স্বতন্ত্র ছাত্র রাজনীতির সম্ভাবনা
১৪ মার্চ ২০১৯ ১৩:২৩
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।
স্বতন্ত্র ছাত্র রাজনীতি কি সম্ভব? বড় মুরুব্বি রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে ছাত্ররা কি সংগঠিত হতে পারে? এমন একটা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের পর থেকে। দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ছাত্রলীগের বাইরে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং অনেক বেশি কন্ঠ উচ্চকিত সিপিবি ও অন্যান্য বাম দলের আশীর্বাদপুষ্ট প্রগতিশীল ছাত্র জোটের চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়েছে একেবারে নতুন, আনকোড়া স্বতন্ত্র জোট। সত্যি বলতে কি, ২৮ বছর পর হওয়া এবারের ডাকসু নির্বাচনে এটাই নতুন পাওয়া।
সবাই যখন নানা বিতর্কে লিপ্ত তখন এই স্বতন্ত্র জোট থেকে ডাকসুর ভিপি প্রার্থী অরনী সেমন্তী খানের বক্তব্য ও ব্যাক্তিত্ব এক অভাবিত মাত্রা যোগ করেছে পুরো ঘটনায়। কোন একটি শব্দে যদি এই স্বতন্ত্র জোটের আগমনকে বুঝতে হয়, নিশ্চিতভাবে তা হলো ‘প্রত্যাশা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বার্তা দিয়াছেন যে তারা পরিবর্তনের প্রত্যাশী, তারা দলবাজির ক্রীড়ানক হতে চাননা। স্বতন্ত্র ঝড়ের তীব্রতাতেও ছাত্রলীগের ভোট অপরিবর্তিত থেকেছে, কিন্তু তাতে তাদের সন্তুষ্টির কারণ নেই। কারণ ছাত্রলীগ যাকে সবসময় এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছে সেই ছাত্রদল এই নির্বাচনে প্রায় উবে গিয়েছে। তাই ছাত্রলীগকে এখন নতুন আরেকটি ফ্রন্ট নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রথমেই আসা যাক বিএনপির ছাত্রদলের এই পরিণতি কেন হল? একটা কথা সবাই বলবে, দশ বছরে ধরে হলে থাকতে না পারা, হামলা-মামলায় ছিন্নভিন্ন এই দল গুছিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে অন্য কিছুও সামনে আসে। রাজনীতিতে সাফল্যের প্রথম শর্ত: প্রতিযোগিতার এজেন্ডা স্থির করা। ছাত্রদল তা করতে পারেনি। ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই বার্তা দিতে পারেনি যে, এটা তাদেরই নির্বাচন। নুরুল হোক নুরুই ছাত্রদলের বাইরে গিয়ে হয়ে উঠেছে এন্টি এস্টালিশমেন্ট-এর প্রতীক।
ক্যাম্পাস রাজনীতির একটা চরিত্র আছে। ছাত্র-ছাত্রীদের হল সমস্যা, খাবারের সমস্যা, লাইব্রেরি, পরিবহনসহ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। যে ছেলেটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে অনশন করেছে, তার কোনো দল না থাকলেও তাকে আপন করে নিয়েছে সবাই। ছাত্রদলকে সেরকম একটি সংবেদনশীল সংগঠন মনে করছে না আর ছাত্র-ছাত্রীরা। বরং তাদের কাছে মনে হয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি করে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলও তার থেকে বাইরে নয়। বিএনপি ও ছাত্রদল এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুঝেছে, জাতীয়তাবাদের যে রাজনীতি বিএনপি করে তা দিনদিন অসহিষ্ণুতা ও নির্মম হিংসার জনক হয়ে উঠছে। তারা জানে এদেশে যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল তাই বিএনপির এই জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠছে।
কিন্তু বড় বড় জ্ঞানী যে বাম জোট তারা কেন কোনো প্রভাব রাখতে পারলনা? এই জিজ্ঞাসা সর্বত্র। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, বামেরা নানা ইস্যুতে পরিস্থিতি তাতিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এরা এখন এজেন্ডা স্থির করে না, এরা কেবল জবাব দেয়, প্রতিরোধ করে, কৈফিয়ত খোঁজে। বাম রাজনীতি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে না, সে স্বভাবে পরাশ্রিত।
ক্যাম্পাসে কি ধরণের রাজনীতির চর্চা হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকেই পশ্চিমা দেশের ছাত্র রাজনীতির কথা টেনে আনবেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট রাজনীতি করে। তার কারণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সেসব দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। ছাত্রদের তা থেকে বঞ্চিত করার প্রশ্নই ওঠে না। সমাজের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সক্রিয়তা অনেকটাই বেশি। সেখানেও রীতিমতো ছাত্র আন্দোলন হয়, ছাত্র ধর্মঘটও কখনো কখনো হয়। কিন্তু যা নেই তাহলো সচরাচর ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি প্রবেশ করেনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু প্রবেশ করলেও তার একটা যৌক্তিক প্রেক্ষিত থাকে। কিন্তু সেই রাজনীতি ক্যাম্পাসের বাইরের মুরুব্বীদের সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে ছাত্রদের রাজনৈতিক সমাবেশ বা সংগঠন কিভাবে হবে, সময় হয়েছে তার নিয়ম নির্ধারণ দৃষ্টি দেয়া। সেই নিয়ম নিয়ে নতুন করে ভাবা অবশ্যই জরুরি হয়ে পড়েছে। বড় ভাবনা হল ছাত্র সংগঠনের স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা বজায় রাখা এবং রাজনৈতিক দল আর বহিরাগত নেতাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। আবার যে শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে দলীয় রাজনীতি-মুক্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন, তারা নিজেরা কি দলীয় রাজনীতি মুক্ত? যেখানে শিক্ষক সংগঠন দলীয় রাজনীতির বাইরে নয়, কলেজের পরিচালনা পর্ষদও তার বাইরে নয়, সেখানে যারা ছাত্রদের নির্বাচন পরিচালনা করবেন তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে। ডাকসুতে আমরা তাই দেখেছি। অনেক শিক্ষকই প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে সততার সাথে নির্বাচনটি করতে, কিন্তু অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে যতটা মুখর, শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে কিন্তু ততটাই নীরব। এর ফলে তাদের সমস্ত ভাবনার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক।
স্বতন্ত্র ছাত্র জোট নতুন কিছু সামনে এনেছে। ছাত্র রাজনীতিতে দলীয় প্রভাব কমলে কি ধরণের পরিস্থিতি হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় সবাই। এই রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি আসছে। কিন্তু এর সম্ভাবনা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেনা। ডাকসু নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তা ভাল লক্ষন। বহু বছরের একটা বন্ধ্যা অচলাবস্থা কেটেছে নিশ্চয়। তবে সতর্ক হয়ে আরো গভীরে গিয়ে ভাবা দরকার। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদেরই কাজ হবে তাদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের বুঝতে চেষ্টা করা।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি।
সারাবাংলা/পিএম