আগুন, সাংবাদিকতা ও কিছু উপলব্ধি
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:০৮
।। মাহমুদ মেনন ।।
ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ— এই আপ্তবাক্যকে ধারণ করেই প্রতিটি সংবাদকর্মী তার পেশাগত জীবনের পথ চলে। একটি বড় খবর (গুরুত্ব অর্থে কিংবা সংবাদের উপাদান অর্থে) কিংবা ঘটনা সঠিকভাবে কাভার করতে পারা, সেই ঘটনা পাঠক, শ্রোতা কিংবা দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারার মধ্যে এক ধরনের কৃতিত্ব আছে। সেদিক থেকে কোনো ব্যাড নিউজে সংবাদকর্মীরা খুশিই থাকেন। কারণটা খবরের ওই সংজ্ঞাতেই নিহিত— খারাপ খবরই সবচেয়ে ভালো খবর। একটি বড় খবর কে না কাভার করতে বা লিখতে চায়!
তবে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে কোনোভাবেই কোনো সংবাদমাধ্যমই খবরের কমতিতে ভালো খবরের (বড় খবর অর্থে) প্রত্যাশায় কাজ করেনি। ভাষা শহিদ দিবসের প্রাক্কালে তখন সব বার্তা কক্ষই প্রস্তুত। একুশের প্রথম প্রহর সমাগত। সব হাউজের নির্ধারিত সংবাদকর্মীরা শহিদ মিনারের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছেন, বার্তাকক্ষও তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক এমনই সময়ে একটি আগুনের খবর কোনোভাবে বড় খবর হিসেবে গুরুত্ব পায় না। কিন্তু রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা সব আকর্ষণ ছিনিয়ে নিলো এক ভয়াবহ আগুন খেলায়।
খেলা-ই বলতে হবে। আগুন লাগার যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা ছিল পুরোপুরি সিনেম্যাটিক। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার বরাতে অন্তত তিনটি ভার্সন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তার সব ক’টিই সিনেমার দৃশ্যের সমান। গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে তা মাথার ওপর আট-দশ ফুট উঠে আবার মাটিতে পড়ল। তা থেকে ছড়ানো আগুন মাত্র কয়েক সেকেন্ডে ছড়িয়ে পড়ল সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে, সড়ক পাশের ভবনগুলোতে। চারিদিকে দাহ্য পদার্থ, আগুন তো তা পোড়াবেই! তবে ভবনগুলো যে কেমিক্যাল জাতীয় দ্রব্যে ঠাসা ছিল, তা আগুনকে দিয়েছে বাড়তি শক্তি। তাতে প্রথমে একের পর এক বিস্ফোরিত হয়েছে সেসব কেমিক্যালজাত দ্রব্য বা পণ্যের কৌটা। কিন্তু আগুন ওগুলো পুড়িয়ে-ফাটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পুড়িয়েছে মানুষ। বিকট বিকট শব্দে ফুটেছে তাদের মাথার খুলিও। ওদিকে ফায়ার সার্ভিস ছুটে এসেছে ঠিকই। নগরীর অগ্নিনির্বাপণী সব শক্তিই ততক্ষণে চুড়িহাট্টায় ন্যস্ত। কিন্তু আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নিতে সরাসরি পারছে না! কারণ ফায়ারের গাড়ি সরু গলিতে ঢুকছে না। আশপাশে কোনো পানির সোর্সও নেই। এসব মোকাবিলা করেও ফায়ারের কর্মীরা কাজ শুরু করেছেন ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে আগুন বসে থাকেনি, রাসয়নিক আর দাহ্য পদার্থের সুবাদে তা জ্যামিতিক হারে বেড়ে বেড়ে আশেপাশের ছয়টি ভবনকে গ্রাস করে নিয়েছে।
ওপরের কথাগুলোর ছত্রে ছত্রে, শব্দে শব্দে সংবাদের উপাদান। সুতরাং সংবাদমাধ্যমগুলো আগুনের খবর প্রকাশে প্রচারে সবচেয়ে সোচ্চার আগুয়ান। ফলে একুশের প্রথম প্রহর, জাতীয় চেতনা, ভাষার অহংকার, শহীদের স্মরণ— সবকিছুই অপেক্ষাকৃত গৌণ হয়ে আগুনটাই মুখ্য হয়ে উঠল। মুখ্য খবরে স্থান পেয়ে গেল সব সংবাদমাধ্যমে।
আগুন নিয়ে সাংবাদিকতা কিংবা এক কথায় ‘আগুন সাংবাদিকতা’ (আগুন বিষয়ক সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ) এখন একটা বিষয়েই পরিণত হয়েছে। ঢাকার সংবাদকর্মীদের কোন একক বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে? জিজ্ঞাসা করলে তাদের অনেকেই বলবেন— আগুন।
এটা সত্য, আগুন হলে সংবাদের উপাদানের অভাব হয় না। তাই ‘আগুন সাংবাদিকতা’য় এখন বিশেষ দক্ষতাও দেখিয়েছেন ঢাকার সাংবাদিকদেরা। গত দেড় দশকে ঢাকা ও তার আশপাশে অর্ধ ডজনেরও বেশি প্রাণঘাতি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এই সংবাদকর্মীরা তা কাভার করেছেন। তাদের সামনে রয়েছে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বিএসইসি ভবনে আগুনের ঘটনা, যে ভবনে অন্তত তিনটি সংবাদমাধ্যমের অফিস। এখানে সংবাদকর্মীরা নিজেরাই ছিলেন আগুনের শিকার। সে আগুনের দিনেও আগুনের দাপট, ফায়ারকর্মীদের অসহায়ত্ব দেখতে হয়েছে। আর সবচেয়ে অসহায় ছিলেন সংবাদকর্মীরা। কারণ নিজেরাই যে ঘটনার শিকার, তা নিজেদেরই কাভার করতে হয়েছে।
এই সংবাদকর্মীরা দেখেছেন রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির আগুন। সেখানে দুই দিন ধরে পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়েছে শ্রমিক। তাদের মাথার খুলি ফাটার ফটাস ফটাস শব্দ যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে, আর সব যখন পুড়িয়ে শেষ, স্রেফ ইট পাথরের দেয়াল ছাড়া পোড়ানোর জন্য আর কিছুই বাকি থাকল না আগুনের কাছে, তখন উদ্ধার হলো দেহাবশেষের নামে কেবলই কিছু কয়লা কিংবা গলে যাওয়া কালো মাংসের দলা। সে খবরও সংবাদকর্মীরা গুরুত্বের সঙ্গে কাভার করেছেন।
তাদের সামনে এসেছে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের মতো আধুনিক (!) কমপ্লেক্সে আগুনের ঘটনা। যায় নবম-দশম তলায় আগুন স্রেফ পুড়িয়ে গেছে। তাতে প্রাণহানি হয়নি বটে, তবে সম্পদ পুড়েছে। আর ফুটে উঠেছে ফায়ারকর্মীদের অসহায়ত্ব। তাদের কাছে অতটা ওপরে উঠে আগুন নেভানোর মতো ল্যাডার ছিল না, ছিল না অন্য কোনো ব্যবস্থাও। সুতরাং ফ্লোরের পুরোটাই পুড়িয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে আগুন।
এসব কোনো আগুনের সঙ্গেই ২০ ফেব্রুয়ারির রাতের আগুনের তুলনা চলে না। তবে এর তুলনা খুঁজতে খুব বেশি দূর যেতেও হবে না। চুড়িহাট্টার অদূরে নিমতলীতেই অতীতে ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা। তুলনা নয়, এই দুই ঘটনায় রয়েছে হুবহু মিল। একই কেমিক্যাল, একই দাহ্য, বিস্ফোরকের সুবিধা নিয়ে, একইভাবে ঘিঞ্জি গলির সুবাদে ফায়ারকর্মীদের ঠেকিয়ে দিয়ে ২০১০ সালের ৩ জুন আগুন তার দাপট দেখিয়ে গোটা এলাকা কয়লা করে দিয়ে গেছে। কয়লা করেছে এখানকার শতাধিক মানুষকে। সেদিনও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আগুনের শক্তি যেমন দেখেছেন, তার খবরও তেমন করে দিয়েছেন।
এবারেও আমরা কিন্তু এখনও অনেক খবর দিচ্ছি। এই যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কেমিক্যালের গুদাম অপাসারণের ঘোষণা এসেছে, এসব কি আগে হয়নি? হয়েছে। আমরা তার খবরও দিয়েছি অনেক। এবারও দিচ্ছি। যখন যিনি যা কিছু বলছেন, সবার কথাই উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের সব গুদাম অপসারণ করা হবে। আদৌ কি হবে? খবর এলো— সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, গাড়ি থেকে সব মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার অপসারণে অভিযান চালানো হবে। আদৌ কি হবে? আর ওই যে তদন্ত কমিটি! তারা কি আদৌ কিছু জানাতে পারবেন? আগুন কোনো দৈব দুর্বিপাক নয়। স্রেফ মনুষ্যসৃষ্ট। আমাদের অগ্নি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি। এসব নিয়েও কি কম কথা হচ্ছে?
আমরা ভরসা পাই না। কারণ নিমতলীতেও আমরা এমন ঘোষণা শুনেছি। তাজরীনে লাশের মিছিলে শোকের আবহে দাঁড়িয়ে একই মন্ত্রীকে কবিতা আওড়াতে শুনেছি।
এসব প্রশ্ন আর উদ্বেগ সামনে রেখেই সংবাদকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে পরের ঘটনার জন্য। আবার কোথায় কখন আগুন হানা দেয়, সে আশঙ্কায়। তবে এজন্য আগুন সাংবাদিকতায় আমাদের আরও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রস্তুত হয়তো থাকবও। কিন্তু দিন শেষে আমরাও মানুষ। আমরা খবর খুঁজি ঠিকই, কিন্তু এমন খবর খুঁজি না যা আমাদের ধ্বংস করে, আমাদের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলে, আর আমাদের ভেতরে ভেতরে কাবু করে ফেলে। আমরা এমন খবর আর চাই না যা লিখতে গেছে আমাদেরও হাত কাঁপে, পরান কাঁদে। এমন খবর তো আমরা পাঠককে দিতে চাই না, যে খবর লিখতে আমরা ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট ও দৈনিক সারাবাংলা (প্রকাশিতব্য)
সারাবাংলা/এমএম
অগ্নিকাণ্ড আগুন চকবাজার চুড়িহাট্টা তাজরীণ নিমতলী পুরান ঢাকা মাহমুদ মেনন