সানাইয়ের ঝংকার এবং কয়েকটি প্রশ্ন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২২:৫৭
।। ফখরুদ্দিন মেহেদী ।।
ক’দিন ধরেই ‘সানাই’ বেশ বাজছে গণমাধ্যম ও ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে। বলছিলাম, সানাই মাহবুব সুপ্রভার কথা। তরুণ সমাজ তার তীব্র সমালোচনা করছে ইন্টারনেটে তার ‘আপত্তিকর’ ও ‘অপেশাদার’ ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে।
এদিকে, তথাকথিত এসব অপেশাদার ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ানোর অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডেকে পাঠায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ। পরে পুলিশের হেফাজতে নিজের ফেসবুক আইডি দিয়ে লাইভে এসে কৃতকর্মের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।
পুলিশের উপস্থিতিতে (!) লাইভ ভিডিওতে সানাই বলেন, ‘আমার সমালোচিত কনটেন্টগুলো আমি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা কোনো ধরনের আর্থিক লাভের আশায় করিনি। তা সত্ত্বেও আজ সাইবার ক্রাইম ইউনিটে এসে এটা আমার বিশেষভাবে অনুধাবন হয়েছে, এই কনটেন্টগুলো দেখে কোনো একটি শ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অতএব, এটা নিশ্চিতভাবে আমার ভুল ছিল। আমি এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এ দেশের সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে এ দেশের আইন মেনে চলে একজন ভালো শিল্পী হতে চাই। এর আগে আমার ব্যক্তিগত বা যৌথভাবে করা বিব্রতকর ছবি বা ভিডিওর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
কিন্তু আসলেই কি তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন? আমরা ধরে নিচ্ছি, পুলিশের কাউন্সেলিংয়ের ফলে তড়িৎ গতিতে সানাইয়ের বোধোদয় হয়েছে। অথচ এর আগে ‘মজার টিভি’ নামের একটি ভিডিও আলাপে উপস্থাপকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বারবারই বলেছেন, তিনি তার কাজে লজ্জিত নন। বরং তার এই কাজকে তিনি নারী ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে দেখেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, ভিডিওটির উপস্থাপক তাকে যেভাবে প্রশ্নগুলো করেছেন, তার শালীনতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সানাইয়ের উত্তরের চেয়ে উপস্থাপকের কথা বলার ধরন, বডি ল্যাংগুয়েজ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন করার অবকাশ আছে বলেই আমি মনে করি। মজা করার ছলেও কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এভাবে কথা বলার অধিকার কেউ রাখেন কি?
কিন্তু সানাই সাবলীলভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং নিজের বক্তব্যে অটল ছিলেন। এমনকি বুড়ো আঙুল ডাউন করে বলেছেন, যারা তার ফেসবুক আইডি চালাতে দিচ্ছেন না বা বারবার ডিজ্যাবল করে দিচ্ছেন, তারা এসব করে তার কিছুই করতে পারবেন না। তিনি যেখানে যাওয়ার, সেখানে যাবেনই। মজার বিষয় হচ্ছে, যে অভিযোগে সানাইয়ের ডাক পড়েছে পুলিশ বিভাগে, একই কাজে উদ্দীপকের ভূমিকায় থাকা পুরুষ উপস্থাপককেও ডেকে পাঠানো হয়েছে কি না, তা কি কেউ জানেন? কিংবা মদ খাওয়ায় উৎসাহিত করে এবং নারীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেলিব্রেটি বনে যাওয়া পুরুষ ‘সেফুদা’র বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি?
সানাই ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করেছেন এবং তা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ‘শো অফ’ করছেন। অনেকের মতে, তার কনটেন্টের বিষয়বস্তু যা, তা আমাদের মাথাব্যথার কারণ। সমালোচনা থাকলেও বিষয়টি পৃথিবীব্যাপী নন্দিত এবং একইসঙ্গে নিন্দিত; একইসঙ্গে এই বিষয়টি ইন্ডিভিজুয়ালিজমের (ব্যক্তি স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যবাদ) চর্চা হিসেবে বিবেচিত বলেও তার দাবি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগে কেউ যদি ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের মতো নতুন ট্রেন্ড দিয়ে নতুন কোনো বার্তা নিয়ে আসেন এবং সেটাকে নারী অধিকারের অংশ হিসেবে ভাবেন, তার প্রতি কি আমরা শুধু ঘৃণাই প্রকাশ করব? তাকে নিয়ে নেতিবাচক ট্রল বানাব? তাকে আমরা যেভাবে হেনস্থা করছি, সেই অধিকরাই আমাদের কতটুকু আছে? যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য মাধ্যমে আমরা কি তার ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছি না? নাকি শুধু নারী বলেই তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হচ্ছে?
গত কয়েক দশকে আমরা যেভাবে কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজমের শিকার হয়েছি, তার হিসাব কি কষেছি? আমাদের দেশে কেন ভালো মানের কাজ হচ্ছে না, যা আমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি পাওয়া যাবে?
এই সরকারের গত এক দশকে তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মানুষের যোগাযোগের পরিধি বেড়েছে। কিস্তু সে তুলনা আমাদের ডিজিটাল লিটারেসির প্রসার কি আশানুরূপ হয়েছে? সরকারি বা বেসকরারিভাবে নতুন ধারার এই শিক্ষার বিস্তার কি দেশের ডিজিটাল বিপ্লবের সমানুপাতিক? সরকার হাজারেরও বেশি পর্ন সাইট বন্ধ করছে, যা তরুণ সমাজের জন্য মঙ্গলজনক এবং প্রসংশনীয় উদ্যোগ। কিন্তু তার বিপরীতে হতাশ ও বেকার তরুণদের জন্য কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান কিংবা সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা গেছে?
এসব না করে ভিপিএনের যুগে আমরা কি চাইলেই পর্ন দেখা থেকে কাউকে বিরত রাখতে পারব? আমরা কথা বলছি, ফো্র্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন নিয়ে। সেই যুগে ইন্টারনেটকে চাইলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারব? আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজও যৌন শিক্ষার কোনো বিষয় যুক্ত হয়নি। পারিবারিকভাবেও এই শিক্ষা একটি ট্যাবু হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু এখন তো সময় হয়েছে মুখ খোলার। এই হিসাব করলে আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে বঞ্চিত করছি না?
লেখক: মানবাধিকারকর্মী