প্রধানমন্ত্রী ও একজন শিক্ষক
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:১৪
১.
শিক্ষকতা মহান পেশা—কথা বাল্যকাল থেকেই শুনে আসছি। এজন্য সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান! কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকতা ক্ষেত্রবিশেষে পেশা হিসেবে ঠিক অতটা আকর্ষণীয় নয়। এখানে অর্থের ঝনঝনানি নেই, বিলাসী জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর না আছে কোনো ক্ষমতা বা পলিসি মেকিংয়ের সুযোগ। তবে, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখানে পেশাগত সন্তুষ্টির অনেক উপাদান রয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার শ্রেণিকক্ষ আমার মন্দির। আমার ছাত্ররা আমার কাছে সেই মন্দিরের উপাসকমণ্ডলী। একটি সুন্দর ক্লাস আমার মধ্যে যে সুখানুভূতির জন্ম দেয়, সেটি কখনোই কোনো আর্থিক প্রেষণার অঙ্কে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। শত হতাশা, দুশ্চিন্তা বা শারীরিক অবসাদও নিমিষে উধাও হয়ে যায়, যখন আমি পাঠদানে মগ্ন থাকি। এই যে নতুন সৃষ্টি ও নতুন কিছুর সঙ্গে আমার শিক্ষার্থীর পরিচয়, তাদের মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিক গঠনে যৎসামান্য ভূমিকা রাখতে পারা, এটা আমার ভেতর অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। যা অন্য কোনো পেশায় হয়তো সম্ভব না।
২.
এই দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বলে আমি মনে করি। আমি যখন এ লেখা লিখছি, তখন দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা তাদের দাবি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত। কিন্তু সেই বিবাদের খেসারত দিতে হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না কয়েকমাস ধরে। একই অবস্থা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ছাত্রনেতা ও শিক্ষক সমিতি মুখোমুখি অবস্থানে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও অস্থিরতা ও স্থবিরতা কাজ করছে।
সম্প্রতি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে প্রথম হওয়া একজন ছাত্র আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বিভাগীয় শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে। বিগত বছরগুলোয় আমরা ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের হাতাহাতি পর্যন্ত হতে দেখেছি। শুধু কি প্রত্যক্ষ বিরোধ! পরোক্ষভাবে ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতিও কিছুটা ক্ষুব্ধ। নামে-বেনামে সান্ধ্য কোর্স খুলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষার চেয়ে সেখানে অত্যধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা। চিকিৎসকদের মতো শিক্ষকরাও এখন প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে জড়িয়ে গেছেন। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মফস্বলের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগীয় শহরে বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ইভেনিং প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। তাদের একটি চটকদার বিজ্ঞাপনের লিফলেট আমার হাতেও এসেছে। এছাড়া গ্রেডিংয়ে পক্ষপাতিত্ব , অতিমাত্রায় দলাদলি ও রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারণও রয়েছে সেখানে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই শিক্ষক বা এই ধরনের ছাত্রদের সংখ্যা তো হাতেগোনা! হ্যাঁ, সেখানেই আমাদের স্বস্তি। কিন্তু ঘটনাগুলো যতই বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হোক, এগুলো আসলে পুরো একাডেমিক পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। মানি বা না মানি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একটি বন্ধন থেকে ভিন্নমেরুর দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
৩.
পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দু’টি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত লাল-গালিচায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান হেঁটে যাচ্ছেন। আর তার চাদর ঠিক করে দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এটি শিক্ষকভক্তির এক অনুপম নমুনা। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শুধু তার শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেননি, বর্তমানের ক্ষয়িষ্ণু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের প্রতি অত্যন্ত ইতিবাচক ও একটা শক্তিশালী বার্তাও দিয়েছেন। বিষয়টি থেকে তরুণ প্রজন্মের শেখার অনেক সুযোগ যেমন রয়েছে।
আর শিক্ষকদেরও উচিত হবে বাণিজ্যিক ও অনৈতিক ফায়দা লাভের চিন্তা বাদ দেওয়া। একইসঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি শিক্ষকের জন্য শ্রদ্ধাবোধ তৈরি না হয়, তার দায় কিন্তু শিক্ষকের ওপর কিছুটা হলেও বর্তায়।
লেখক: মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ মিলন, প্রভাষক, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।