Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগামীর চ্যালেঞ্জে শেখ হাসিনা!


৪ মার্চ ২০১৯ ০৭:০৭

।। শিবলী হাসান ।।

তরুণদের নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন চতুর্থ মেয়াদের মন্ত্রিসভা গঠনের পর থেকেই চারদিকে প্রশ্ন— ‘আগামীর চ্যালেঞ্জ নিতেই কি এত রদবদল মন্ত্রিসভায়?’ কিন্তু বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো কী? আগামী দিনগুলোতে সরকারকে কী কী প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হবে? সেসব প্রতিকূলতা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতিই বা কতটুকু? প্রত্যাশার চাপ নিয়ে কতটা কাজ করতে পারবে সরকার? এরকমও বলা হচ্ছে, এই চ্যালেঞ্জ যতটা না আওয়ামী লীগ সরকারের, তারচেয়েও বেশি শেখ হাসিনার! এই লেখায় সরকার বা সরকার প্রধানের সামনের সেসব চ্যালেঞ্জগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করব।

বিজ্ঞাপন

তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হয়ে আমি প্রথমেই বলব, এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেকারত্ব দূরীকরণ। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় চার কোটির বেশি বেকার রয়েছে। আর এই মোট বেকারের ৪০ শতাংশই শিক্ষিত, প্রতি পাঁচ জন বেকারের মধ্যে দু’জন উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে কেবল সরকারি উদ্যোগ নয়, বরং বেসরকারি উদ্যোগকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়াসহ বেশ ক’টি কারণে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। এর মধ্যে অন্যতম— জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয় নেই। অর্থাৎ যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, একই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ফলে এই প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান তৈরিতে তেমন ভূমিকা রাখছে না। এ ছাড়া সরকারি বিনিয়োগের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আশার কথা, বেকার সমস্যা দূর করতে বেসরকারি কর্মসংস্থানেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে ক্ষুদ্র, হালকা ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সহায়তা সরকার থেকে করা হচ্ছে, যা আশাদায়ক।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, স্বল্প পুঁজি দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া ও একইসঙ্গে স্বল্প পরিসরে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকেই উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাসহ সরকারিভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। আমরা আশা রাখছি, এই মেয়াদে সরকার সহায়তার মাত্রা আরও বাড়াবে। অনেক আগে থেকেই যে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের কথা অনেকেই বলে আসছিল, সে জায়গাতে অনেকটাই অনীহা ছিল সরকারের। তবে এখন কারিগরি সেক্টরেও গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। এছাড়াও বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যেমন— পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতুকে ঘিরে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল, আইসিটি পার্কসহ বেশ কিছু বড় প্রজেক্ট চলমান, যেগুলো থেকে প্রায় কোটির ওপরে বেকারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে যেমন বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে, তেমনি শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে জেলা-উপজেলায়। আমরা আশা রাখছি, এতে বেকারত্বের স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, সুশাসন নিশ্চিত করা। এটিও অন্যতম একটি বড় চ্যালেঞ্জ। টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন যেমন ইতিবাচক, তেমনি এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। সুশাসনের পেছনে চূড়ান্ত ক্ষমতা একটি বড় বাধা। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ফলে অনেক জায়গায় দলের নেতাকর্মীদের লাগামহীন কর্মকাণ্ড সরকারকে বিতর্কের মধ্যে ফেলছে। এসব কাজ সুশাসন নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা। অনেক সময় দলীয় বৃত্তের মধ্যে থেকে অপরাধ সংঘটিত হয় এবং প্রশাসন ও বিচারবিভাগ প্রভাবিত হয় দল দ্বারা। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সুশাসনের একটা অভাব পরিলক্ষিত হয় মূলত আর্থ সামাজিক অবস্থা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের দুর্বলতার কারণে। এই অবস্থা শুধু যে বাংলাদেশে, তা কিন্তু নয়। বরং ভারত-পাকিস্তানেও এই সুশাসনের অভাব প্রকট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইন ও বিচার বিভাগ প্রভাবিত হয় এবং ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এ সরকারের অন্যতম এক প্রধান কাজ হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত।

আমাদের কাছে সুশাসন নিশ্চিতের বড় কিছু নজির তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর আমরা জাতির জনকের হত্যার বিচার পেয়েছি, আমরা বিচার পেয়েছি মানবতাবিরোধী অপরাধের। একসময় এ জাতি কল্পনা করতেও ভয় পেত, সাকা-নিজামীদের বিচার হবে! কিন্তু আজ তা বাস্তব হয়েছে কেবল শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণেই। সে কারণেই তার কাছেই আশা, কষ্টসাধ্য হলেও তিনি সুশাসন নিশ্চিত করবেন সবার আগে। নইলে উন্নয়নের সুফল ঘরে তোলা সম্ভব হবে না।

দেশের আরও একটি বড় সমস্যা মাদক। মাদকাসক্তি ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটিপতির সন্তান থেকে শুরু করে ছা পোষা বাঙালি কৃষকের কিশোর ছেলেটি পর্যন্ত আজ মাদকের ছোবলে নীল। নিষিদ্ধ মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা কেবল মাদক সংক্রান্ত অপরাধই করে না, তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদির মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। দেশে সংঘটিত প্রায় ৭০ শতাংশ অপরাধকর্ম কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত। আর পুলিশের খাতায় রেজিস্ট্রি করা মোট মামলার প্রায় ২০ শতাংশও মাদকের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ সুশাসনের ক্ষেত্রেও চরম বাধা এই মাদক। মূলত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগের সাথে জড়িত সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার ঘাটতি এর পেছনে দায়ী।

পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশে মাদক-সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, নিয়মিত পুলিশ, বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত র‌্যাব এবং সীমান্ত রক্ষা চোরাচালান প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের তৎপরতা এক্ষেত্রে তেমন কোনো ফল বয়ে আনছে না। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও এই ভয়াবহ অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার জায়গা তৈরি করতে হবে। এই অপরাধ দমনে বর্তমানে যে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে, তা দেশব্যাপী অনেক প্রশংসা পেয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে যে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা কাম্য নয়। বরং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে এর বিচার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

চতুর্থত, বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি রোধ করা। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের নাম এসেছে। এই যে সীমাহীন প্রশাসনিক দুর্নীতি, তা রোধ না করতে পারলে উন্নয়নের সুষম বণ্টন সম্ভব না। আর এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও সদিচ্ছা প্রকাশ পায় তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে। গত ১৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বিজয় উদযাপনের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিজয় মঞ্চে চতুর্থ দফার শাসনে কী করতে চান, তার একটি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দৃনীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে তার সরকারের। এরপর থেকেই মূলত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান গতি পেয়েছে। প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে নিঃসন্দেহে সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রত্যাশার বাংলাদেশ দেখতে পাব বলে আশা রাখছি। কিন্তু এই ধারা অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।

গত দশ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের কিছু নজির স্থাপিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি গোটা বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের অভাবনীয় সাফল্য নজর কেড়েছে সবার। শ্রমিক বা কম আয়ের পেশাজীবীদের জীবনমানের উন্নয়নে নেওয়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প, ‘বিনামূল্যে গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পও অন্যতম। তাছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা আড়াই থেকে তিনগুণ বাড়ানো, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো, কৃষিজীবীদের সার, বীজসহ বিভিন্ন উপকরণে ভর্তুকি, ব্যবসায় ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চার লেনের মহাসড়ক ইত্যাদির কারণেও অনেকের আস্থা বেড়েছে সরকারের ওপর। কিন্তু এসবের মধ্যেই আলোচ্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার কোনোভাবে ব্যর্থ হলে তা সব আস্থা ও সাফল্যকে ম্লান করে দেবে।

বর্তমান সময়ের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রশ্নও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একপক্ষ মনে করছেন, দলের ভেতর ও বাইরে অসামান্য কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রী প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই তিনি চাইলেই এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন। কেননা এখন পর্যন্ত দুর্নীতির প্রশ্নে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা বা তার পরিবার বড় কোনো বিতর্কের মধ্যে পড়েনি। অন্যদিকে, বিরোধী দল এখন অত্যন্ত দুর্বল। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ নেই। তাই শেখ হাসিনা চাইলে পারবেন।

অন্যপক্ষের মত, শেখ হাসিনাকে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাকে নির্ভর করতে হবে তার দলের লোকের ওপর, প্রশাসনের ওপর, পুলিশের ওপর। সেখানে তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাহলে এসব বক্তব্যে মানুষ কতটা ভরসা করতে পারবে? কারণ একজন ব্যক্তি যত ভালো নেতাই হোন না কেন, একটি শাসন ব্যবস্থা তো ব্যক্তি-নির্ভর হতে পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্ত না হলে একজন ব্যক্তির পক্ষে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই কাঠামো শেখ হাসিনার পক্ষে নেই।

পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত আছে। এখন এই দুই অংশের মতামতের মধ্য দিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাবেন প্রধানমন্ত্রী, সেটিই দেখার বিষয়। কারণ সবকিছু একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আর সেই চ্যালেঞ্জটাই শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। ব্যক্তি শেখ হাসিনা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হবেন কিনা তা সময় বলে দেবে। তবে অনেক সাহসী সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা নিজেকে প্রমাণ করেছেন বলেই তার ওপর অনেকের আস্থা। পিতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনুপ্রেরণা নিয়ে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে সন্তান কি আমাদের এক উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবেন?

লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার

সারাবাংলা/টিআর

চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর