ভিয়েনায় এসে জানা সুভাস বসুর কথা
২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:০১
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, প্রতিটা বাঙালি পরিবারেই এমন একজন রোমান্টিক ব্যক্তি’র স্মৃতি থাকে। গল্পটা এমন হয় যে, অমুক বেঁচে থাকলে আজকে আমাদের পরিবারের অবস্থানটাই অন্যরকম হতো। অত্র এলাকায় মানসম্মান অর্থবিত্তে অনেক এগিয়ে থাকতাম ইত্যাদি। এই প্যাটার্নটাই সব জায়গায় দেখা যায়। ক্রীড়াক্ষেত্রে ফুটবলার সাব্বির যদি আরও কিছুদিন খেলতো! ঢালিউডের নায়ক সালমান শাহ্ যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতো! সংগীতের হ্যাপি আকন্দ যদি আরও বাঁচত! রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক স্মৃতিতেও বাঙ্গালী জাতিরও এমন একটি আক্ষেপের নাম আছে। তিনি সুভাস চন্দ্র বসু!
বাঙালির কাছে রোমাঞ্চকর নাম। শৈশব থেকেই এই নামটা শুনলেই মনে হতো ঈশ, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমরা হয়তো এত একঘেয়ে ধীরস্থির এবং চমকহীন জাতি না হয়ে অনেক গর্বিত এবং সাহসী জাতি হতাম।
যাইহোক, বাঙালি ছেলে আমি নিজেও আস্তে ধীরেই সুভাস বসু সম্পর্কে জানলাম পড়লাম।
বাঙালির সন্তান সুভাস চন্দ্র বসু’র জন্ম ২৩শে জানুয়ারি ১৮৯৭ সালে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সুভাস ১৯১৯ সালে আইসিএস পরীক্ষায় চতুর্থ ছিলেন কিন্তু পরে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ১৯২১ সালে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তিনি চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হবার পথচলা আরম্ভ করেন। এর মাঝে তিনি সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন। গ্রেপ্তার হয়ে বার্মায় নির্বাসনে যান। মুক্ত হয়ে ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি হন এবং নেহেরুর সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে তিনি মহাত্মা গান্ধিকেও পেছনে ফেলে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ব্রিটিশদের সাথে আলোচনা করে ভারতীয় উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ ফয়সালার বদলে তার সিদ্ধান্ত ছিল দখলদারদের সাথে কোন আলোচনা না করে তাদেরকে আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশরা তাকে পছন্দ করতো না। পাশাপাশি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের গান্ধিবাদি অহিংস নেতৃত্বও প্রয়োজনে সহিংস হতে ইচ্ছুক সুভাস বসুকে হজম করার মত পাকস্থলী অর্জন করতে পারে নাই। ১৯৩০ সালে সুভাস বসু কলকাতার মেয়র হন। তার কিছু পরেই তিনি বাধ্যতামূলক নির্বাসনে ইয়োরোপে যান। এবং ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ইয়োরোপে, মূলত অস্ট্রিয়ায় ছিলেন।
আজকে লিখতে বসেছি তার ঐ সময়ের কম আলোচিত কিন্তু উল্লেখযোগ্য অধ্যায় নিয়ে।
ভিয়েনায় সুভাস বসু-
সুভাস বসু ভিয়েনায় আসেন প্রথম ১৯৩৪ সালে। নির্বাসনে থাকাকালীন তিনি শারীরিক উন্নতির লক্ষ্যে ভিয়েনায় গেলেও এখানেই তার প্রথম বই “ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল” লেখা শুরুকরেন। তখন বইটির লেখা টাইপ করার জন্য তিনি একজন সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। ড. রমণী মাথুরের মাধ্যমে তিনি পরিচিত হন এমিলি শেঙ্কলের সাথে। এবং এমিলিকে তার সেক্রেটারির কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এমিলি একটি রক্ষণশীল অস্ট্রীয় পরিবারের মেয়ে। চার্চের নান হবার জন্য পারিবারিক চাপ উপেক্ষা করে সেক্রেটারিয়াল পড়াশোনা করেন। যদিও একজন ভারতীয়র সেক্রেটারির কাজ করার ব্যাপারে এমিলির পিতার আপত্তি ছিল। কিন্তু মা- বোনের সাহায্যে এমিলি কাজটি নেন।
১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত সময়টিতে সুভাস বসু এমিলিকে ১৬০টির মত চিঠি লেখেন। বেশিরভাগ চিঠিতেই বিভিন্ন কাজের দিক নির্দেশনা দিয়ে লেখা কিন্তু এসব চিঠিতে প্রায়ই ফুতে উঠেছে এমিলির প্রতি নেতাজীর গভীর অনুরাগ, স্নেহ এবং মাঝে মধ্যে কিঞ্চিত ঈর্ষাকাতরতা। যেমন এমিলিকে দিয়ে তিনি ভারতীয় পত্রিকা দ্যা হিন্দুতে আর্টিকেল লিখিয়েছিলেন। লেখাগুলো নিজে এডিট করে দিয়েছেন এবং এমিলির বোঝার জন্য তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বলকান অঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক বিষয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ লিখেছেন। ঈর্ষা মিশ্রিত কেয়ারিং ফুটে উঠে ৩/৫/১৯৩৬ এর চিঠিতে। যেখানে সুভাস বসু বলছেন, ” ভারতীয়দের পাঠদান করার সিদ্ধান্তটি কেয়ারফুলি ভেবে নিও, কারণ সাধারণত ওরা এমন কাউকে চায় যে ফ্লার্ট করবে এমনকি নাচও শেখাবে। এমন কিছু মহিলা আছে এবং আমি আতংকিত যে ওরা তোমাকেও না অমন একজন ভেবে বসে! ড. সেন তোমার সাথে কেমন আচরণ করছে?” আবার দেখা গেছে যে সুভাস বসু এমিলিকে বকাবকিও করছে কারণ এমিলি তাকে সুটকেস কিনে তাতে শীতের জামা কাপড় ভরে পোস্টে পার্সেল করে দিয়েছে। অর্থের এমন অপ্রয়োজনীয় শ্রাদ্ধ দেখে সুভাস বসু এতে ভীষণ বিরক্ত হন।
এই সময়টিতেই সুভাস বসুর সাথে কাজ করার সময় দুজনের মাঝে হৃদ্যতা তৈরি হয়। ১৯৩৭ সালে তারা বিয়ে করেন। যদিও এই বিবাহের কোন অফিসিয়াল প্রমাণ নেই।
কিন্তু অনেকেই জেনে হয়তো অবাক হবেন যে, শুরুতে নাৎসি জার্মান নেতৃত্ব কিন্তু ব্রিটিশদের সাথে লড়াইয়ের চেয়ে সন্ধি স্থাপনে বেশী আগ্রহী ছিল! হিটলার মনে করতেন জার্মান- ব্রিটিশ আর্য ভাই ভাই। ফলে নাৎসিরা সুভাস বসুকে হাতে রাখলেও তাকে কোন দায়িত্বশীল কাজ দিচ্ছিল না। বেশ লাক্সারিয়াস আথিতেয়তায় উনাকে মোটামুটি বসিয়েই রেখেছিল।
পরিস্থিতি বদলায় ১৯৪১ সালে, যখন ব্রিটিশদের কোনমতেই সন্ধি করতে রাজি করাতে পারলেন না হিটলার তখন সুভাস বসুকে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনায় নিয়োজিত করে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল, উত্তর আফ্রিকায় এরউইন রোমেলের হাতে প্রায় ৪৫০০’র মত ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের যুদ্ধবন্দি করে জার্মানি নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে সুভাস বসু সেখানে যেয়ে প্রায় ৩০০০ ভারতীয় সৈনিকদের পক্ষ বদলে জার্মানদের পক্ষে লড়াইয়ে রাজি করান।
কিন্তু, তখনই বোধহয় সুভাস বসু প্রথম বুঝতে পারে নাৎসিদের সাথে বাঙ্গালীদের চূড়ান্ত পর্যায়ের বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। কারণ, নাৎসিরা সুভাস- এমিলি’র বিবাহের অনুমুতি দেয়নি। তাদের মতে আর্য নারীর সাথে ভারতীয় পুরুষের বিবাহ জার্মান জাতির বিশুদ্ধতা নষ্ট করবে। অন্যদিকে ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজেও তাদের এই সম্পর্ককে খুব একটা ভালভাবে দেখা হবে মনে করার কোন কারণ ছিল না।
ফলে তাদের বিবাহ গোপন থেকে যায়।
২৯শে মে ১৯৪২ সালে সুভাস বসু হিটলারের সাথে দেখা করে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে জার্মানির সাহায্য চায়। ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা রাখতে চায়। কিন্তু তাদের সাক্ষাতে উল্লেখযোগ্য কোন ফলাফল হয় না। সুভাস বসু দিন দিন নাৎসিদের উপর ভরসা হারাচ্ছিলেন এবং জাপানের সাথে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছিলেন। ২৯শে নভেম্বর ১৯৪২ সালে তাদের ঘরে আসে তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান অনিতা। এবং ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে সুভাস বসু জার্মান সাবমেরিনে করে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। সেটাই ছিল নেতাজীর সাথে তাঁর স্ত্রী ও কন্যার শেষ বিদায়।
তাদের ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের মাত্র ৩ বছর একসাথে ছিলেন। এমিলি অবশ্য দীর্ঘদিন সুভাস বসুর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি একাই মেয়েকে বড় করেছেন এবং মায়ের দেখভাল করেছেন। যদিও এমিলি কখনোই ভারতে আসেনি কিন্তু ভারতে সুভাস বসুর পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ ছিল।
তো ঘটনা হচ্ছে আমি ২০১৫ থেকে ভিয়েনায় আছি। আমি দেশপ্রেমিক মানুষ। বাংলা, বাংলাদেশ, বাঙালি, বাঙ্গাল ইত্যাদি কি ওয়ার্ড আমাকে অনুপ্রেরিত করে।
সুভাস বসু ভিয়েনা ছিলেন কিছুদিন। ব্যাপারটা আমাকে বেশ আলোড়িত করে। আমি চেষ্টা করি তিনি কোথায় ছিলেন তা খুঁজে বের করতে। কিন্তু বর্তমান ভিয়েনায় পরিস্থিতি এমন যে, নাৎসি যুগের কথা ভুলতে পারলেই এরা বাঁচে। আমার লোকাল বন্ধুদেরও যে নাৎসিদের একজন ভারতীয় সুহৃদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে বলবো, তাও কিঞ্চিত বিব্রতকর।
তাই আমিই কিছুটা খোঁজাখুঁজি করে এমিলি শেঙ্কলের একটি চিঠি থেকে তার ঠিকানা বের করে এক বন্ধুকে নিয়ে বাসাটা ঘুরে এলাম। যদিও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই বাড়ি ব্যাপক সংস্কার হয়েছে কিন্তু আমরা যখন ঐ এলাকায় হাঁটছিলাম, তখন বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল। কারণ এখানে এই রোডে আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে উপমহাদেশের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা অসীম দেশপ্রেম এবং স্বপ্নভরা বুকের এক কোনে প্রিয়তমার ভাবনা লালন করে হেঁটেছিল। তিনি কি ভাবতে পেরেছিলেন যে একদিন পূর্ববঙ্গ হবে বাংলার একমাত্র পতাকাবাহী রাষ্ট্র এবং সেখানকার কেউ একজন তার পদচিনহ অনুসরণ করবে ভিয়েনার পথে পথে?
প্রিয় সুভাস বসু, আপনি যা চেয়েছিলেন তা অর্জন করতে পারেন নাই, যেভাবে যাদের সাহায্যে আপনি ভারতের তথা বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তাও সমর্থন করা যায় না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আপনার দেশপ্রেম ছিল তীব্র, আপনি চেয়েছিলেন বাংলার মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াক। আপনি চেয়েছিলেন বাংলার মানুষের মন থেকে হীনমন্যতা দুর করতে। তাই আপনার প্রতি নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন নেতাজী।
তথ্যসূত্র –
১- Lebra, Joyce Chapman (2008a) [1977], The Indian National Army and Japan, Singapore: Institute of Southeast Asian Studies, ISBN 978-981-230-806-1, retrieved 10 November 2013
২- Vipul, Singh (1 September 2009), Longman History & Civics Icse 10, Pearson Education India, ISBN 978-81-317-2042-4, retrieved 13 June 2012
৩- http://www.rediff.com/news/slide-show/slide-show-1-netaji-had-romantic-deeply-emotional-side-to-him/20110601.htm
৪- http://www.thehindu.com/2001/03/01/stories/1301078a.htm
৫- https://daily.bhaskar.com/news/NAT-TOP-5-things-you-should-know-about-austrian-wife-of-subhas-chandra-bose-4960064-PHO.html
৬- Letters to Emilie Schenkl, 1934-1942 By Subhas Chandra Bose। https://books.google.ch/books?id=dnRD67VbfuEC&pg=PA3&source=gbs_toc_r&cad=3#v=onepage&q&f=false
৭- http://www.revolutionarydemocracy.org/rdv7n1/Bose.htm