Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাবা-মিম্মির জন্য আর কাঁদে না মেঘ


১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:১১

মাথার ওপর সূর্যের কড়া তাপ, ভ্রু কুঁচকে মুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে সাগর ভাই আর রুনি আপার আদরের সন্তান-মেঘ। সকালে বাবা-মিম্মির জন্য দোয়া আর মোনাজাত করতে আজিমপুরে গিয়েছিল- সেই টুপি তখনো হাতে ধরা। বাবা-মিম্মির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কী বলেছে মেঘ? মেঘ কি কেঁদেছিল? না কাঁদেনি। একটুও কাঁদেনি। এখন আর বাবা-মিম্মির জন্য কাঁদে না সে।

৭ বছর ধরে নিয়মিত যাতায়াতে বাবা-মার কবরে যাওয়া-আসা মেঘের কাছে হয়তো অনেকটায় স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১২ সালে বাবা-মার নৃশংস হত্যার ঘটনার সাক্ষী ছোট্ট মেঘ এখন চারপাশের মানুষ দেখে বিরক্তবোধ করা ভাবলেশহীন শীর্ণ চেহারার  কিশোর।

সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপিার্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) চত্বরে সাগর-রুনির হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদী সমাবেশে মিনিট দশেকের জন্য আসা মেঘ কি এখন শুনতে পারছে তার পাশে মাইক্রোফোনে সাংবাদিকরা  তাদের বক্তব্যে কী বলছেন? না এসব শুনতে চায় না সে। এমন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও মেঘের আপত্তি। সাংবাদিক নেতাদের অনুরোধেই আজ এখানে তাকে এনেছেন তার মামা।

মেঘের মুখোমুখি বসা আমি- একজন মা, একই বয়সী একটি সন্তান আছে আমার। তাই হয়তো খুব জানতে ইচ্ছে করে রুনি আপার কলিজার টুকরা মেঘ’ ‘সাগর ভাইয়ের আদরের মেঘ’ কেমন আছে ?

‘মেঘ’ এর জন্য অ্যাসাইনমেন্টে মাঠে থাকা রুনি আপার উদগ্রীব হয়ে থাকা, ফোনে জানতে চাওয়া- কী খাচ্ছে, কী করছে? সহকর্মী হিসেবে দেখেছি, শুনেছি। এখন কী কেউ মেঘের এতোটা খোঁজ নিতে পারে বা নিতে চায়? এই যে দুপুর ১টা বাজে- সকাল থেকে মেঘ  কিছুই খায়নি!  কী খেতে চায়? কী পছন্দ মেঘের তা হয়তো জানে দুই একজন। মেঘের মামা, দাদি, নানি, ফুপু কিংবা সাগর ভাই-রুনি আপার কাছের কোনো বন্ধু হয়তো জানেন, হয়তো জানে না।

মেঘের বয়স এখন ১২। এই বয়সী একটা ছেলে কেমন স্বভাবের হয়, কেমন আচরণ করে আমি বুঝি। বয়ঃসন্ধির সময় ছেলে-মেয়েকে কীভাবে সামলাতে হয়- সচেতন মা হয়েও মাঝে মধ্যে বিভ্রান্ত হই। যে নওশেরকে রুনি আপা গাইড করতেন, শাসন করতেন- সেই নওশের কী করে সামলাচ্ছে এত বড় দায়িত্ব?

আজ মেঘের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটল। অনেক কিছু বলতে আর জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু প্রতিবারই কান্নায় কণ্ঠ বুঁজে আসছিল। এর আগেও যতবার মেঘকে কাছে পেয়েছি, আবেগ চেপে ধরেছে। ভালো করে কথাও বলতে পারিনি। এবার নিজেকে শক্ত করে জানার বা বোঝার চেষ্টা করলাম কী পছন্দ-অপছন্দ মেঘের। প্রথমে মেঘ খুব সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে বোঝার চেষ্টা করল-আমি আসলেই তার শুভাকাঙ্ক্ষি কি না?

জানতে চাইলাম, বই পড়তে ভালোবাসো? চলো বই মেলায় যাই- মাথা ঝাঁকিয়ে দৃঢ় গলায় সে জানায়- ‘না। আমার বই পড়তে ভালো লাগে না।’

রুনি আপা তুমি থাকলে, সাগর ভাই থাকলে, নিশ্চয় মেঘ বই মেলায় যেতো, তাই না? তোমরা থাকলে মেঘ কত কিছু করত বলো! জানো, মেঘের পাতলা গোঁফ উঠেছে- মায়ের কাছে এটা নিশ্চয় সুখানুভূতি। সেই যে শিশু মেঘকে তুমি রেখে গেছো, তোমাকে কচি গলায় মিম্মি ডাকত, আবদার করত, সে এখন ভাঙা গলার স্বরে খুব দৃঢ়কণ্ঠে সরাসরি কথা বলা এক কিশোর। লম্বায় তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে সেই কবে।

সাগর ভাই জানেন তো, আপনার ছেলে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। শুক্র-শনিবার বাড়ির পাশের ক্লাব মাঠে ক্রিকেট খেলতে যায়। স্কেটিংও জানে কিন্তু ভালোবাসে না। মেঘ খুব ঘুরতে পছন্দ করে। মামার সাথে প্ল্যান করেছে, মাসে একবার ঢাকার বাইরের জেলা আর একদিন ঢাকার ভেতরে ঘুরতে বের হবে। আপনারা থাকলে এই একদিন বেড়ে হয়তো ৭ দিন হতো। ঢাকার বাইরের জেলা না হয়ে হয়তো বিদেশ ভ্রমণ হতো, তাই না?

এই যে মেঘের না পাওয়া- না বলা কষ্ট, ভাবলেশহীনতা, অস্বাভাবিকতা বা অসহায়ত্ব- এর পেছনে দায়ী যে বা যারা তারা আদৌ কোনোদিন সামনে আসবে কি না জানি না।

আমরা সাংবাদিকরা এখন নানা মতে, নানা দলে আর স্বার্থে বিভক্ত। আমাদের বিভক্তি এতো নগ্ন চেহারা নিয়েছে যে, এসব নিয়ে বলতে বা লিখতেও সংকোচ হয়। নিজেদের স্বার্থে- দাবি আদায়ে সব পেশার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। দাবি আদায় করে ঘরেও ফেরে। শুধু আমরাই পারি না নিজেদের দাবি আদায়ে এক হতে।

সাংবাদিকরা কত আন্দোলনের সাক্ষী- কত আন্দোলন সফল হয়, কত বড় ঘটনার পেছনের খবর তুলে আনি। কত বড় বড় অনুসন্ধান করে তাক লাগিয়ে দিই, আমাদের কলমের খোঁচায়, ক্যামেরার ক্লিকে। শুধু পারি না আমাদের মেঘের বাবা-মিম্মির খুনি কারা তা বের করতে। সাত সাতটা বছর চলে যায়, বিভৎস হত্যাকাণ্ডের রহস্যের কূল-কিনারাই জানাতে পারি না, জানতেও পারি না। বছর বছর এক-দুইদিন প্রতিবাদ সমাবেশ বা মানববন্ধন করি, সেখানেও এক কাতারে দাঁড়াতে বা বসতে আসি না। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া শুধু দুইটি পরিবারকে বঞ্চিত করা না- পুরো সাংবাদিক সমাজ লড়াইয়ে হেরে যাওয়া, মাথা নত করা। অবশ্য এখন আমরা মাথা নত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌসী, নিউজ এডিটর, সারাবাংলা.নেট


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর