Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশ ১৯৭১: গণহত্যা না জেনোসাইড?


২ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৪০

সম্প্রতি আমার আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়া মেয়েকে নিয়ে রুয়ান্ডা গিয়েছিলাম। মেয়েটি তার পড়ালেখার অংশ হিসেবে ‘ওয়ার্ল্ড উইদাউট জেনোসাইড’ নামক  সংস্থায় ইন্টার্নশিপ করছে।  ভবিষ্যতেও সে জেনোসাইড রোধে কাজ করতে চায়। রুয়ান্ডা ভ্রমণ সেই প্রক্রিয়ার একটি অংশ।  নাজি হলোকাস্টের পরে সাম্প্রতিক পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত জেনোসাইডের একটি ‘রুয়ান্ডা জেনোসাইড’।  ২০০২ সালে আমি যখন ‘পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রেজুল্যুশন’-এর ওপরে একটি ডিপ্লোমা করছিলাম ইউরোপিয়ান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ১৯৯৪ সালে সংঘটিত রুয়ান্ডা আর নব্বইয়ের দশকের বসনিয়া জেনোসাইড পাঠ্য তালিকায় ছিল।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই এই তিনমাসে মধ্যে রুয়ান্ডায প্রায় ১০ লাখ টুটসি সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করে হুতু সম্প্রদায়।  হত্যাকাণ্ডগুলোয় ব্যবহৃত হয়েছিল ম্যাসেটি, চাপাতি ও কিরিচ।  প্রথম দফায় টুটসিদের মধ্যে শিক্ষিতদের মেরে ফেলা হয়, ঠিক যেমনটি পাকিস্তানিরা করেছিল প্ল্যানমাফিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কয়েক লাখ টুটসি মানুষ পাশের দেশ উগান্ডা আর বুরুন্ডিতে শরণার্থী হয়েছিল ঠিক যেমনটি বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।  রুয়ান্ডার অনেক বুদ্ধিজীবী উগান্ডার মানুষ আর সরকারের সহায়তা নিয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন এবং অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে। যেমনটা ১৯৭১ সালে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিকরা করেছিলেন। রুয়ান্ডাতে পৃথিবীর সবথেকে বেশিসংখ্যক পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশু বসবাস যারা জেনোসাইডে বাবা-মাকে হারিয়েছে। কয়েকহাজার টুটসি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, জেনোসাইড পরবর্তী বছরগুলোয় কয়েক হাজার ধর্ষণের শিকার নারী এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেছেন। তাদের ঘরবাড়ি লুট হয়েছে, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। গবাদিপশু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল, সে সব রাস্তার পাশে ঘর-বাড়ি-সেতু ধ্বংস করে গেছে, মানুষকে হত্যা করে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। টুটসিরা বিভিন্ন গির্জা, স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। গির্জার হুতু পাদ্রিরাও তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সব গির্জাঘর বন্ধ করে নারী-শিশুকে কেটে কেটে হত্যা করেছে হুতুরা।  ঠিক যেমনটি অসহায় বাঙালি হত্যায় পিস কমিটির নেতারা সহায়তা করেছিল পাকিস্তানিদের।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সময়ে রুয়ান্ডা সরকার ও জনগণ তাদের দেশে সংঘটিত সবচেয়ে কালো অধ্যায়টিকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংরক্ষণ করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। দেশটির রাজধানী কিগালি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গণকবরগুলো, মাস কিলিং ক্ষেত্র বা বধ্যভূমিগুলো যত্নে রক্ষা করা হয়েছে, যতখানি সম্ভব।  অনেক উন্নত দেশ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। রুয়ান্ডা সফরে গিয়ে জেনোসাইড মিউজিয়াম দেখার পরে আমার মেয়ে জানতে চাইলো, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিকল্পিত, স্ট্রাকচারালি পরিচালিত সশস্ত্র জেনোসাইডটি কেন জাতিসংঘের  স্বীকৃতি পেলো না? কেনই বা তিরিশ লাখ শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আর কেনই বা ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকে বাংলাদেশে গণহত্যা বলা হয়? তার নিজের পাঠ্যতালিকায় বাংলাদেশের জেনোসাইডের কোনো উল্লেখ না থাকাতেও সে ক্ষুব্ধ।  আমাদের ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সে গেছে, আপ্লুত হয়েছে বেদনায়।  দেখেছে সাভার ও বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের গণকবর, রায়ের বাজার বধ্যভূমি। তার মনে হয়েছে সেই বধ্যভূমিগুলোর কোনোটাতেই বাঙালি জাতি তাদের প্রতি সংঘটিত নৃশংস জেনোসাইডের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারেনি।  সে নিজের মনেই তুলনা করছিল রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে কিগালির জেনোসাইড মিউজিয়ামের গণকবরের পরিচ্ছন্ন আর শ্রদ্ধাবনত পরিবেশের কথা। তার এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে ছিল না, এখনো নেই।

মেয়ে চলে গেছে ছুটি শেষে কিন্তু তার রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান করছি এখনো, আর সেই সূত্র ধরেই এই লেখা।

১৯৭১ সালে শিশু ছিলাম, যুদ্ধের কথা যেটুকু মনে আছে, তার সঙ্গে মায়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এবং ইতিহাস পড়ে যে চিত্র আমার সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারে পরিকল্পিত ও পরিচালিত জেনোসাইড। জেনোসাইডের ওপরে প্রাতিষ্ঠানিক পড়া এবং উন্নয়নকর্মী হিসেবে বিভিন্ন দেশে জেনোসাইডের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্মমতা আমি দেখেছি। তাই মেয়ে যখন প্রশ্ন করে, ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকে বাংলাদেশে কেন কেবল গণহত্যা বলা হয়, তখন খানিক থমকে যাই।

কোনো একটি দেশ বা একটি জাতি যখন পরিকল্পিতভাবে ঘোষণা দিয়ে আরেকটি নির্দিষ্ট জাতিকে তাদের জাতিসত্তা বা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তখন ১৯৫১ সালে স্বীকৃত জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’ অনুযায়ী সেটি জেনোসাইড বলে বিবেচিত হয়।  কনভেনশনের আর্টিকেল ২-এ জেনোসাইডের ডেফিনেশনে টু দ্য পয়েন্টে বলা হয়েছে,  যখন একটি জাতি অন্য আরেক জাতিকে তাদের নির্দিষ্ট জাতীয়তা, জাতিসত্তা, ধর্ম, বর্ণের কারণে (ন্যাশনাল, এথিক্যাল, রেসিয়াল অথবা রিলিজিয়াস গ্রুপ) পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করার প্রয়াসে (অ্যাক্টস কমিটেড ইনটেন্ট টু ডেস্ট্রয়, ইন হোওল অর ইন পার্ট) খুন (কিলিং), শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতিসহ পরিকল্পিতভাবে হিসাব-নিকাশ করে ধ্বংস কার্যক্রম সঙ্ঘটিত করে এমনকি নির্দিষ্ট জাতি/ গোষ্ঠীর শিশু জন্ম রোধ এবং জোর করে নির্দিষ্ট জাতির শিশুদের অন্য জাতিতে যেতে (ট্রান্সফারিং) বাধ্য করে,  তখনই সেটা জেনোসাইড অপরাধের আওতায় পড়ে। রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড জেনোসাইডের আওতায় পড়ে না।

কনভেনশনের আর্টিকেল-৩-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, কোন অপরাধগুলো এই কনভেনশনের আওতায় শাস্তিযোগ্য। সেগুলো হলো—জেনোসাইড, জেনোসাইড ষড়যন্ত্রকারী (কনস্পিরেসি টু কমিট জেনোসাইড), জেনোসাইডে অংশ নেওয়ার জন্য সরাসরি এবং খোলাখুলি প্ররোচনা (পাবলিক ইন্সাইটেন্ট), অ্যাটেম্পট টু কমিট জেনোসাইড,  জেনোসাইডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোনো একটি প্রমাণিত হলেই সেই ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে সাজার আওতায় আনা হবে।

মেয়ের লজিক ছিল, গণহত্যা বা ম্যাস কিলিং যেকোনো জেনোসাইডের একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি।  গণহত্যা ছাড়াও কনভেনশনে বর্ণিত সব পদ্ধতি বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানিরা ব্যবহার করেছিল, তাহলে বাংলাদেশে ১৯৭১-কে শুধু গণহত্যা বলা হয় কেন? গণহত্যা বা মাস কিলিং জেনোসাইড ছাড়াও নানা কারণে হয়ে থাকে।

আমি যেহেতু জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ নই, তাই তাত্ত্বিক আলোচনার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।  কেবল মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি অন্যান্য দেশের স্বীকৃত জেনোসাইডের সঙ্গে বাংলাদশের জেনোসাইডের চিত্র। মানবিক সহায়তাকর্মী (হিউম্যনিটারিয়ান এইড ওয়ার্কার) হিসাবে জেনোসাইডের শিকার জাতিগোষ্ঠীর সহায়তায় কাজ করেছি কাম্বোডিয়ায়, বসনিয়ায়, শ্রীলঙ্কায়, সুদান, সাউথ সুদান, কেনিয়া, উগান্ডায়।  দেখেছি আউচভিতসে নাজিদের বন্দিশালা যেখানে ইহুদিদের জীবন্ত অবস্থায় জ্বলন্ত চুল্লিতে পুড়িয়ে ছাই করা হতো। খাবারের রেশন কম করে দিয়ে ইহুদি মানুষদের দুর্বল করে ফেলা হতো, তাদের ঘরবাড়িতে যখন-তখন হানা দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো।  এসব কিছুই জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্ত। আমার মনে পড়ে গেছে, খুলনার উপকণ্ঠে একটি কারখানার চুল্লিতে বাঙালি বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়ে এসে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে সেই চুল্লিতে অঙ্গার করার কথা।

কাম্বোডিয়ায় দেখেছি জেনোসাইড মিউজিয়াম। কীভাবে খেমারবিরোধী বন্দিদের দিনের পর দিন না খাইয়ে রেখে দুর্বল করে জবাই করে খুন করা হয়েছিল।  রাজধানী নমপেনের উপকণ্ঠে একটি স্কুলে সেই জেনোসাইড মিউজিয়াম, যেখানে বন্দিরা  নিজের রক্ত দিয়ে বন্দিশালার চিত্র এঁকেছেন। কাম্বোডিয়ায়ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, শিশুদের মাটিতে আছাড় দিয়ে মারা হয়েছে, মায়ের পেট কিরিচ দিয়ে ফালা ফালা করে মা ও শিশুকে খুন করা হয়েছে। এই জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল পল পটের নেতৃত্বাধীন খেমার সৈন্যদের হাতে। এসব কিছুই জেনোসাইডের পদ্ধতি।  কম্বোডিয়ার সিয়েম রেপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো বর্ষীয়ানরা পল পটের বিভীষিকাময় সেই হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠেন।  জেনোসাইড মিউজিয়ামে রাখা মাথার খুলিগুলো মনে করিয়ে দেয় সরকারি মদদপুষ্ট হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা। কাম্বোডিয়ান জনগণ জেনোসাইডে জীবনদানকারী মানুষদের প্রতিনিয়ত মনে করে।

দেখেছি সুদানের দারফুরে আরব বংশোদ্ভূত সরকার কীভাবে নন-আরবদের টার্গেট করে ঘর বাড়ি পুড়িয়ে বাস্তুচ্যুত করেছিল প্রায় কুড়ি লাখ মানুষকে আর লক্ষাধিক অনারব নারীকে ধর্ষণ করে আরব শিশু জন্মদানের ভয়াবহ প্রচেষ্টার কথা। যুক্তি ছিল এইসব ধর্ষণের শিকার মায়েদের পেট থেকে আরব শিশু জন্ম নেবে আর তারা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সরকার তাদের জেনারেলদের দ্বারা সাধারণ সৈন্যদের উজ্জীবিত করার জন্য বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করে গর্ভবতী করার নির্দেশ দিয়েছিল, যেন সেসব পাকিস্তানি বীর্যে জন্ম নেওয়া শিশু পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে না যায়। কী অদ্ভুত মিল এই হত্যাকারীদের মধ্যে! স্বাধীনতার পরে অস্ট্রিয়া থেকে ধাত্রীবিদ্যার বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছিল বাংলাদেশের ধর্ষণের শিকার গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত এবং যাদের সম্ভব নয় তাদের  প্রসব করানোর জন্য।  সেই অস্ট্রীয় ডাক্তারের প্রাথমিক হিসাবে প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।  একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের দত্তক দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করার জন্য মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

দারফুর জেনোসাইড অত্যন্ত সিস্টেমেটিকভাবে ফুর, মাসালিট আর যাঘায়া জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হয়েছিল। এরিক রিভসের রিপোর্ট অনুযায়ী এক মিলিয়ন মানে দশ লাখের বেশি শিশুকে হত্যা, ধর্ষণ, আহত আর বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। অনাথ হয়েছিল লাখ লাখ শিশু।  সরকারি সৈন্য অতর্কিতে ঘিরে ফেলত গ্রাম আর মিলিশিয়ারা ছনের তৈরি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো।  নারীদের ধরে নিয়ে যেত ধর্ষণ ক্যাম্পে আর পুরুষদের ধড় থেকে কল্লা নামিয়ে ফেলত  ম্যাসেটি দিয়ে। দুধের শিশুকে আগুনের মধ্যে ছুড়ে ফেলত তারপরে সেই শিশুর খুলি ফাটার শব্দে আনন্দ করতো। প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেসব শিশুর অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কেনিয়ার কাকুমা রিফিউজি ক্যাম্পে, অনেকেই তারা তারুণ্যে পা দিয়েছে, এখনো তাদের সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট দরকার পড়ছে, এতটাই ট্রমাটাইজড তারা।  দারফুর জেনোসাইড একুশ শতকের ভয়াবহতম জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃত। দারফুর জেনোসাইডের মূল কারণ সুদানের মরু অঞ্চলের কৃষিজীবী  জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের  অবিচার আর বঞ্চনা। এক পর্যায়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীরা মিলে ‘দ্য জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট’ নামে আন্দোলন শুরু করলে সরকারে মদদপুষ্ট মিলিশিয়া গ্রুপ লেলিয়ে দেওয়া হয় তাদের ধ্বংস করার জন্য। ঠিক যেমনটি পাকিস্তানি সরকার রাজাকার, আলবদর আলশামস বানিয়েছিল বাঙালিনিধনে। সুদানের জাতিগত সংঘাত পুরোপুরি শেষ হয়নি এখনো।  প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে দারফুরে অনারব জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটিত করার অপরাধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

গত কয়েক বছরে বেশি আলোচনায় এসেছে সাউথ সুদানের গৃহযুদ্ধ। সাউথ সুদানের গৃহযুদ্ধ ও ডিঙ্কা আর নুয়ের জনগোষ্ঠীর জাতিগত সংঘাতের কারণে প্রায় বারো লাখের বেশি শরণার্থী উগান্ডায় আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য আরও অনেক সংস্থার সঙ্গে আমার সংস্থা কাজ করছে। সাউথ সুদানে ডিঙ্কা জাতি, যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছে তারা নুয়েরদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ, আগুন লাগিয়ে বাস্তুচ্যুত করা, গবাদিপশু, ফসলের খেত পুড়িয়ে দেওয়া এর সব কিছুই করা হচ্ছে সরকারি মদদে। কয়েক বছরব্যাপী এই গৃহযুদ্ধের কারণে সাউথ সুদানের নুয়ের অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। খাদ্যের অভাবে প্রতিদিন কয়েকশ নুয়ের মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উগান্ডার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। সাউথ সুদানে সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি কমিশন তদন্ত শেষে জানিয়েছেন, এথনিক ক্লিঞ্জিং-এর স্ট্রাকচারড ভয়াবহতা জেনোসাইডে পরিণত হতে যাচ্ছে।

দুই হাজার তিন এবং চার  সালে  শ্রীলঙ্কার জাফনায় দেখেছিলাম তামিল সিংহলিজ গৃহযুদ্ধের নির্মমতা।  দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধের মূলে ছিল দুই  জনগোষ্ঠী ভেতরে  চরম  অবিশ্বাস  আর  জাতিগত সংঘাত। মনে পড়ে, আমি  না পারতাম তামিল বলতে, না সিংহলিজ। দুই  পক্ষের গ্রামের লোকজন আমাকে  সন্দেহ করতো। তামিলরা  মনে করতো  আমি সিংহলি, আর সিংহলিরা ভাবতো আমি ভারতীয়।  জাতিসংঘের পরিচয়পত্র শরীরের  অংশ  হয়ে গিয়েছিল আমাদের মতো এইড ওয়ার্কারদের। সম্প্রতি জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সিংহলিজ সরকার রাষ্ট্রের  একমাত্র ধর্ম  বৌদ্ধ আর একমাত্র ভাষা সিংহলিজ ঘোষণা  করা আদতে তামিলদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড ঘোষণা করার। হয়তো অচিরেই তামিলদের বিরুদ্ধে জাতিগত সংঘাত জেনোসাইড হিসাবে স্বীকৃত হবে।

২০০৫ সালের মার্চ মাসের কনকনে ঠাণ্ডায় আমরা ক’জন শান্তির শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে  ছিলাম স্রেব্রেনিৎসায় গণকবরের সামনে। ফ্রিজিং পয়েন্টের নিচের সেই তাপমাত্রায় দেখছিলাম এক মাকে তুষারশুভ্র একগোছা ফুল হাতে এসেছেন ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের গণহত্যায় মৃত পুত্রের কবরে। কালো স্কার্ফে ঢাকা তার মাথা, সজল চোখে তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন বসনিয়ার কসাই কীভাবে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল মুসলিম পুরুষ, তরুণ ও কিশোরদের। এই মাস কিলিং বসনিয়ান মুসলিমদের বিরুদ্ধে সার্বদের প্ল্যান্ড বৃহত্তর জেনোসাইডের একটি অংশ ছিল। সাবেক এই স্কুল শিক্ষক তার ভাঙা ইংরেজি আর ভাঙা রাশানে বলেছিলেন, তার বোনের তিন মেয়ের ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা, কীভাবে সার্ব সামরিক সৈন্যদের বলা হয়েছিলো বসনিয়ান মুসলিম নারীদের গর্ভে সার্ব ক্রিশ্চিয়ান জন্ম দেওয়ার বিকৃত পরিকল্পনার কথা। বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে মিলে ম্লাদিচ ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠা করতে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিল।

স্লাদিচ যখন গ্রেফতার হলো ২০১১ সালে, তখন থেকে চোখ রাখছিলাম ট্রায়ল প্রসেসের ওপরে। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম কসাইয়ের যেন যথাযথ শাস্তি হয়।  এরমধ্যে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কাদের মোল্লা এবং গংদের ফাঁসির রায় হয়, আমি যেন জানতাম পৃথিবীর অন্য সব জেনোসাইডের পরিকল্পনাকারী হোতাদেরও শাস্তি হবে একদিন অবশ্যই। ২০১৭ সালে যখন ‘বসনিয়ার কসাই’ রাদকো ম্লাদিচের বিরুদ্ধে আনা নব্বইয়ের দশকে বলকান যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা পরিকল্পনার মূল হোতা হিসেবে সব অপরাধ প্রমাণিত হলো এবং আন্তর্জাতিক আদালতে সাজা হলো, উগান্ডায় বসে আমার সেই মায়ের কথা মনে পড়ছিল, যিনি বলেছিলেন, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কেবল একটা প্রার্থনাই করি, যেন নিজের জীবদ্দশায় এই কসাইয়ের সাজা দেখে যেতে পারি।

বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত জেনোসাইড মিয়ানমার সরকারের পরিচালিত আরাকানে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেনোসাইড।  একটি স্ট্রাকচারড জেনোসাইডের সব এলিমেন্ট এই রোহিঙ্গা সংঘাতে রয়েছে। বাংলাদেশ  রোহিঙ্গা রিফিউজি হোস্টিং দেশ হিসেবে এই জেনোসাইডের ভয়াবহতা কেবল দেখছে তাই-ই নয়, পলে পলে ভুগছেও।

লক্ষণীয়  বিষয়  এই—প্রতিটি দেশে জেনোসাইডকে কিন্তু তাদের নিজের ভাষায় ভাষান্তর করা হয়নি।  জেনোসাইডকে অন্য কোনো ভাষায় রূপান্তর করা যায় না, উচিতও নয়। জেনোসাইড শব্দটি আসলে দুটি শব্দের সংমিশ্রণ—গ্রিক শব্দ ‘জেনোস’ অর্থ ‘জাতি বা রেইস’ আর ল্যাটিন শব্দ  ‘সেডিও’  মানে এক্ট অব কিলিং।  রাফায়েল ল্যামকিন,  হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া জুইশ আইনবিদ ১৯৪৪ সালে জেনোসাইড শব্দটি তার বিখ্যাত বই  ‘একসিস রুল অব অকুপায়েড ইউরোপ’-এ প্রথম  ব্যবহার  করেন। জাতিসংঘ মূলত ল্যামকিনের কাছ থেকেই জেনোসাইড শব্দটি নিয়েছেন। তাহলে  বাংলাদেশে কেন জেনোসাইডের  বাংলা ভাষান্তর করার এই ভুল প্রয়াস? সব শব্দের ভাষান্তর করা যায় না, উচিতও নয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা জেনোসাইড সংঘটিত করেছিল, সেই জেনোসাইডের একটি নির্মম পদ্ধতি হলো গণহত্যা বা মাস কিলিং। যেমন আরও অনেক পদ্ধতি হলো—খুন, ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা ব্যাহত করা। জেনোসাইড আর গণহত্যা এক নয়। গণহত্যা  নানা  কারণে  সংঘটিত  হতে পারে, রাজনৈতিক  কারণে হতে পারে,  ধর্মীয়  উন্মত্ততার কারণে  হতে পারে। মনে আছে সবার গায়ানার  ম্যাসাকারের  কথা,  সেসবও  গণহত্যা  কিন্তু জেনোসাইড  নয়।  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বাঙালি জাতিসত্তার সাধারণ  নিরস্ত্র  মানুষ আর  বিশেষ করে হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সব নারী-পুরুষ-শিশুকে  নিশ্চিহ্ন  করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সরকার পরিকল্পনা করে সরকারি মদদে সশস্ত্র  সামরিক  জেনোসাইড  সংঘটিত করেছিল।

বাংলাদেশ ১৯৭১ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জঘন্যতম নৃশংসতম  জেনোসাইড।

লেখক: উন্নয়নকর্মী, কাম্পালা,  উগান্ডা

ইমেইল [email protected]

গণহত্যা জেনোসাইড লীনা হাসিনা  হক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর