ব্যাংক নিয়োগে অব্যবস্থাপনা, সমাধান কী?
১৫ জানুয়ারি ২০১৮ ২১:১৬
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ নিয়ে অনেকদিন ধরে অব্যবস্থাপনা চলছে সেটা অনেকেই কম বেশি জানেন। তবে ১২ জানয়িারি অাট ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সেই অব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত রূপ নেয়। ফলে দুর্ভোগে পড়ে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী। ছেলেমেয়েরা এ নিয়ে দুদিন ধরে অান্দোলনও করছে। এমন পরিস্থিতিতে কাল মঙ্গলবার সকালে জরুরি সভায় বসবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই বৈঠককে সামনে রেখে অামার কয়েকটি কথা অাছে।
১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত আট ব্যাংকের পরীক্ষায় বিভিন্ন অনিয়ম এবং অবস্থাপনার অভিযোগ তুলে এ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে চাকরিপ্রার্থীরা। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষার্থীদের জন্য আসন বিন্যাস না থাকা, যে যার মতো করে বসে পড়া, বসতে না পেরে কয়েকটি কেন্দ্রে মারামারি, নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শুরু না হওয়া, সময় মত প্রশ্ন হাতে না পাওয়া, মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়া, দেখে দেখে লেখাসহ নানান অভিযোগ তুলেছেন নিয়োগপ্রার্থীরা।
দীর্ঘদিন যেহেতু সাংবাদিকতা করেছি এবং তরুণদের নিয়োগ পরীক্ষার সমস্যাগুলো নিয়েই কাজ করেছি সেই প্রেক্ষিতে অামার কয়েকটি কথা অাছে। শুনেছি কালকের বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন। বাংলাদেশ বাংকের গভর্নর ফজলে কবীরের সভাপতিত্বে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য এবং ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা থাকবেন। অাশা করছি নীতি নির্ধারকরা কথাগুলো ভাববেন।
কোন সমস্যা সমাধান করতে হলে সবার অাগে স্বীকার করতে হয় সমস্যা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় কর্তৃপক্ষ সমস্যাটাই স্বীকার করতে চায় না। ফলে সমস্যা অারও বাড়ে। কালকের বৈঠককে সামনে রেখে সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ অাপনারা সবার অাগে সমস্যাটা স্বীকার করুন।
অাড়াই লাখ ছেলেমেয়ে যখন প্রার্থী সেখানে যে কেন্দ্রগুলোতে সীট প্ল্যান থাকতে হয় এই সাধারণ জিনিষটা কেন বিএসসি বা পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্তাদের মাথায় অাসলো না সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন অামার কাছে। এর ফলে যে ভয়াবহ নৈরাজ্য হলো তার দায় কে নেবে? এছাড়া ১২ তারিখে অাট ব্যাংক নাকি পাঁচ ব্যাংকের পরীক্ষা হবে তা নিয়ে দোটানায় ছিলো পরীক্ষার্থীরা। এই বিষযটিও ঠিকমতো সামাল দিতে পারেনি বিএসসি।
নীতি নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ, সমস্যা সমাধানে ভবিষ্যতের সবগুলোয় পরীক্ষায় অাগেই সীট প্ল্যান করুন। শুধু করলেই হবে না এমনভাবে অাসন ব্যবস্থা করুন যাতে এক বেঞ্চে ছয়জনকে বসতে না হয়। পরীক্ষার পরিবেশ যেন বজায় থাকে। অার তেজগাঁও কলেজসহ যেসব কেন্দ্রে বারবার নানা সমস্যা হয় সেখানে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করুন। অার ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে।
এবার অাসি গুরুত্বপূর্ণ অারেকটি বিষয়ে। ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে বারবার। অগ্রণী ব্যাংকের তো পরীক্ষা বাতিল করতেই হলো। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পরেও স্বীকার না করায় জনতা ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষা অাটকে অাছে অাদালতে। বারবারই কম বেশি এমন ঘটনা ঘটছে। এই সমস্যার সমাধান করুন। প্রশ্রপত্র ফাঁস হলে অস্বীকার না করে সঙ্গে সঙ্গে ওই পরীক্ষা বাতিল করুন।
অারেকটা বিষয়। কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ ওই বিভাগকে দায়িত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের কী দুই থেকে অাড়াই লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নেয়ার মতো সক্ষমতা অাছে? অামার মনে হয় নেই।
তাহলে সমস্যার সমাধান কী প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ বলুন, দুই অাড়াই লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা বলুন এই কাজ করার সক্ষমতা পিএসসি ছাড়া অার কারও নেই। কাজেই অাপনারা পিএসসিকে এই পরীক্ষাগুলো নেয়ার দায়িত্ব দিন।
ব্যাংক নিয়োগে অারেকটি সমস্যা কোটা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, অাদিবাসীসহ নানা কোটায় প্রার্থী পাওয়া যায় না বলে বহু পদ খালি রাখতে হয়। পিএসসি কোটা শিথীল করলেও বিএসসি কোটা শিথিলের বিষয়টা এখনো জানেই না। ফলে বহু পদ শূন্য থাকে। সমস্যার সমাধানে ব্যাংক নিয়োগেও কোটা শিথিলের উদ্যোগ নিন।
অারেকটি বিষয় মেধা যাচাই করতে হলে সবার জন্য একই রকম পরীক্ষার পরিবেশ রাখতে হয়। কিন্তু ১২ তারিখের পরীক্ষায় একেককেন্দ্রে একেকভাবে পরীক্ষা হয়েছে। বহুজন মোবাইল ব্যবহার করেছে। বহু স্থানে পরে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে একজন অারেকজনেরটা দেখে লেখেছে। প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল। অার ২০ হাজার ছেলেমেয়ে তো পরীক্ষাই দিতে পারেনি। তাদের পরীক্ষা হবে ২০ জানুয়ারি। এটা একটা হাস্যকর নিয়ম। একই পদের পরীক্ষা দুই দিন দুই রকম প্রশ্নে হতে পারে না। অার এতো অব্যবস্থাপনার পরেও কী করে কর্তৃপক্ষ বলেন, সুচারুভাবে পরীক্ষা হয়েছে? অামার মনে হয় সুষ্ঠু পরিবেশে সবার নতুন করে এই পরীক্ষা নেওয়া উচিত কিংবা এমন একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে যাওয়া উচিত যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হন।
এবার অাসি বিএসসির সংস্কারে। বর্তমান বিএসসি একটার পর একটা ভুল এবং গোয়ার্তুমি করে যাচ্ছে। তবে একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বিএসসি ব্যর্থ হয়েছে বলে ব্যাংকগুলোর হাতে যেন নিয়োগ না চলে যায়। তাহলে শুরু হবে পুরোনো দুর্নীতি। কাজেই যাই হোক বিএসসির মাধ্যমে হোক। তবে বর্তমান লোক দিয়ে নয়।
অাগেও বলেছি, এখনো বলি আমার খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে বিএসসির এখন যারা নীতি নির্ধারক আছেন তারা সৎ হতে পারেন কিন্ত চরম অপেশাদার এবং গোয়ার। নিজেদের ভুল তারা কখনোই স্বীকার করতে চায় না। তারা বুঝতে চায় না ব্যাংকার হওয়া এক কথা আর নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া আরেক কথা। কাজেই সবার আগে সেখানকার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সংস্কার দরকার। যারা বারবার ব্যর্থ তাদের দায়িত্বে না রেখে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পাশাপাশি যোগ্য লোককে দায়িত্ব দেয়া উচিত।
বিএসসি সংস্কারের পর দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে আদালত, সব ব্যাংক এবং প্রয়োজনে পরীক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানে যেতে হবে। কারণ ব্যাংকগুলোতে তীব্র জনবল সংকট।
২০১৫, ২০১৬ সালের নিয়োগ এখনো হয়নি। ২০১৮-তে হবে কিনা তাও সন্দেহ। অথচ লাখ লাখ সাত হাজার পদের বিপরীতে ২৬ লাখ আবেদন পড়ে আছে। লাখো তরুণের এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে? এভাবে চললে ২০২০ সালেও সব নিয়োগ সম্ভব হবে না। কারণ প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিকসহ নানা ধাপ রয়েছে। কাজেই প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত করা উচিত। একটা প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল দিতে এক সপ্তাহর বেশি সময় নেয়া উচিত নয়। অার পুরোনো পরীক্ষাগুলো দ্রুত নিয়ে ফেলা উচিত।
অান্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাঁদের পাঠানো স্মারকলিপিতে পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া, ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির (বিএসসি) সদস্যসচিবের পদত্যাগ, প্রতিটি কেন্দ্রে আসনবিন্যাস নিশ্চিত করা, বিতর্কিত কেন্দ্র বাদ দেওয়া, বিকল্প কোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়াসহ নয় দফা রয়েছে। অামার মনে হয় নীতি নির্ধারকরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসতে পারেন।
তবে অাগেও বলেছি, এখনো বলি পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে অানা উচিত। প্রতি বছর সব ব্যাংকের সব পদের জন্য একটা পরীক্ষা হতে পারে। ওই পরীক্ষার উত্তীর্ণরা পছন্দ তালিকা অনুযায়ী চাকুরি পেতে পারে যেমন করে একটা বিসিএস দিয়ে নানা ক্যাডারে যায় লোকজন। যায় নন ক্যাডারে। বিএসসিও তাই করতে পারে।
তবে সবকিছুই নির্ভর করবে অান্তরিকতার উপর। একটা চাকুরির জন্য অামাদের তরুণরা কতোটা প্রতীক্ষায় থাকে, কতোটা কষ্ট করে সেটা যদি অামাদের নীতি নির্ধারকরা বুঝতেন তাহলে বারবার প্রহসন করতেন না। অামি সবসময় বলি একটা দেশের তারুণ্য হতাশ হয়ে গেলে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়। কাজেই বিএসসিসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ অামাদের তারুণ্যকে হতাশায় ডোবাবেন না। বরং তাদের অাশার অালো দেখান। শুভ কামনা সবার জন্য।
সারাবাংলা/এমএম