শুধু ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষাপ্রেমের মাস!
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:৫৬
ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা-শহিদদের মাস। ত্যাগ আর গৌরবের মাস। ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা নিয়ে নানা আলোচনা, নানা মত, নানা বির্তক এমনকী বাংলা ভাষা ব্যবহারে আমাদের যত অসংগতি এসব তুলে ধরার জন্য প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো যেন অস্থির হয়ে পড়ে। আর অন্যদিকে টিভি-বেতার চ্যানেলগুলো প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে ভাষার লড়াই থেকে শুরু করে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আধিপত্য থেকে রক্ষা করে বাংলা ভাষার প্রাণভোমরা উদ্ধারের প্রতিযোগিতায় যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কী আশ্চর্য!
যারা ইংরেজি ভাষায় লেখা নামফলকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি করছেন; তাদের নিজেদের নামফলক বা প্রতীক চিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? অথচ গণমাধ্যমে ‘দুঃখিনী বাংলা বর্ণমালা’ নিয়ে দারুণ একটা প্রতিবেদন প্রচার করেছে্। সত্যি বিচিত্র এই দেশ! এই তো দুই-তিন বছর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে একটি পত্রিকায় নদীর মতো ভাষাদূষণের সংবাদ পড়ে আদালত বাংলা ভাষাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে কমিটি পর্যন্ত গঠন করে দিয়েছেন। এরপর আর কোনো সংবাদ জানি না, আমরা।
কমিটি কী কী সুপারিশ তৈরি করলো, কিংবা ভাষাদূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে? এমনকী যে আদালত বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা নিজেদের দায়িত্ব মনে করে, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ আদেশ দিয়েছেন সেই আদালতেই প্রতিদিন বাংলা ভাষা ও বর্ণমালাকে দুয়োরানি হয়ে থাকতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন করতে পারিনি। এটা যে অসম্ভব নয় তার প্রমাণ তো একযুগ আগে বিচারপতি এবাদুর রহমান দেখিয়েছেন।
২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুদ্ধ বাংলার প্রয়োগ সম্প্রসারিত করতে—মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসায় কমিটি গঠন ও বৈঠক করেছেন, কিন্তু এরপর অর্ধযুগ পার হলেও কোনো অগ্রগতি আমাদের জানা নেই। এখন তো ফেব্রুয়ারি। কিছু একটা নিশ্চয় জানা যাবে! কমিটি কতবার বসেছে কিছু প্রস্তাব বা সুপারিশ তৈরি করেছেন অথবা করেননি তার হিসাব পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে প্রচলন কতটা অগ্রসর হয়েছে সে হিসাব পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—‘আমরা শুরু করি কিন্তু শেষ করি না’। না ব্যক্তি জীবনে না সমাজ জীবনে। তা না হলে ফেব্রুয়ারি এলেই প্রিয় ভাষা প্রিয় বর্ণমালার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশে খালিপায়ে হাঁটা, প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কণ্ঠে সমবেত গান—‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ অথচ বাকি এগারো মাস ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের ফরম উত্তোলনের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, এফএম বেতারের ডিজুস বাংলা আর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে ইংরেজি-হিন্দির প্রতি অদৃশ্য আকর্ষণে।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের ঐতিহ্যময় বাংলায় একসময় বিদেশি ভাষা হাট-বাজারে, শিল্প-কারখানায়, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, বসার ঘরে জায়গা করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু এখন আমাদের মার্কেট, ইন্ডাস্ট্রি, করপোরেট-অফিস, ইউনিভার্সিটি ও ড্রয়িং রুম দখল করে নিয়েছে, বড় ভয়ে আছি শোবার ঘরেও কি ঢুকে পড়বে? হয়তো কারও পড়েছেও এর মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী অনেকেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকান, যখন জানতে পারে আমাদের সন্তানরা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। আমি বা আমার মতো কেউ কেউ হয়তো সে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়াতে চেষ্টা করি—কিন্তু অন্য অনেকেই কী পারছেন?
এইতো মাত্র চার বছর আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বিদেশি ভাষা ত্যাগ করে স্থানীয় ভাষায় রাখার আদেশ জারি করেছে। দুই মাসের মধ্যে পরিবর্তন না করলে আধিভুক্তিকরণ বাতিলসহ শাস্তি দেওয়ার কথাও বলেছে। সেখানে ইস্টার্ন বিদ্যালয় যদি হিমালয় বিদ্যালয় হয়ে যেতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে ১০০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের মাত্র কয়েককটি বাদে সবই ইংরেজি নামে চলছে, (নামগুলো শুনলে মনে হবে, এগুলো ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়) সরকার চাইলে (মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন প্রস্তাব করতে পারে) বাংলা নাম দেওয়া কি অসম্ভব? বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারের কি এতই দৈন্যদশা যে, ১০০টি সুমধুর অর্থপূর্ণ নাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য পাওয়া যাবে না? না কি মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঔপনেবেশিক দাসত্বের দায়ভার বহন করতেই আমরা ভালোবাসি, মাতৃভাষাকে নয়? একুশ শতকের এই বিশ্বে নব্য-বহুজাতিক বণিক সংস্কৃতির চাপে না হয় ইংরেজিপ্রীতি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি নামকরণ প্রবণতা মেনেই নিলাম, কিন্তু সেখানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অর্জিতজ্ঞান আর ডিজুস-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠার মধ্যে আমাদের ছয় ঋতু আর বাংলা ১২ মাস কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে. তা শুধু বিস্ময় নয়, লজ্জার ব্যাপারও।
দেশের নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (তারা নিজেদের ইউনিভার্সিটি বলতে ভালোবাসে) পাঠদানের সুবাদে দেখেছি, শ্রেণিকক্ষের ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২ জন বাংলা ১২ মাসের নাম বলতে পেরেছেন। আর ঋতু কয়টি, এই তথ্যই জানেন না ২৪ জন শিক্ষার্থী। এভাবেই আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি ভালোবাসাহীন এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি। অনাগত দিনে তাদের কাছে আমাদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া একুশে ফেব্রুয়ারি ‘টুয়েনটি ফার্স্ট’ ফেব্রুয়ারিতে রূপান্তরিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পৃথিবীর কোনো জাতিই তার ভাষা-সংস্কৃতিকে পেছনে ঠেলে ফেলে সামনে এগোতে পারে না। এগোনো যায় না। বাংলাভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর আবেগ যে কত, তা পৃথিবীর মানুষ দেখে ফেব্রুয়ারি এলে। আমরা দেখি, এগারো মাস অবহেলা আর অভাগা দশা। কুম্ভকর্ণ এগারো মাস ঘুমিয়ে একমাস জেগে থাকে। এই একমাস সে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, বাংলায় লেখা নতুন বইয়ের খোঁজে বই মেলায় ধুলো ওড়ায়, আমার ভায়ের রক্তের অক্ষরে পাওয়া বর্ণমালা নিয়ে অহঙ্কারে বুক ফুলিয়ে চলে, বক্তৃতা বিবৃতিতে শহিদদের আত্মত্যাগ আর মাতৃভাষার গৌরব গাঁথার পাপড়ি ছড়ায়, সেমিনার আলোচনায় বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং শক্তিশালী ভাষা, টিভি-বেতারে প্রতিদিনই—‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ অনুষ্ঠান হয়। একুশ এলেই শহিদ মিনার ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। বাকি এগার মাস আমরা ভুলে থাকি প্রিয় বাংলা ভাষাকে। তাহলে কি ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ভাষাপ্রেমের মাস?
লেখক: সৌরভ সিকদার, গবেষক, অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।