Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুবর্ণচরের আর্তনাদ


১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ২০:২৫

।। শিবলী হাসান ।।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোটের রাতেই নোয়াখালির সুবর্ণচরে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করেই এ গণধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিক অভিযোগে জানানো হয়। দেশের সর্বত্র এ নিয়ে প্রতিবাদ চলমান,  এমনকি দেশের বাইরেও অনেকে রাস্তায় নেমেছেন এ ঘটনার প্রতিবাদে। গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের পক্ষ থেকে আমরাও সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছি। গত ৬ জানুয়ারি যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের পক্ষ থেকে সুবর্ণচর সরেজমিনে পরিদর্শন ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। আমরা মনে করছি, গণমাধ্যমের রিপোর্টে যা পড়েছি বা দেখেছি, বাস্তবের চিত্র সবকিছুকেই হার মানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গণধর্ষণের শিকার চার সন্তানের জননী নোয়াখালির সুবর্ণচর উপজেলার পাংখারবাজার এলাকায় বসবাস করেন। ভূমিহীন সংগঠনের একজন সদস্যই শুধু নন, প্রতিবাদী এক চরিত্রের অধিকারী তিনি। সে কারণে অনেক আগেই রুহুল আমিনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্ষক রুহুল আমিনের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেওয়ায় সেই ভোটকেন্দ্রেই রুহুল আমিন তাকে হুমকি দেয়। ভোটকেন্দ্রের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভূমিহীন সংগঠনের প্রতিবাদী মুখগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার এক হীন উদ্দেশ্যে রুহুল আমিনের সন্ত্রাসী বাহিনী সে রাতেই হামলা চালায় গণধর্ষণের শিকার নারীর বাড়িতে। প্রায় ১৪ জনের একটি দল স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে তার ওপর চালায় অত্যাচার। ধর্ষণের শিকার নারীকে ভয়াবহ কায়দায় পেটানো হয় এবং গণধর্ষণ করা হয়। আসামীদের মধ্য থেকে ৯ জন মিলে ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তারা ওই গৃহবধূর ১৪ বছরের শিশুকন্যাকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু শিশুটি কৌশলে পালিয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ফের ওই নারীর ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর ওই নারীকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। একপর্যায়ে তাকে মৃত ভেবে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। বর্তমানে গণধর্ষণের শিকার নারী জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার পর পরই সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়, যেখানে মূল পরিকল্পনাকারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে বাদ দিয়ে মামলা নথিভুক্ত করা হয়। পরে ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী যখন তোলপাড় শুরু হয়, তখন দ্রুত প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে বাকিদের নামও অন্তভুর্ক্ত করা হয়।

আমাদের তদন্তে যে কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা  উঠে এসেছে, তারা হলো— মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা রুহুল আমীন, প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণচর উপজেলা শাখা; মোশারফ হোসেন, পিতা তোফায়েল; সালাহ উদ্দীন, পিতা আলমগীর ; সোহেল, পিতা ইসমাইল; হেঞ্জু মাঝি, পিতা চাঁন মিয়া; বেছু, পিতা আবুল কাসেম; জসিম, শ্বশুর আনিসুল হক মাঝি; মো. সোহেল, পিতা আবুল কালাম; আবু চৌধুরী; স্বপন, পিতা আবদুল মন্নাছ; আনোয়ার, পিতা ইউছুপ মাঝি; বাদশা, পিতা আহমদ উল্ল্যাহ; হানিফ, পিতা বাগন আলী এবং আমির হোসন, পিতা নুরুল হক।

এরই মধ্যে এই মামলার কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও কয়েকজন এখনও গ্রেফতার হয়নি, যা উদ্বেগজনক। যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও কথা বলেছে এবং উদ্বেগের বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গেই এই মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ক্ষেত্রে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের তৎপরতা ও পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবে আমরা এও লক্ষ্য করেছি, প্রশাসনের একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে রুহুল আমিনের পক্ষে এবং তাকে বাঁচানোর চিন্তা তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট!

রাজনৈতিকভাবে রুহুল আমিনের উত্থান এবং ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে কাদের হাত রয়েছে, তা আমরা একটু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আমাদের গণতদন্তে। আজকের রুহুল আমিন একদিনে হয়নি। বরং দীর্ঘ সময় ও দলীয় সুযোগের কারণেই ধর্ষক রুহুল আমিনের জন্ম। ‘হোটেল বয়’ থেকে কোটিপতি রুহুল আমিন হওয়ার পেছনে রয়েছে দলীয় প্রভাব। স্থানীয়দের উদ্যোগে এক সমাবেশে অংশ নিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ রুহুল আমিনের নির্যাতনের চিত্র। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। রামগতি-চরজব্বার সড়কের পাংখার বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে তার নামে গড়ে তোলা হয়েছে রুহুল আমিন নগর। সেখানে রয়েছে রুহুল আমিনের বিলাসবহুল বাড়ি, আছে একটি ইট ভাটা, দোকানপাটসহ ব্যবসায়িক ঘর। অসংখ্য মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এই রুহুল আমিন। বনদস্যু ও জলদস্যুদের নিয়ে রয়েছে তার ‘রুহুল আমিন বাহিনী’। আর রুহুল আমিনের এসব অপকর্মের শক্তির উৎস স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান  ও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ চৌধুরী। দলীয় আশ্রয়ে থাকায় কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না।

গণধর্ষণের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত রুহুল আমিন সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে মূলত চেয়ারম্যান হানিফের মাধ্যমেই। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে চরজুবলী ইউপি চেয়ারম্যান হানিফের সখ্যের সূত্র ধরেই রুহুল আমিন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্পাদকের দায়িত্ব পায় এবং দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু করে। ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নম্বর চরজুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়। দলীয় ফোরামের বিরোধিতা সত্ত্বেও সুবর্ণচর রুহুল আমিনকে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব দেন হানিফ চৌধুরী। মূলত এই হানিফ চৌধুরীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রুহুল আমিন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয় এবং এলাকায় অপরাধের রাজত্ব কায়েম করে। রুহুল আমিনের সব অপরাধের পাওয়ার হাউজ এই হানিফ চৌধুরী।

সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা মনে করছি, গণধর্ষণের শিকার নারী, তার পরিবার ও মামলার স্বার্থে খুব দ্রুতই বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে—

১. ভিকটিমকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসা এবং ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস’ সেন্টারে স্থানান্তর।

২. গণধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা এখনও সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। তাই দ্রুত ভিকটিম ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৩. মামলার সব আসামিকে গ্রেফতার ও ‘রুহুল আমিন বাহিনী’র সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার করা। অন্যথায় একের পর এক হুমকিতে সমস্যায় পড়তে হবে গণধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার এই পরিবারটিকে এবং মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

৪. স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও দ্রুত সময়ে ৯০ দিনের মধ্যে সুবর্ণচরে সংঘটিত গণধর্ষণের মামলার রায় প্রদান।

৫. সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ধর্ষক রুহুল আমিনের সব অপকর্মের মূল হোতা, চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হানিফ চোধুরীকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার। অন্যাথায় এ মামলায় দলীয় প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছি।

৬. আমরা ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। তবে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড যেন না ঘটে। আমরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেখতে চাই।

আশা রাখছি দল ও সরকার এসব বিষয়ে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

আমাদের দাবি, এই গণধর্ষণের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন হয়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমে যেন ন্যায়বিচার আটকে না পড়ে। মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশ কোনো ধর্ষকের চারণভূমি হতে পারে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত, সেখানে কোনো নারী নিপীড়ক ও ধর্ষকের স্থান হতে পারে না। জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।

লেখক: আহ্বায়ক, যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

গণধর্ষণ শিবলী হাসান সুবর্ণচর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর