের করের বড় অংশ আসে আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে। দ্বিতীয় ধরনের কর দ্রব্য কেনার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদায় হয়ে যায়। ভ্যাটের যেটুকু আদায় হয় না, সেটায় জনগণের থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার দায় বেশি। আর আয়কর আদায় হয় চাকরিজীবী ব্যক্তির অফিসের আয় থেকে। সম্পত্তির করের ব্যাপারে মধ্যবিত্ত এতটা উদাসীন নয়। সবচেয়ে উদাসীন হলেন উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীরা। তাই এত এত মেলা করার পরেও দেশে ট্যাক্স-জিডিপি (মোট জিডিপির কত অংশ কর থেকে আসে) অনুপাত গত দশ বছরে খুব একটা উন্নতি আসেনি। জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউএন এস্কাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, ট্যাক্স গ্যাপ ও জিডিপি’র অনুপাত নামে যে পরিমাপ করা হয়, সেটা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ-৭.৫ শতাংশ।
তাই শক্তিশালী লবিং গ্রুপের দৌরাত্ম্য কমিয়ে অধিক কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নতুন অর্থমন্ত্রী পারবেন তো এই কাজ করতে?
৪। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেশ বিদেশে ভীষণ প্রশংসা পাচ্ছে। একজন শিক্ষানবিস গবেষক হিসেবে অন্যান্য দেশে গিয়েও এই উন্নয়নের প্রশংসা শুনেছি বিদেশি সিনিয়র গবেষকদের মুখে মুখে। এটা এই সরকারের দারুণ একটা সাফল্য। তবে বিতর্ক আছে এই উন্নয়নের অংশীদারিত্বের ভাগ নিয়ে। প্রশ্ন থাকে, দরিদ্র জনগণ কতটুকু এই অংশীদারিত্বের ভাগ পাচ্ছে?
তাই ৭.৫ শতাংশের এই প্রবৃদ্ধির পরের ধাপে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। তা হলো,- উন্নয়নের মান বা কোয়ালিটি অব ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করা।
কোয়ালিটি অব ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করার অর্থ হলো আয় বৈষম্য কমানো, গবেষণালব্ধ ফল অনুযায়ী নগরায়ন, বৃহৎ প্রকল্পে দুর্নীতি হ্রাস করা, দীর্ঘমেয়াদে ফলদায়ী খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, ট্যাক্স ইভেশন বা কর পলায়নপরতা কমানো ইত্যাদির মতো ইস্যু।
দেশের জিডিপির ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর জন্য সরকারের অর্থ জোগানের সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
তাই আগের জনের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রশংসাকেই সর্বোচ্চ জায়গা মনে করবেন না, এটি নতুন অর্থমন্ত্রীর থেকে প্রত্যাশা রইলো। আরও তৃণমূলে পৌঁছাতে হবে উন্নয়নের সুফল।
৫। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। মনে করিয়ে দিতে চাই, শেষবার বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১২.৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১১.৪১ শতাংশে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এই সময়ে সবচেয়ে বেশি। এই স্বর্ণ-সময় একবার চলে গেলে ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয় বহু বছর। শিক্ষাখাতে মোট জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে কোনো দেশ দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে পারে না। একই খাতে পাশের দেশ ভারত বরাদ্দ করে ৩.৭ শতাংশের মতো। দীর্ঘমেয়াদে উন্নতি করা বহু দেশের নজির আছে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করার। উর্বর এই খাতকে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়, শিক্ষার গুণগত খাত ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবেই!
৬। জনগণের ও গবেষকদের সমালোচনাকে আবর্জনা বলে উড়িয়ে না দেওয়ার প্রত্যাশা রইলো তার থেকে। দেশের ঋণাত্মক দিক কমিয়ে আনার কথা বললে কেউ দেশবিরোধী হয়ে যায় না, এটি বোঝা জরুরি।
পরিকল্পনা কমিশনে আমলা ও বিভিন্ন গবেষক উভয় শ্রেণির সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করেছেন বলে আশা করবো, নতুন অর্থমন্ত্রী অর্থ খাতে আমলা ও গবেষকদের অবদান রাখার সুযোগের কিছুটা ব্যালেন্স আনবেন। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা বুঝবেন।
৭। স্বাস্থ্যখাতে কিছুটা বরাদ্দ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখা গেছে আগে। টাকার পরিমাণে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও বাজেটের মোট পরিমাণের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের (২০১৭-১৮) বাজেট প্রস্তাবনায় এ হার ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ।
মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেশের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফসল। জনস্বাস্থ্য জরিপের (অপ্রকাশিত) রিপোর্ট অনুযায়ী এ সাফল্যেও ছেদ পড়েছে। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে।
৮। দেশের মোট রফতানি আয়ের শতকরা ৮২ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। আয়ের মোট পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে চীন এই বাজার থেকে আস্তে আস্তে সরে আসার পরিকল্পনা নেওয়ায়। নিঃসন্দেহে এটি ভালো সুযোগ। তবে চিন্তা করতে হবে যে, চীন কেন এই খাত থেকে সরে আসছে। সামনের দিনগুলোতে শ্রমিক ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই খাতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা চীনের পক্ষে কঠিন হবে। বাংলাদেশে শ্রমিকব্যয় সীমিত হওয়ায় পোশাক মূল্য এখনো সস্তা। তবে অচিরেই এই ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই।
তাই শিল্পখাতে ও রফতানিমুখী পণ্যে বৈচিত্র্য আনার জোরালো পদক্ষেপের প্রত্যাশায় থাকব। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হতে পারে সেই প্রত্যাশার আশ্রয়স্থল। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন অন্যান্য পণ্যে বিনিয়োগ করেন এবং দেশেই যেন সে সব শিল্পে দক্ষ লোক তৈরির রাস্তা তৈরি হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। গার্মেন্টস শিল্পের উদ্যোগে এত পারদর্শী হওয়ার পরেও উচ্চপদগুলোতে যোগ্য লোক তৈরি করতে হিমশিম খেতে হয়। এখনো যৌক্তিক কারণে বিদেশি নির্ভরতা রয়েছে আমাদের, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
৯। সামাজিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশ জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় করে। অন্যদিকে পাকিস্তান ব্যয় করে মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। এতে আনন্দে আহ্লাদিত হওয়া যাবে না। পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রকে বিবেচনা করে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সামনে থাকা রাষ্ট্রের দিকে নজর দিতে হবে। শ্রীলঙ্কা এই খাতে ২.৩ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করেছে। নতুন সুরক্ষা হিসেবে প্রাথমিকভাবে সীমিত পর্যায়ে বেকার ভাতা ও সর্বজনীন পেনশন স্কিমের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যা অসম্ভব কিছু নয়! তবে কত হারে অর্থ দেওয়া উচিত, কোন অঞ্চলকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, সেসব নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে গবেষণা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেসব সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপ সামলে অর্থমন্ত্রী নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আশা করছি।
লেখক: নাহিয়ান বিন খালেদ, গবেষক, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত