হায় ডাকসু: ব্যক্তিগত ঢোল
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৪:২০
।। সুমন জাহিদ ।।
ডাকসু নামক মায়ার হরিণের লোভে কার কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, জানি না। তবে আমার হয়তো নষ্ট হয়েছে গোটা যৌবন, বিবর্ণ হয়েছে যৌবনের শ্রেষ্ঠতম স্বপ্নগুলো।
জনপ্রিয় হওয়ার লোভে নিজেকে সচেতনভাবে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা আমার আশৈশবের। মফস্বলের চৌহদ্দি পেরিয়ে ১৯৮৯ সালে যখন ঢাকা কলেজে ইন্টারে ভর্তি হলাম, তখন চৌকশ হওয়ার এই কৃত্রিম প্রচেষ্টাগুলো ধীরে ধীরে আমার মধ্যে স্থায়ীভাবে প্রোথিত হওয়া শুরু করল। বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র! আমাকে সব বিষয়ে জানতে হবে— আলপিন টু এলিফ্যান্ট।
আমি উত্তম, তাই নিশ্চিন্তে চলতে হবে অধমের সঙ্গে, সব ধরনের মানুষের যাপিত জীবন ও তাদের মনোজগতটা বুঝতে হবে। একেকটি মানুষের মুখ যেন একেকটি মহাকাব্য। জগত সংসারের তাবৎ অসুন্দরের মাঝে সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই। ধর্ম বা সমাজ বিধিবদ্ধ নীতি-নৈতিকতাকে বিবেকের নিরিখে মুক্তবুদ্ধির যৌক্তিক পাল্লায় মাপি। সকল জীবের মঙ্গল কামনাই শুধু নয়, ভালোবাসা ও গভীর আস্থায় বিশ্বাস রাখি অপরিচিতজনের ওপরও, তা সে যে শ্রেণিরই হোক না কেন। সবার মন জোগাতে গিয়ে উবে গেল আমার রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-ভয়… লক্ষ্য করলাম, এর সঙ্গে অমূল্য একটি সম্পদও হারালাম আমি— ‘না’ বলতে পারা।
কলেজে প্রথম বর্ষেই শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাংবাদিকতা— সব জায়গাতেই আমার দুর্বার পদচারণা। ‘এখনই সময়’ নামে একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিকের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি হলাম। তখন ডাকসু নির্বাচনের দামামা বাজছে। পত্রিকা থেকে আমাকে ডাকসু’র অ্যাসাইনমেন্ট দিলো। কলেজ থেকে প্রতিদিন ৩ টাকা দিয়ে মধুতে যাই। ছাত্রলীগের প্যানেল আলম-কামরুল-মেহেদী পরিষদের মিছিল করি। মিছিল শেষে সংবাদ সংগ্রহ। খুব টান টান উত্তেজনা। ছাত্রদলের সদ্য জেলফেরত রাজনৈতিক আইকন (!) নীরু প্যানেল ঘোষণা করল দুদু-রিপন পরিষদ, আর খালেদা জিয়া প্যানেল দিলো আমান-খোকন-আলম। জাতীয় ছাত্রলীগের প্যানেল বুলবুল-কামাল-চাঁন। সে কী উত্তেজনা!
প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছি। অথচ নিজেই পড়ি ইন্টারে! ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেই এবার, হরেক কিসিমের গ্রুপিং-লবিং, ইকুয়েশন বোঝার চেষ্টা করছি। ছাত্রদলের প্যানেলে নীরু-অভির প্রভাব, শিবিরের ভোট কোন দিকে যাচ্ছে, জাতীয় ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগের কেমন ভোট কাঁটবে? মোটামুটি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারেই বিশাল বোদ্ধা বনে গেলাম।
এলাকার কিছু বড় ভাই বললেন, তোর বাড়ি যেহেতু দক্ষিণে, তাই নাজিম উদ্দিন আলমরে একটু বেশি কাভারেজ দিতে হবে কিন্তু। আলম ভাই বরিশালের, কামরুল ভাই আবার ঢাকা কলেজের সাবেক ভিপি। ওস্তাদ আমীরুল ভাই সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থী। নানা হিসাব-নিকাশ মেলাতে ব্যস্ত, মোহগ্রস্ত আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমারও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
কলেজের অদূর ইতিহাসে আমরা একটা লাকি ব্যাচ। কেননা ‘৯০-এর ছাত্র আন্দোলন এবং দীর্ঘ ১০ বছর পর আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন পেয়েছিলাম। সে নির্বাচনে ছাত্রলীগের ‘পল-অশ্রু-ভুলু’ প্যানেল থেকে আমি একাই জিতেছিলাম বার্ষিকী সম্পাদক হিসেবে। ঢাকা কলেজের কথ্য ইতিহাস নির্মাণ করলাম, একটি সুন্দর বার্ষিকী বের করলাম। শিল্প-সাহিত্য জগতে ছোটখাট কেউকেটা বনে গেলাম। ইন্টারে রেজাল্টও হলো স্বপ্নের চেয়ে ভালো। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে আমি কেবল ঢাকা কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, সেকেন্ড কোনো অপশন নিয়ে চিন্তা করিনি। এবং যেহেতু কামিয়াব হয়েছি, সুতরং আমি আমার সময়ের সেরা চৌকশ ছাত্র। এমন সব ‘ফেক কনফিডেন্স’ ও গগণচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লোক প্রশাসন বিভাগে।
ছাত্ররাজনীতি তখন পেশাদার ছাত্রনেতাদের মুঠোবন্দি। ফুলটাইম রাজনীতি, অফুরন বয়সসীমা, সাবেক/অনিয়মিত ছাত্র, জাতীয় নেতাদের ড্রয়িংরুমে অবাধ যাতায়ত। কয়েক যুগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, আঞ্চলিকতা, ইয়েসম্যান ও মাইম্যান সংস্কৃতির সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি গুণাবলী হচ্ছে ছাত্রনেতা হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। ছাত্রলীগ ‘হা-অ’ থেকে ‘আ-অ’ হলো। নেত্রী তখন অসম সাহসী হয়ে ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিলেন। আমরা কেন্দ্রে পেলাম ‘ম-ই’ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লিজু-পংকজ। বাট উই জাস্ট মিস দ্য ট্রেন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ঘোষণার মাত্র কয়েকদিন পর আমরা ভর্তি হয়েছিলাম। তবুও তেমন আফসোস ছিল না, কেননা সামনে ডাকসু তো আছে!
সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করতে জীবনের উজ্জ্বলতম সময়গুলো বিনিয়োগ করেছিলাম। কত কিছু যে করলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, সে ফিরিস্তি দিতে হলে রিয়েল টাইমেও কুলাবে না! ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে টিএসসিই হয়ে উঠল আমার ঘর-বাড়ি। বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র আমি। কিন্তু উত্তরপাড়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। ’৯২ থেকে ‘৯৬— এই গোটা সময়টাই আমি ভবঘুরে। দিনশেষে কোথায় ঘুমাব জানি না। জামা-কাপড় থাকে জগন্নাথের লন্ড্রিতে। রাত্র হলে সহযোদ্ধা কেউ নিশি যাপনের জন্য নিয়ে যায় তার রুমে। কোনো নিমন্ত্রণ না থাকলে বেহায়ার মতো হাজির হই যেকোনো হলে পরিচিত প্রিয়জনের রুমে। উত্তরপাড়া ও ছাত্রী হলগুলো ছাড়া বুয়েট, মেডিকেলসহ সব হলই যেন আমার হল। মধ্যরাতে অনাহুত আগন্তুক দেখে অনেকের বদনখানি মলিন হতো ঠিকই, কিন্তু সেই মলিন বদন নিখুঁত মালিশ-পালিশে হাস্যোজ্জ্বল করতে আমার সময় লাগত না। ক্যাম্পাস এলাকার প্রায় সব ক্যান্টিন, হোটেল, দোকানে আমার বাকির খাতা!
কলেজ জীবন থেকেই টিএসসিকেন্দ্রিক নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির ব্লেন্ডিং শুরু করলাম। টিএসসি ক্যাফেটরিয়ায় দিনের প্রথমার্ধ্ব যায় মুরগী (ফার্স্ট ইয়ার) ধরতে। একসঙ্গে ৪/৫টি টেবিল জুড়ে দিয়ে মুরগীর অপেক্ষায় বসে থাকতাম। দলবেঁধে ফার্স্ট ইয়ার যেখানে আড্ডা দেয় সেখানেই বিভিন্ন উছিলায় ঢুকে পড়ি। তারপর সগর্বে জ্ঞান দেই— নবীনদের-জয়বাংলার গল্প বলি, বলি বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কথা। এই দেশটা গড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, একাত্তরের টিএসসি, টিএসসি’র গণকবর, শেখ কামাল টিএসসি’র কোন কোনায় বসে মাউথ অর্গান বাঁজাতেন— এরকম ‘পান্ডিত্যপূর্ণ’ নানা কথার ফুলঝুড়িতে নবীনদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি ছাত্রলীগের প্রতি। আর চায়ের বিল মিটানোর জন্য তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষায় থাকতাম বড় ভাইদের। তারা আবার চান্সে মোটিভেশনাল স্পিচ ঝাড়ত ফার্স্ট ইয়ারের প্রতি। ফার্স্ট ইয়ারদের সংযুক্ত করার জন্য কত কত পরিকল্পনা!
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বঞ্চিত শিশুদের (‘টোকাই’ শব্দটা মুখে আসে না) জন্য ‘অর্ক’ নামে একটি স্কুল গড়লাম স্বপন ভাইয়ের সঙ্গে। ফার্স্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে আকৃষ্ট হলো এমনতর মানবিক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। টানা ছয় বছর স্কুলটি চালিয়েছিলাম আমরা। অর্ক’র সাবেক ছাত্ররা সবাই আজ মোটামুটি ছিন্নমূল জীবন থেকে মধ্যবিত্তে উন্নীত করতে পেরেছে তাদের জীবন। চারুবন্ধুদের নিয়ে ‘কালবেলায় কালপুরুষের উত্তরাধিকার’ নামে ৪০ ফুট বাই ১০ ফুট সাইজের বিশাল এক দেয়াল পত্রিকা করলাম ’৯৩-এর স্বাধীনতা দিবসে। এ বছরই ১৫ আগস্ট আমি গ্রেফতার হই মিছিল থেকে। ৪৯ দিন জেল খেটে ‘কারা নির্যাতিত মেধাবী ছাত্র নেতা’র তকমা লাগলো আমার গায়ে। আমার ডিপার্টমেন্ট, স্কুল ও কলেজ বন্ধুরা চাঁদা তুলে দেয়াল লিখন করে, পোস্টার লাগায়, আমাকে জেলগেটে দেখতে আসে, শুকনো খাবার আর বিড়ি-সিগারেটের জোগান দেয়, আর আমি জেলে বসে মহানন্দে উপভোগে ব্যস্ত অন্যজীবন।
কারামুক্ত হয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় সোপার্জিত স্বাধীনতার পাদদেশে এবং পরদিন অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ফুলেল শুভেচ্ছায় সংবর্ধিত হই। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি পুনর্গঠন করলাম, তৈরি হলো স্লোগান ’৭১। ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগের অগণিত নেতাকর্মী গ্রেফতার হলো ঈদের আগে। তাদের মনোবল অটুট রাখতে জুনিয়রদের দিয়ে অনেকগুলো সুন্দর হ্যান্ডমেড ঈদকার্ড তৈরি করে পাঠিয়েছিলাম কারাগারে। কারামুক্ত হয়ে পংকজদা বলেছিলেন, জীবনে এমনতর ব্যতিক্রমী উপহার কোনোদিন কোনো আসামি পায়নি। ছাত্রলীগ যে এতটা মানবিক ও সৃজনশীল সংগঠন, তাই ভেবে না কি অবাক হয়েছিল কারাবন্দি অন্য আসামি ও কয়েদিরা।
এদিকে দীর্ঘতর হয় ক্যাফেটরিয়ার টেবিল। দলে দলে নবীনরা আসে সে টেবিলে। ছাত্রলীগ আমাকে একপ্রকার অলিখিত সুবেদারী দিয়ে দেয় টিএসসি এলাকার। নবীনদের সামনে তখন আমাদের বিশাল ডাইভার্সিফাইড অফা— সরাসরি ছাত্ররাজনীতি করবে না, ওকে, সমস্যা নেই। ছাত্রলীগ করতে হবে না, মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড করো! তাতেও সমস্যা? ডিইউএফএস, ডিইউডিএস, ডিইউটিএস, স্লোগান ’৭১— যেকোনো একটা সংগঠনে যুক্ত হও। চাইলে জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যেকোনো সংগঠনেও যুক্ত হতে পারো! আর যদি রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চায়ও আপত্তি থাকে, পড়ালেখার পাশাপাশি শুধু আড্ডাটাই যদি দিতে চাও, তাতেও সমস্যা নেই— বইমেলায় বিনা পয়সায় স্টল দিয়ে দিচ্ছি, সেই সঙ্গে বাকিতে বইয়ের ব্যবস্থা! শুধু আড্ডা দেবে আর স্টল চালাবে। স্টলের লভ্যাংশ দিয়ে একটা মাস ঝুমেই কেঁটে যাবে তোমাদের। শুধু ডাকসু এলে আমাদের একটু মনে রেখো, আর কোনো চাওয়া নেই। ’৯২ থেকে টানা প্রায় ১০ বছর একুশের বই মেলায় টিএসসির সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষে ভুয়া নাম দিয়ে ল্যাম্পপোস্টওয়ালা স্টলসহ প্রায় অর্ধশত স্টলের মালিকানা আসত হাতে। মেলায় সংগৃহীত সহাস্রাধিক ফাও বই দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসে গড়ে তুললাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পাঠাগার।
শীত এলেই বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা জেগে ওঠে। প্রতি শীতেই কোনো না কোনো প্রজেক্ট আসে মাথায়, মহা উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ি সদলবলে। যত ভেঞ্চার আলোর মুখ দেখে, তারও বেশি ভেঞ্চার ভেস্তে যায় অনভিজ্ঞতায়। তবুও থেমে যাই না, মহানন্দে প্রতীক্ষায় থাকি আগামী শীতের। একুশের বইমেলা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব বা জাতীয় কবিতা উৎসবে অফিশিয়ালি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছি অগণিতবার। নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে বিশাল বিশাল অনুষ্ঠান করি। ফিল্ম সোসাইটি থেকে নানা থিমেটিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (সাইফাই/কমেডি/অস্কার/অ্যানিমেশন/ফুটবল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল)। অর্কের ছাত্র-শিল্পী মানিক লাইব্রেরির সামনের নারিকেল গাছ থেকে পড়ে মরে গেল। ওখানেই ওর স্মরণে করলাম ‘মানিকের জন্য ভালোবাসা; প্রতিষ্ঠানবিহীন শিল্পীদের গান’। শুদ্ধ সঙ্গীত সভা থেকে আয়োজন করলাম অনেকগুলো ক্লাসিক্যাল সন্ধ্যা, অর্কের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মঞ্চ ও টিভিতে কয়েকটি নাটক। শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজন করলাম প্রথম জাতীয় অডিও মেলা, সফল করি নির্মূল কমিটির মুক্তিযুদ্ধ মেলা।
ক্যাম্পাসে আমাদের শুরুর দিকেই জীবনমুখী গানের স্রোতে ভেসে বেড়ায় টিএসসির আড্ডা। প্রথমবার ঢাকায় সুমন চ্যাটুজ্জ্যেকে আনল মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। অঞ্জন দত্তকে আনল নিমা রহমান, নচিকেতাকে আনলো ছাত্রলীগের বরিশাল গ্রুপের সিনিয়ররা। প্রতিটা আয়োজনের ভেন্যু ম্যানেজমেন্ট ও ক্রাউড কন্ট্রোলের ভলেন্টিয়ারি দায়িত্ব চলে আসে কাঁধে। সফলভাবে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে ইতিহাসের সাক্ষী হই দারুণ দলবদ্ধতায়।
স্লোগান ’৭১ থেকে প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর রাতে ক্যাম্পাসের সব সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে আয়োজন শুরু করি ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ অনুষ্ঠান, যা আজও একটি সিগনেচার প্রোগ্রাম। এই স্লোগান ’৭১ সংগঠনটি আমরা গড়ে তুলেছিলাম বন্ধু রফিকজামান রিমুর পৌরহিত্যে, যাকে সবাই বস বলেই ডাকতাম ও মানতাম। বস দম্পতি শুধু ক্যাম্পাসই নয়, হাজার হাজার প্রতিবন্ধী মানুষকে ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল তাদের মনোজগতে, বদলে দিয়েছে তাদের জীবন দর্শন। গতবছর ১২ মার্চ শঙ্খচিলের ডানায় ভর করে নেপালের ত্রিভুবন বিমান বন্দর থেকে অন্যভুবনে পাড়ি জমান অমৃতের সন্তান রিমু-বিপাশা-অনিরুদ্ধ।
’৯০-এর পর আমরা উত্তরপাড়া থেকে বিতারিত হলেও টিএসসি, বইমেলা তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আমরা সফলভাবেই রাজাকারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কয়েকটি সংগঠনে বর্ণচোরা কিছু ‘বিম্পিবাছুর’ ও ‘শিবিরছাগু’ ঘাঁপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। ’৯৬-এর আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই তাদেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করি। ফিল্ম সোসাইটি দেখভাল করি নিজেই। সাংবাদিক সমিতি (ডিইউজেএস) ও ডিবেটিং সোসাইটিকে (ডিইউডিএস) ‘ছাগু-বাছুর’মুক্ত করতে পর্দার আড়াল থেকে সব ধরনের সাপোর্ট দেই। একবার টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় সদ্যখোলা নতুন বিভাগ নৃবিজ্ঞানের নবীন বরণে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক রাজাকার আফসার উদ্দিনকে। মাইক কেড়ে নিয়ে আফসার উদ্দিনকে টিএসসি ছাড়া করতে ২ মিনিট সময় দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পেছন থেকে পালিয়েছিলেন।
হঠাৎ কাগজের মূল্য বাড়ায় ছাত্র ইউনিয়ন কচু পাতায় ‘আমরা কি তবে পাতায় লিখব?’ লিখে মিছিল করল। ছাত্রলীগেরও কিছু করা দরকার। খবর পেলাম, বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রয়কেন্দ্র থেকে দিস্তায় ১ শিট কম কাগজ দেয়, তবুও সাত-সকালে লম্বা লাইন হয় কাগজ কিনতে। রাতে বিশ্বস্ত কিছু সাংবাদিককে খবর দিয়ে সূর্যসেনের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো বীর বিক্রমে কাগজ লুটে নিয়ে বিলিয়ে দিই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আফসার উদ্দিনকে দাবড়ানি ও কাগজ লুট— দু’টোই মিডিয়ায় ব্যপক কাভারেজ পায় ইতিবাচকভাবে। ভিসি এমাজউদ্দিন সারাবছরই আমাদের ফাঁপড়ে থাকেন, আর একটার পর একটা শোকজ জারি করেন আমার নামে। প্রতিবারই আমার বিভাগীয় প্রধান সাদা দলের আসাদ স্যার আমাকে বাঁচিয়ে দেন।
বিকেলের টিএসসি ছিল সংস্কৃতিকর্মীদের দখলে, যার নেতৃস্থানীয় প্রায় সব সংগঠকই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। কিন্তু বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। সাংস্কৃতিক নেতাদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের যোগাযোগটা আমার সময় থেকেই শুরু। আমি ছিলাম কিছুটা ব্রিজিংয়ের ভূমিকায়। কিন্তু একজন ছিলেন এই দুই পাড়ের মানুষের সমান প্রিয়— সব আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু মাহবুবুল হক শাকিল। একবুক অভিমান নিয়ে চিরবাউণ্ডুলে মানুষটা অসময়ে শেষ শয্যা নিলেন সরাইখানায়।
আরেকটা মধুর যন্ত্রণা দিতেন সিনিয়ররা। ছাত্রলীগের কয়েক প্রিয় বড় ভাই, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, প্রবাসী বড় ভাই— তারা টিএসসি আসতেন ‘টাংকি মারতে’। অনেক অপরিচিতজনও এসেছেন প্রিয় কোনো বড় ভাইকে ধরে। সুমন, উ-উ-উই যে মেয়েটাকে দেখছিস, ওকে আমার খুব পছন্দ। একটু পরিচয় করিয়ে দে না! বিশ্বাস কর, শুধু প্রেম নয় ওকেই বিয়ে করতে চাই! যার সঙ্গে তার পরিচয়ই নেই, তাকেই তিনি বিয়ে করবেন এবং তিনি কনফিডেন্ট, আমি চাইলেই নাকি সম্ভব! এই অদ্ভুত প্রেমিকরা সবাই যেহেতু এলিজেবল ব্যাচেলর, তাই খরচ করতেন মুঠো খুলে। ক্যাফেটরিয়ায় আড্ডার টেবিলে আমাদের এক সপ্তাহের বাকি বিল এক ঝটকায় দিয়ে দেন তারা। অসংখ্য ম্যাচমেকিং করতে হয়েছিল আমাকে। যার মধ্যে ক্যাম্পাসের প্রিয় কয়েকটি জুটিও আছে। লালবাগের কাজী অফিসে এখনও মনে হয় বাকির খাতা আছে আমার। আফসোস, তারা অনেকই সুখে নেই, অনেকগুলো সেপারেশনও হয়ে গেছে। যেগুলো এখনও টিকে আছে, তাদের মধ্যে যতবার দাম্পত্য ঝগড়া বাঁধে, ততবার তারা অভিশাপ দেন আমার নামে!
পূণ্যের আশায় ভালো কাজ করিনি যেমন, পাপের ভয়ে খারাপ থেকেও বিরত হইনি কখনও। স্বল্পবুদ্ধির খাটো মানুষ হিসেবে যা করি, সবটুকুই নিজের বিবেকের তাড়নায়। দায়টা শুধুই আমার। এই যে এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলাম, এত শ্রম, এত সময়, এত কষ্ট, এত নির্যাতন সহ্য করলাম, সবই কি শুধু প্রাণের তাগিদে? সবটাই কি আমার অনুরাগ? দিন শেষে তো আমরা সবাই স্বার্থপর, ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশ মেলাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেন এই বৃথা শ্রম? স্বার্থটা তবে কি ছিল? নেতা হওয়া? আমি কি বড় নেতা হতে চেয়েছিলাম কখনও? আমি তো জানতাম, আমি কখনও নেতা হবে না, হতে পারব না। কেননা প্রচলিত অর্থে নেতা হওয়ার প্রথাগত গুণাবলী কিছু্ই ছিল না আমার মধ্যে। তাই আমাকে কেউ নেতা বানাবে না। তবে কেন এত মিছে আয়োজন, কেন এই অসীম বিনিয়োগ? মানুষ মাত্রই স্বার্থপর জানি। অনেক হিসাব-নিকাশের পর বুঝলাম, আট-দশটা মানুষের মতো আমিও কম স্বার্থপর নই। আমার সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে প্রধান স্বার্থটি ছিল নিজেকে জনপ্রিয় করা; সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে নিজেকেই একটু মহান তৈরির প্রচেষ্টা মাত্র। নেতা হতে পারব না, জানতাম। এই চান্সে যদি ডাকসুটা পাই, কোনো না কোনো পদে আমাকে হয়তো প্রার্থী করবে। তখন আমি দেখিয়ে দেবো, কত বিশাল আমার সমর্থন! সেই লোভেই কেটে গেল আমার গোটা ছাত্রজীবন।
ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে আমাদের ব্যাচটাই সময়ের সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যাচ। কেননা লিজু-পংকজের পর বাহাদুর-খোকন তাদের দীর্ঘ সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিই করল না। বাহাদুর-অজয় যখন ছাত্রলীগের দায়িত্বে আসলো, ভেবেছিলাম কপালে এবার ছোটখাট হলেও একটা পদ-পদবী জুটবে। কিন্তু আমার সহযোদ্ধা দুয়েকজন নেতা বানানো বন্ধু অবতারদের কানে কানে বললো, ‘আমি বিবাহিত!’ ছাত্রলীগের নতুন নিয়ম অনুযায়ী বিবাহিত কেউ নেতা হতে পারবে না। সেই ইন্টার লাইফে কলেজ প্রাঙ্গণে পা দেওয়ার অব্যবহিত পরেই আমি একটু কেউকেটা বনে গিয়েছিলাম। তাই নিজের পাহাড় সমান ক্লিনইমেজ গড়তে কোনো মেয়ের পেছনে ‘টাংকি’ মারি নাই কোনোদিন। ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হবে বলে ছোট বোন বলে যাদের ছাত্রলীগের পতাকা তলে এনেছিলাম, তাদের কাউকে নিজের ভালোলাগার কথা বলিনি কখনও। সেই আমাকেই কিনা বিবাহিত বানিয়ে দিলো!
ছাত্রজীবন শেষ করে যখন আমি কর্মজীবনে, বন্ধুরা সবাই ঘর বেঁধে নতুন জীবন শুরু করেছে, আমি তখনও পিছিয়ে। পরিবার মেয়ে দেখে। মেয়েপক্ষও খোঁজ-খবর করে আমার। খুব সহজেই তারা জেনে যায়, বিয়ে করার অপরাধে আমার সংগঠনেই আমাকে পোস্ট দেওয়া হয়নি, এক্কেবারে জেনুইন খবর! আমার বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করতে আমার পরিবারকে প্রায় একযুগ ধরে মেয়ে খুঁজতে হয়েছে!
এক ডাকসু’র মোহে আরও যে কত কী হারিয়েছি! রাজনীতির বিধিবদ্ধ অক্ষরেখায় কোনো স্থানাংক তৈরি করতে পারিনি নিজের। ছাত্রলীগের সাবেক প্রান্তিক কর্মী ছাড়া কীই বা আছে পরিচয় দেওয়ার। খুব বেশি কিছু কি চেয়েছিলাম? এখন আমি একটি অপাপবিদ্ধ প্রজন্মের পরিচয়হীন উত্তরাধিকার মাত্র, যার মাথা ও পেট সমান মোটা! বঞ্চিত-ত্যাগীরা ইদানিং ইঁদুর-কাউয়া তাড়াতে যখন মরিয়া, তখন আমি সুউচ্চ সাবেক নেতাদের দেখে নিজের বামনত্ব মাপার চেষ্টা করি। হতাশায় আমাকে পায়নি কোনোদিন, গভীর আশাবাদ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখি আগের মতো এবং রাজনৈতিক লড়াইটা আজও করে যাই। তবে প্রথাগত তরিকায় নয়, একদমই নিজের মতো করে, নিজস্ব স্টাইলে। শুধু পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাটা আর নেই! জনপ্রিয় হওয়ার লোভে হারাতে চাই না আর কিছু; অজ্ঞানতা বা অযোগ্যতা আর লুকাই না এখন, উলঙ্গের মতো উন্মুক্ত। যতটুকু নিয়ে যেভাবে আছি, সেভাবেই তৃপ্ত থাকতে চাই। অনুরাগের প্রতি অনুরক্ত ও বিশ্বস্ত থাকতে চাই বাকিটা জীবন।
লেখক: সাবেক ছাত্রলীগকর্মী
সারাবাংলা/টিআর