ভূমিধস বিজয়ের পর চাই চেতনার রিটেইনিং ওয়াল
১১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৫৯
।। কামাল হোসেন মিঠু ।।
হে আমার জন্মভূমি, তোমাকে অভিনন্দন। জয়বাংলার অনুভবে ঋদ্ধ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সব বাঙালিকে অভিনন্দন। বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় বেড়ে ওঠা কন্যাটি আজ জননী বাংলাদেশ, যার ছায়ায় বড় নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ জন্মভূমি। তাকে জানাই বিজয়ী অভিবাদন।
শিল্পিত নৈপুণ্যে নীলিমায় উড়ছে আমার লাল-সবুজের বিশ্বাস। সগৌরবে এ পৃথিবীকে জানাই, আমরা জিতে গেছি। প্রাপ্তির আনন্দে ভেসে যেতে যেতে বলি, আমরাই বিজয়ী। সুনিশ্চিত সুখের আবেশে কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি— পৃথিবী তাকাও, মৃত্তিকা বনাম মীরজাফরের যুদ্ধে জিতে গেছে মৃত্তিকা। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকারের যুদ্ধে জিতে গেছে একাত্তর। নৈতিকতা ও স্খলনের যুদ্ধে জিতে গেছে মূল্যবোধ। মৌলবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধে জিতে গেছে বাঙালি।
এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য। এ সাফল্যে যারপরনাই আনন্দিত ও সুখী হয় হৃদয়। সেই সঙ্গে আকাশ ছুঁতে চায় প্রত্যাশার পারদ। আর তা হবেই বা না কেন! ঝড়ের রাতে আর তো কোনো নিরাপদ আশ্রয় পাইনি কোনোদিন! বন্ধুর পথে পরম মমতা নিয়ে আর তো কেউ হাত বাড়ায়নি। তাঁতানো রোদে আর তো কেউই বলেনি— ক্লান্ত পথিক, ঘরের ছায়ায় ব’সো, দু’দণ্ড জিরিয়ে নাও। আমাদের সকল সময়ে সকল অবস্থায় ওই একটিই আশ্রয়। ওই একটিই সাহস। যার ফলে আস্থা ও নির্ভরতার অগ্নিপরীক্ষায় রাবণের সংহারের মধ্যে দিয়ে সসম্মানে জয়ী হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু ওই যে বললাম, সাফল্য বাড়ায় প্রত্যাশা! ৩০ ডিসেম্বরের অবিস্মরণীয় বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং দল ও দেশের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি প্রত্যাশাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এই ভূমিধস বিজয়ের পর এবার চাই একটি রিটেইনিং ওয়াল, যে রিটেইনিং ওয়াল গড়ে উঠুক দুর্নীতির বিরুদ্ধে; যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা ও পক্ষপাতিত্ব নামক হাতুড়ির আঘাতে সততার সুড়কি খসে না পড়ে।
শুধু দুর্নীতি নয়, এই রিটেইনিং ওয়াল গড়ে উঠুক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার ও জামায়াত-শিবিরের বিপক্ষেও। মনে রাখতে হবে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পরিধি ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে এরা বসতি গেড়েছে। জামায়াত ও এদের মদতদাতাদের টাকায় শক্তিশালী হয়ে উঠছে এই নেটওয়ার্ক। আধুনিক বেশ ও চৌকস কথার ক্যামোফ্ল্যাজে এরা মিশে যাচ্ছে সবার মধ্যে। শুধু মিশেই যাচ্ছে না, লোকপ্রিয়তাও অর্জন করছে। বুদ্ধিজীবি, কবি, লেখক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, সাাংবাদিক, সম্পাদকের মুখোশে এদের পদচারণায় মুখর হচ্ছে আমাদের আঙিনা। এভাবেই সুযোগ বুঝে তছনছ করে দিচ্ছে গৃহস্থের সুখের ঘর। সহজ-সরল ধর্মভীরু মানুষগুলোকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এদের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান টার্গেট মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম। মেধার স্খলন, ইতিহাস বিকৃতি, দুর্বল পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দখল নেওয়া হচ্ছে প্রজন্মের চোখ, কান, মুখ ও মগজ। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ব্রেন ওয়াশ করে মূল্যবান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলে আসছে সেই পঁচাত্তরের পর থেকেই। সচেতনতার রিটেইনিং ওয়াল যে গড়তেই হবে! তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ওদের সঙ্গে ক্রমাগত ও সরাসরি আলাপচারিতা চালাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম ও সঠিক শিক্ষা দিয়ে গড়া রিটেইনিং ওয়াল দিয়ে যেমন আগলে রাখতে হবে ওদের, তেমনি আড়াল করতে হবে এইসব ভণ্ড জামায়াত-রাজাকার ও তাদের বংশধরের কাছ থেকে। এদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক রিটেইনিং ওয়াল গড়ে উঠুক। গড়ে উঠুক রাষ্ট্রীয় রিটেইনিং ওয়াল। এমন প্রতিরক্ষা বাঁধ গড়ে উঠুক, যা ভেদ করে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জামায়াত-শিবির-রাজাকারের হিংস্র থাবা আমাদের সন্তানদের আঘাত করতে না পারে।
আমি জানি না, আগামী পাঁচ বছরে সাফল্যের পালকে আর কতগুলো অর্জন বা মাইলফলক যুক্ত হবে। আমি জানি না, বাংলাদেশের জিডিপি কত শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। জানি না, মাথাপিছু আয় কত হবে। তবে নিশ্চিত জানি, বাঙালি হিসেবে আমরা বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। আমাদের জাতিসত্ত্বার যে আত্মপরিচয় তা আমরা তুলে ধরতে পারব। আমি জানি, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ যখন গাইব, শুধু গানই গাইব না— আমার বুকে-মুখে-চোখে থাকবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমরা যখন ‘জয়বাংলা’ বলব, তখন সেটা শুধুমাত্র একটি স্লোগান না হয়ে দেশপ্রেমের অনুভব হয়ে মিশে থাকবে আমার অস্থিমজ্জা-ধমনীতে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের এই শিক্ষাই তো দিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে গড়তে সারাজীবন লড়াই করেছেন তিনি। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি মোটা কাপড় আর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পাবে, বঙ্গবন্ধুর বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকবে— এই তো ছিল তার স্বপ্ন ও সাধ। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছর পথ হারাবে না। যে জাতির স্বাধীনতা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত, দু’লাখের অধিক বীরাঙ্গনার আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া, সে জাতি পথ হারায় না। জনকের রক্তে সিক্ত হয়েছে যে দেশের মাটি, সে দেশ পথ হারায় না। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যাদের পাড়ি দিতে হয় পথ, তারা রক্তের ঋণ ভুলে যায় না। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় থেকে পাথুরিয়া— সারাদেশজুড়ে একটাই আওয়াজ উঠুক— আমার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার, জয় বাংলার এই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও তাদের দোসরদের স্থান হবে না, হবে না, হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারেনি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি হারেনি। পথ হারায়নি বাংলাদেশ। ১৯৭১-এ না। ২০১৮-তেও না। শুধু চাই একটি প্রতিরক্ষা বাঁধ। বড় দরকার এই রিটেইনিং ওয়াল। কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া রিটেইনিং ওয়ালই পারবে ভূমিধস বিজয়কে স্থায়ী করতে।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাাদেশি
সারাবাংলা/টিআর