‘এ লগন গান শোনাবার’
৬ এপ্রিল ২০১৯ ২০:১২
আমার ছেলেবেলাটা ছিল খুব আটপৌরে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তার সামান্য বেতনে মাস চালাতে মায়ের নাভিশ্বাস উঠতো। কলোনির ছোট্ট দুই রুমের সংসারে সদস্য সংখ্যা ছয়। রোজকার খাবারের মেনু অতি সাধারণ। তিন ভাইয়ের জামা, প্যান্ট, জুতো—সব রিসাইকেলিং হতো। বড় ভাইয়েরটা মেঝ ভাই, মেঝ ভাইয়েরটা আমি। বছরের শুরুতে নতুন মলাটে পুরনো বই। আমাদের বাড়িতে অনেকদিন পর্যন্ত কোনো টিভি ছিল না। টিভি দেখতে ইচ্ছে হলে বন্ধুদের বাড়ি যেতাম।
মায়ের ঘরে পরার শাড়ি ছিল দুটো বা তিনটে। আমাদের রান্নাঘরটি ছিল খুব ছোট আর ভীষণ গুমোট। রান্না করতে গিয়ে আমার মায়ের ঘরে পরা শাড়ি ভিজে চপচপ করতো। সেই আটপৌরে জীবনে হঠাৎ হঠাৎ কী যেন হতো। গৎবাঁধা ছুটির দিনটিও অজানা কারণে ঝলমল করতো। সকালবেলা থেকেই মায়ের মধ্যে চঞ্চলতা। বাবা পত্রিকা পড়ার সময় জোরে জোরে মাকে ডাকতেন, ‘ফার্স্ট ক্লাস করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো।’ মা’র মধ্যেও কোনো ধরনের বিরক্তি দেখতাম না। বিকেল না যেতেই বাবার ডাকাডাকি শুনতে পেতাম, ‘কই রেডি হচ্ছো না? দেরি হয়ে যাবে তো।’ বাবা ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরতেন আর মা তার একমাত্র তোলা শাড়ি অর্থাৎ বাইরে পরে যাওয়ার শাড়িটি পরতেন। তারপর দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে যেতেন। যাওয়ার আগে পই পই করে বলে যেতেন, আমরা যেন দুষ্টুমি না করে বড় বোনের সব কথা শুনি আর লক্ষ্মী হয়ে থাকি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো—রাতের খাবার তৈরি করার সময় আমার মা গুনগুন করে গান গাইতেন। আমি খুব মন দিয়ে আমার মায়ের গান শুনতাম। কী যে মিষ্টি কণ্ঠ ছিল মায়ের। আহা!
এমন একটি চমৎকার দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া চিলতে বারান্দাটিতে গেলেন। মা ভেবেছেন ঘুমিয়েছি। আমি কিন্তু তখনো ঘুমোইনি। বাবা নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। আমার মা সেদিন রাতে গাইছিলেন, ‘এ লগনে দুটি পাখি মুখোমুখি নীড়ে জেগে রয়/ কানে কানে রূপকথা কয়/ এ তিথি শপথ আনে হৃদয় চাওয়ার/ এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার।’
আমি সেদিন গানের কথা বুঝিনি। কিন্তু মায়ের কন্ঠে গানের সুরটি আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন পর জানতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি, চিনতে পেরেছি গানের সুর আর সুচিত্রা সেনকে। আমার কাছে সুচিত্রা সেন মানে আমার মায়ের একমাত্র তোলা শাড়ি, সুচিত্রা সেন মানেই আমার পাখির মতো ছোট্ট মায়ের উচ্ছ্লতা। আটপৌরে জীবন থেকে বেরিয়ে এসে একটি ঝলমলে দিন। সুচিত্রা সেন মানেই একটি মায়াবী রাতে আমার মায়ের গুনগুন গান।
আমি তখন কলেজে পড়ি। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াই। পুরো দমে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছি। সারাদিন মিছিল, মিটিং। অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন, গণতন্ত্রের সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার স্বপ্ন। আর সবকিছু পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখার সেই দিনগুলোয়ো পুরোপুরি একটি বোহেমিয়ান জীবনযাপন করছি। মা রোজ রাতে আমার জন্য অপেক্ষা করে খাবার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। মায়ের শুকনো মুখ আমাকে ঘরে ফেরায় না।
এমন এক রাতের কথা। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা একটা হবে। লোডশেডিং, রাস্তায় আলো নেই। রিকশা করে বাড়ি ফিরছি। এমন সময় কানে ভেসে এলো একটা মিষ্টি কন্ঠ। কে যেন গাইছে, ‘এই রাত তোমার আমার/ ঐ চাঁদ তোমার আমার/ শুধু দুজনে।’ সুনসান রাত। আকাশে এই এত্তবড় চাঁদ। প্রকৃতি যেন নিজেই এক রহস্যময় নারী। রিকশা থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। একবার যদি দেখতে পাই সেই মেয়েটিকে! দেয়ালের ওপাশে দোতালার অন্ধকার বারান্দায় একটা অবয়ব। আর কিচ্ছু দেখা যায় না। কী যে অতৃপ্তি! মেয়েটির মুখটি দেখতে না পাওয়ার কী যে আকুলতা! আমি যতবার ওই গানটি শুনি আমার সেই না দেখা মেয়েটির অস্পষ্ট অবয়বের কথা মনে পরে। আমার কাছে সুচিত্রা সেন মানেই সেই রাতের সেই রহস্যময় মেয়েটি। আমার কাছে সুচিত্রা সেন মানেই একটা অতৃপ্তি, একটা মুখ দেখতে না পাওয়ার আফসোস। সুচিত্রা সেন মানেই এক বোহেমিয়ান যুবকের ভালো ছেলে হওয়ার ইচ্ছে—তোলপাড় হৃদয়।
বাবার কাছে শুনেছি আমার দাদারও প্রিয় নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা। দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি। আমরা সবাই এখন পর্যন্ত বুঁদ হয়ে আছি সুচিত্রা সেনের অপূর্ব গ্রীবা ভঙ্গিমায়, তার চকিত চাহনি আর রহস্যময়তায়, তার মোহনীয় হাসি আর ব্যক্তিত্বে। যুগেযুগে সুচিত্রা-প্রেমিকের চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে, বাতের ব্যথায় হাঁটু কাবু হয়েছে। কিন্তু সুচিত্রা সেন এখনো আমাদের সবার মনমন্দিরের মহানায়িকা। একেকজনের কাছে সুচিত্রা সেন একেকটি কারণে অনন্য। আমার কাছে সুচিত্রা সেন মানেই দুটো রাতের স্মৃতি। শৈশব ছোঁয়া এক গভীর রাতে আমার মায়ের গলায় ছলকে ওঠা সুর। আর যৌবনে অন্ধকার বারান্দায় একটি অস্পষ্ট অবয়ব। তাকে দেখতে না পেয়ে এক যুবকের দুঃখ-বিলাস।