Saturday 12 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ও ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা


৪ এপ্রিল ২০১৯ ১২:২৯ | আপডেট: ৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৬:৫৯
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধের সরকারি নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে ভারতের জি নেটওয়ার্কভুক্ত একাধিক চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিলেন ক্যাবল অপারেটররা। এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছিলো ততক্ষণে চ্যানেলগুলো ফের খুলে দেওয়া হয়েছে। ধারণাই করা যায়, সরকারের একটি নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানে কিংবা সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে চ্যানেলগুলো বন্ধ করেন ক্যাবল অপারেটররা। কিন্তু সরকার তো দেশের প্রচলিত আইনেরই প্রয়োগ চেয়েছে মাত্র। ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন ২০০৬-এর উপধারা ১৯(১৩)-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি কোনও চ্যানেলে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায় না। শুধু দেশীয় বিজ্ঞাপন নয়, যে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারেই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কোন টিভি চ্যানেল যদি দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে, তাহলে সেই চ্যানেলটি বাংলাদেশে চলবে না, হোক সেটি জি বাংলা কিংবা অন্য কোন বিদেশি চ্যানেল। একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার চ্যানেলগুলো আসলে সরকার বন্ধ করে নি, চ্যানেলগুলো যেসকল ক্যাবল অপারেটরা চালান তারা বন্ধ করেছিলেন। তাদের পক্ষে যেহেতু বিজ্ঞাপন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছিলো না তাই মাথা ব্যাথা সারতে মাথাটাই কেটে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেটাই কী আসল উদ্দেশ্য? জি বাংলার বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানের প্রতি বাংলাদেশের দর্শকের হুমড়ি খেয়ে পড়ার একটি বিষয় রয়েছে, এ কথা অনেকেই স্বীকার করবে। চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। আর চব্বিশ ঘণ্টা না পেরোতেই চ্যানেলগুলো আবার খুলেও দেওয়া হয়। অথচ ২০০৬ সালের এই আইনটি গত ১৩ বছর ধরে কার্যকর করা যাচ্ছে না। তথ্য মন্ত্রণালয় আইনের প্রয়োগ চেয়েছে মাত্র।

বিজ্ঞাপন

বন্ধ হয়ে যাওয়া চ্যানেলগুলো ভারতীয় নাকি মার্কিন সেটি আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, বিষয় হলো- দেশীয় বিজ্ঞাপন বিদেশের টেলিভিশনে প্রচারিত হলে দেশের বিজ্ঞাপন বাজার নষ্ট হয়। সে বিষয়ে আগে থেকেই সোচ্চার দেশের বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল ও তাদের মালিকপক্ষ। এমন একটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওই আইন করে। ৫০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে এই বিজ্ঞাপনের অর্থ দেশীয় চ্যানেল পেলে টেলিভিশন মালিকরা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি ও কন্টেন্ট নির্মাণে মনোযোগী হবেন। এই ধারণা থেকে তথ্য মন্ত্রণালয় দেশীয় শিল্প বাঁচাতে আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়। দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার নিজেদের হাতে থাকলে টেলিভিশনের উদ্যোক্তারা ভালো কনটেন্ট তৈরিতে আগ্রহী হবেন এমন বিষয়টির কোন নিশ্চয়তা নেই বটে, তবে দেশের টিভি মালিকরাই এই ৫০০ কোটি টাকা বাজার ফিরে পাবেন এই নিশ্চয়তা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। ব্রিটেনে বাংলাদেশের একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই সেট টপ বক্সের মাধ্যমে দেখেন দর্শকরা। যেমন বাংলাদেশের এনটিভি ব্রিটেনে চলে এনটিভি ইউরোপ নামে, তেমনি চ্যানেল আই ইউরোপে বন্ধ হয়ে যাবার আগে চলেছে চ্যানেল আই ইউরোপ নামে, এটিএন বাংলা চলছে এটিন বাংলা ইউকে নামে। শুধু কোম্পানি হাউজের নামই নয়, রীতিমত ভিন্ন মালিকদের তত্ত্বাবধানেই চলে এই চ্যানেলগুলো। মোটকথা, ব্র্যান্ড নেম ও একই কন্টেন্ট শেয়ার করলেও ব্রিটেনে প্রচারিত এ চ্যানেলগুলোর মালিকানা সম্পূর্ণ আলাদা। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশি এসব চ্যানেলে কোন বাংলাদেশের ঠিকানার কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় না। যে সকল বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ইউকের এসকল বাংলাদেশি চ্যানেল গুলোতে চালাতে চান, তাদেরকে ইউকে’র মালিকদের কাছে আলাদা বাজেট দিয়ে বিজ্ঞাপনের সময় কিনতে হয়। বিষয়টি এমন নয় যে প্রাণের মসলার বিজ্ঞাপন ঢাকার চ্যানেল আইতে চললেই ইউরোপের বাজারে চলবে। ‘প্রাণ’কে ব্রিট্রেনের চ্যানেল আই’র বিজ্ঞাপন বিভাগে বাড়তি অর্থ দিয়েই সেই বিজ্ঞাপন চালাতে হবে।

আরেকটি বিষয় হলো, চ্যানেলগুলো বাংলাদেশি হলেও ব্রিটেনের কাছে এই চ্যানেলগুলো বিদেশি চ্যানেল বা এথনিক চ্যানেল। প্রতিটি এথনিক চ্যানেলকে ব্রিটেনের অফিস অব কমিউনিকেশন্স বা অফকমের নিয়ম মেনে চলতে হয়। অফকমের নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেকটি বাংলাদেশি চ্যানেলকে ব্রিটেনে প্রচারের আগে অফকমের নিয়ম মেনে বিজ্ঞাপন ও ভিডিও/ পপ আপ বিজ্ঞাপন সম্পাদনা করে প্রচার করতে হয়। ঢাকার সংবাদে কোন লাশের ছবি বা ভায়োলেন্সের ছবি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করলেও ব্রিটেনে সেই ছবি আমাদের ব্লার করে প্রচার করতে হয়, নইলে অফিস অব কমিউনিকেন্স নোটিশ পাঠিয়ে দেবে। নিয়ম ভঙ্গের জন্য একাধিক বাংলাদেশি চ্যানেলকে বড়ো অংকের জরিমানাও গুনতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

ফিরে আসছি জি বাংলা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের আকাশে জি বাংলা, সিএনএন কিংবা ডিসকভারি চ্যানেল যদি প্রচার করতেই হয় তাহলে তাদেরকে বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করে বিদেশি বিজ্ঞাপন সম্পাদনা করেই বাংলাদেশে প্রচার করতে হবে। সরকার শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, এই মর্মে। আমার মনে হয়ে বিদেশি চ্যানেলের কোন ধরনের বিদেশি বিজ্ঞাপনও বাংলাদেশে প্রচার করা উচিত নয়। বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেল যখন ক্যাবেল অপারেটররা চালান, তারা আসলে কোন অনুষ্ঠানই যাচাই বাছাই করে চালান না, সরাসরি বিদেশি চ্যানেলগুলো ডাউনলিংক করে প্রচার করেন। এক্ষেত্রে সেইসব চ্যানেলের বিদেশি বিজ্ঞাপনগুলোও ঢালাওভাবে বাংলাদেশে প্রচারিত হচ্ছে। ডিসকভারি চ্যানেল বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে তাদের চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের কর পরিশোধ করছে না। অথবা চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে কোন অফিস নেই যারা তাদের আয় থেকে সরকারকে রাজস্ব দেবে। এই যে জি বাংলাকে বন্ধ করা হলো, আবার চালু করা হলো, এ সবের দরকার ছিলো না। দরকার একটাই চ্যানেলগুলোর সকল বিজ্ঞাপন বন্ধ করা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশে, বিদেশি বিজ্ঞাপন বন্ধ না করলে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, দেশীয় বাজার ধ্বংস হচ্ছে সেটি হয়তো খোলা চোখে দেখা যাবে না। বিষয়টি সহজ, ক্যাবল অপারেটররা জি বাংলা সিরিজের চ্যানেলগুলো চালাতে চাইলে তাদের অফিসে চ্যানেলগুলো ডাউনলিংক করে বাংলাদেশের আকাশে প্রচারের আগে বিদেশি সকল বিজ্ঞাপন সম্পাদনা করে কেটে ছেঁটে চালাবেন, যেমনটা ইউকে করছে এটিএন বাংলা ও এনটিভি সহ অন্যান্য চ্যানেল। এই কাজ মোটেও কোন রকেট সায়েন্স নয়। ব্রিটেনের মাটিতে সকল বিদেশি চ্যানেলকে এই নিয়ম মেনেই টিভি চ্যানেল চালাতে হয়।

বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে চলতে থাকলে দেশের বাজারের পরিণতির ভয়বহতা একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই। ধরা যাক, আমাদের দেশের কোন গ্রাহক হয়তো দেশের কোনও একটি সুগন্ধী সাবান ব্যবহার করেন, এখন বিদেশি ম্যুভি চ্যানেল বা জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখার সময় যদি বিদেশি কোনও সুগন্ধী সাবানের বিজ্ঞাপন দেখেন তাহলে তার দেশি সাবান ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ কমবে। সেই ভোক্তার সামর্থ্য থাকলে সে বিদেশ থেকে আমদানি করে বাজারে ছাড়া ওই সুগন্ধী সাবান ব্যবহার করবেন। ওদিকে বিদেশি সাবান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনটা না দিয়ে ডিসকভারির মাধ্যমে দেবে। গ্লোবাল বাজেটের মাধ্যমে সাবান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে কোন বিজ্ঞাপন বাজেট না রেখেই বিশাল বাজার ধরে ফেলতে পারল। কিন্তু নীতিমালা কঠোর হলে বিদেশি সাবান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের এজেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য হবে। তখন দেশীয় চ্যানেলে বিদেশি বিজ্ঞাপনের আরেকটি নতুন বাজারও তৈরি হবে।

সেই অর্থে দেশের বিজ্ঞাপনের টাকা দেশে রাখার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদেশি পণ্যের বাংলাদেশি এজেন্টের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য করতে হলেও বিদেশি চ্যানেলে দেশি বিজ্ঞাপনই নয় বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে দেশীয় পণ্য যদি বিদেশে তার বাজার বিস্তৃত করতে চায় তাহলে কেন বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না। উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশি যে কোন প্রতিষ্ঠান বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে, তবে সেই বিদেশি চ্যানেলটি যদি বাংলাদেশে প্রচার হয় তাহলে সে বিজ্ঞাপনগুলোও সম্পাদনা করে ফেলে দিতে হবে।

ধরুন, প্রাণের বড় একটি বাজার রয়েছে ভারতে, তাহলে প্রাণ ভারতের টিভিতে বিজ্ঞাপন দিলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাধা দেওয়ার কোন কারণ নেই। তবে ভাতরীয় চ্যানেলে প্রাণের প্রচারিত বিজ্ঞাপন বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রচার হতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রচারের জন্য প্রাণ সরকারকে কোন রাজস্ব দেয়নি বা বাংলাদেশি কোন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার হলে সেই টেলিভিশনটি সরকারকে রাজস্ব দিতো তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। তাই হিসাব খুব সহজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে কিন্তু বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রচারের সময় সকল বিজ্ঞাপন যখন সম্পাদনা করে ফেলে দেবে তখন প্রাণসহ সকল বিজ্ঞাপনই বাদ পড়ে যাবে। সরকারের আরো একটি বিষয় নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। তা হচ্ছে, বিদেশি চ্যানেলগুলো দেশে প্রচার করতে হলে তাদেরকেও লাইসেন্সিং ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসা। বিদেশি সব চ্যানেলকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে তেমনি সরকারের রাজস্বও বাড়বে। একইভাবে ইউটিউব বা ফেসবুককেও সরকারকে রাজস্ব দিতে বাধ্য করতে হবে যদি তারা বাংলাদেশের বাইরের কন্টেন্ট বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের কাছে উন্মুক্ত করতে চায়।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বোরোলিন, চ্যাবনপ্রাস আর হাজমলার কথা? ডিডি মেট্রো আর দূরদর্শন দেখে আমরা আমাদের স্কুলের ব্যাগভর্তি হাজমলা নিয়ে ঘুরতাম। দেশের বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছিল এইসব ভারতীয় পণ্যে। কোত্থেকে এই পণ্য কিভাবে আসতো আমার জানা ছিল না তবে বাবাকে দেখতাম তিনি চ্যাবনপ্রাস খেতেন। আমরা খেতাম হাজমলা আর মায়ের ব্যাগে থাকতো একটা বোরোলিন। এখন নিশ্চয়ই আরো নিত্যনতুন পণ্যের উপর নির্ভরতা বেড়েছে আমাদের। কিন্তু দেশীয় শিল্প বাঁচাতে বিদেশি পণ্যের যথেচ্ছা প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে সরকার এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। পাশাপাশি সকল প্রকার বিদেশি চ্যানেলকে বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করে বাংলাদেশে কোম্পানি নিবন্ধনের মাধ্যমে সরকারকে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনুষ্ঠানমালা ও বিজ্ঞাপন প্রচারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার সময় আমাদের হয়ে গেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও পিআর কনসালটেন্ট। একাত্তর টিভির যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি

সারাবাংলা/এমএম

কোয়াব ক্যাবল অপারেটর বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর