Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লাল-সবুজের পতাকা যেভাবে


১ মার্চ ২০১৯ ২২:৪৬

।। কাজী সালমা সুলতানা ।।

জাতীয় পতাকা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একটি রাষ্ট্রের পরিচয়, একটি দেশের নাগরিকের অহঙ্কার। তাই পতাকা রূপায়নের মাঝে ফুটে ওঠে দেশের সব নাগরিকের পরিচয়, সকল নাগরিকের গর্ব করার উপাদান। জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সব দেশের নাগরিকই সদাসচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশের মতো রক্ত দিয়ে কেনা পতাকার ক্ষেত্রে মর্যাদাবোধের জায়গাটি আরও বেশি স্পর্শকাতর। অথচ এই পতাকা নিয়ে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর নতুন বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। আর পতাকা তৈরির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের নীরবতা ইতিহাস বিকৃত করার পথকে সহজ করে দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পতাকা রূপায়নের ঘটানার আগের কিছু ইতিহাস প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলায় রূপান্তরের প্রশ্নে এক বৈঠকে বসেন। আলোচনায় এ তিন নেতা ঐকমত্যে পৌঁছান এবং ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল চিন্তার কর্মীদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এ সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। ১৯৬৬ সালের মধ্যে সারাদেশে সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হন। ছাত্রলীগের অন্য নেতারা মনে করতেন, বিষয়টি সংগঠনের অভ্যন্তরের উপদলীয় বিষয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সব কর্মকাণ্ড এই তিন নেতার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাদের পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই নিউক্লিয়াস স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার আন্দোলনকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে মুখ্যভূমিকা পালন করেন।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক লীগ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানোর জন্য ১৯৭০ সালের ৭ জুন তারিখ নির্ধারণ করে। ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে, একটি বাহিনী গঠন করে ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেবে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এ বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দিয়ে কাজী আরেফ আহমেদকে। এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় জয়বাংলা বাহিনী। ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আ স ম আব্দুর রবকে। নিউক্লিয়াসের পক্ষ থেকে ব্যাটালিয়ন পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পতাকা বঙ্গবন্ধু ব্যাটালিয়নকে দেবে।
৬ জুন ১৯৭০, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নিউক্লিয়াস সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ ও ডাকসু’র সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ও ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলামকে (মার্শাল মনি) ডেকে নিয়ে পতাকা তৈরি করা জন্য বলেন। তিনি জানান যে এখন এটি ব্যাটালিয়ন পতাকা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পতাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। এ সময়ে মনিরুল ইসলাম ও আ স ম আব্দুর রব একমত হন যে, পতাকার জমিন অবশ্যই গাঢ় সবুজ রঙের (বোতল গ্রিন) হতে হবে। শাহজাহান সিরাজ বলেন যে, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর কাজী আরেফ আহমেদ গাঢ় সবুজের ওপর লাল সূর্যের একটি পতাকার নকশা তৈরি করেন। পতাকার নকশা দেখে সবাই একমত হন।

এসময়ে কাজী আরেফ আহমেদ প্রস্তাব করেন যে, লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র দিতে হবে। না হলে পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে যে নানা অপপ্রচার করে থাকে, এ নিয়েও তাই করবে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে ‘ভারতের হাত আছে’, ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কাজ’ বা ‘ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ বলে অপপ্রচার করতো। এছাড়া এ সময়ে পাকিস্তনিরা বাঙালির আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্ব পাকিস্তান ও মিয়নমারের আরকান রাজ্য নিয়ে একটি কাল্পনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপপ্রচার চালাতো। এ কাজে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রেরও সাহায্য নেওয়া হতো। কাল্পনিক এ রাষ্ট্রের তারা নাম দিয়েছিল ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’। এ ধরনের অপপ্রচার থেকে রক্ষা পেতে পতাকার লাল সূর্যের মাঝখানে সোনালি আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র রাখার কথা বলেন কাজী আরেফ আহমেদ। এ বিষয়ে তারা একমত হন এবং পতাকা নিয়ে আলাপ করতে সিরাজুল আলম খানের কাছে যান। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেরই তিনতলার একটি কক্ষে সিরাজুল আলম খান প্রায়ই থাকতেন। স্বভাবতই স্বাধীনতা কার্যক্রমের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে তার অনুমোদন নিতে গেলেন। পতাকা তৈরিসহ সব কার্যক্রম সম্পর্কে তাকে জানানো হলো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, যে নামেই পতাকা প্রদর্শন করো না কেন, সে পতাকাকে জনগণের ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ভেবে নিতে কোনো বাধা থাকবে না।

ইতোমধ্যে এখানে যোগ দেন ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নজরুল ইসলাম। এরা সবাই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু ও নজরুল ইসলামকে পাঠানো হলো পতাকা সেলাই করে আনতে। ছাত্রলীগ অফিস বলাকা ভবনে এবং এখানে অনেক দর্জির দোকান আছে। তাই তারা নিউমার্কেটে গেলেন। গভীর রাত সব দোকানপাঠ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে অ্যাপেলো নামক দোকান থেকে সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে অন্য এক রঙের দোকানিকে জাগিয়ে সোনালি রঙ ও তুলি কিনে নিয়ে তারা যান বলাকা ভবনে। সেখানে পাক টেইলার্সকে ডেকে তুলে পতাকা সেলাই করা হয়। যে দর্জি এ পতাকা সেলাই করলেন, তিনি ছিলেন অবাঙালি। ওই সময়ে তিনি বুঝতেও পারেননি যে, নতুন এক জাতির, নতুন এক দেশের পতাকা সেলাই করছেন। সেই পতাকাই এত শক্তিধর হবে যে, এর প্রভাবে তাকে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। স্বাধীনতার পর ওই দর্জি পাকিস্তান চলে যান।

পতাকা সেলাইয়ের পর সমস্যা দেখা দেয় লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা নিয়ে। এ জন্য প্রয়োজন হয় একজন শিল্পীর। সে সমস্যার সমাধান হিসেবে ডেকে আনা হয় শিবনারায়ণ দাসকে। শিবনারায়ণ দাস তখন কুমিল্লায় ছাত্ররাজনীতি করতেন এবং তিনিও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তিনি খুব ভালো পোস্টার লিখতে পারতেন এবং রঙ-তুলির কাজ জানতেন। ছাত্রলীগ সলিমুল্লাহ হল শাখার সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার-ফেস্টুন লেখার জন্য তাকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে। তাকে ডেকে আনা হলো সমিমুল্লাহ হল থেকে। শিবনারায়ণ দাস জানালেন তিনি ম্যাপ আঁকতে পারবেন না, তবে রঙ করতে পারবেন। দেখা দিল আরেক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) ৪০৮ নম্বর কক্ষে যান। এ দু’জনই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। জিন্নাহ হলের ৪০৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন এনামুল হক (হাসানুল হক ইনু’র কাজিন)। তার কাছ থেকে এটলাস নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ বের করা হলো। ম্যাপের ওপর ট্রেসিং পেপার বসিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ আঁকা হলো। সেই ম্যাপ নিয়ে তারা ফিরে এলেন ইকবাল হলে। তারপর শিবনারায়ণ দাস নিপুণ হাতে বৃত্তের মাঝে ম্যাপটি আঁকলেন। এর ভেতর দিয়ে শেষ হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নতুন পতাকা তৈরির কাজ। এরপর পতাকা অনুমোদনের জন্য বৈঠক বসে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ অনুমোদন দিলেও চূড়ান্তভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় নিউক্লিয়াস সদস্য ছাত্রনতা আব্দুর রাজ্জাককে। ওই রাতেই আব্দুর রাজ্জাক পতাকাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যান এবং তা অনুমোদন করিয়ে আনেন।

পরদিন অর্থাৎ ৭ জুন সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কর্দমাক্ত মাঠে জয়বাংলা বাহিনী কুচকাওয়াজের সঙ্গে এগিয়ে আসছিল। বাহিনীর পোশাক ছিল সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, মাথায় লাল-সবুজ টুপি এবং হাতে লাল-সবুজ কাপড়ের ব্যান্ডে লেখা ‘জয়বাংলা বাহিনী’। এ সময়ে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ। আ স ম আব্দুর রব মঞ্চের কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পতাকা গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু জনাব কাজী আরেফের হাত থেকে পতাকাটি নিয়ে উপস্থিত জনতাকে দেখান। এরপর আ স ম আব্দুর রবের কাছে হস্তান্তর করেন। পতাকা গ্রহণ করে আ স ম আব্দুর রব কুচকাওয়াজ করে মঞ্চের সামনে দিয়ে চলে যান। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকসু’র তৎকালীন সহ-সভাপতি হিসেবে আ স ম আব্দুর রব লাখো ছাত্র-জনতার সমাবেশ এ পতাকা উত্তোলন করেন। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের পতাকা দিবস। ১৯৭১ সালের এদিন সেনানিবাস ব্যতিত সারাদেশের ঘরে ঘরে লালবৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উড়ানো হয়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ নয়মাস রণাঙ্গনে এ পতাকাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা, বাঙালি জাতির বেঁচে থাকার অবলম্বন।

তথ্যসূত্র:

১. বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র, জনাব কাজী আরেফ আহমেদ, প্রকাশকাল ২০১৪
২. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র, জনাব মনিরুল ইসলাম, প্রকাশকাল ২০১৩
৩.ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদের নিবন্ধ ‘আমাদের জাতীয় পতাকার ইতিহাস’ দৈনিক আমাদের সময়, ৩ ডিসেম্বর ২০০৯
৪. শাহজাহান সিরাজের বক্তব্য, তৃতীয়মাত্রা, চ্যানেল আই, প্রচারকাল ২৩ মার্চ ২০১১
৫. আ স ম আব্দুর রব, বাংলামেইল ২৪, প্রচারকাল ৭ মার্চ ২০১৫

লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, জাসদ ও রাজনৈতিক গবেষক-বিশ্লেষক

কাজী সালমা সুলতানা জাতীয় পতাকা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর