বারেক সাহেব ও ডিজিটাল তেলাপোকা
৮ এপ্রিল ২০১৯ ১২:১৯
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কমছে সবকিছুই। কমছে সামাজিকতা, কমছে মাঠের রাজনীতি। ভাবেন বারেক সাহেব। একটা সময় সামাজিকতা মানেই ছিল আলিমুুদ্দিনের রান্নাঘরে দিলিপের অবারিত যাতায়াত। ঈদে-পূজা-পার্বনে হিন্দু-মুসলমানরা একসাথে উৎসবে মেতে উঠতো। শহরের মানুষ ছুটির সন্ধ্যায় বেড়াতে যেত চাচা-মামা, খালা-ফুপুর বাসায়। এখন সেই রেওয়াজ নাই। নেই সেই আগের দিনও। এখন সামাজিকতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। আজকের মানুষ আত্মীয়-বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যায় না। বেড়িয়ে আসে তাদের ফেসবুক ওয়াল থেকে। ভাগনা-ভাতিজারা এখন আর মেট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটে স্টার মার্ক পায় না। তারা এসএসসি-এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পায় আর মামা-চাচারা ফেসবুকেই পাঠিয়ে দেন ফুলের তোড়া আর হাসি হাসি ইমোজে চলে ডিজিটাল সামাজিকতা। বারেক সাহেব যে সেই সামাজিকতা মিস করেন না তা নয়, কিন্তু কি আর করা? সবাই যখন খুশি, খুশি হতে শিখছেন বারেক সাহেবও ।
শুধু সামাজিকতাই না, বদলে গেছে রাজনীতিও। মাঠের বিরোধী রাজনীতি এখন ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে ডাইনোসরের ফসিলের পাশে। বারেক সাহেবের মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে তারাও এক সময় মাঠে ছিলেন। কোথায় যেন শুনেছিলেন, ‘অতি বাড় বেড়ো না, ছাগলে মুড়ে খাবে’। কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা! সরকারি দল যদি মুড়ে খেত তাও না হয় সহ্য করা যেত। তাদের তো মুড়ে খাচ্ছেিউদিয়মান সূর্য, গামছা ইত্যাদি নানা প্রজাতির গৃহজীবি চতুস্পদেই। এক সময় যে দলকে মনে করা হতো ক্ষমতা থেকে টলানো যাবে না কোনোদিনই, সেই দলই আজ রাজনীতির মাঠ থেকে বিলুপ্ত। যে দলের সরকার একদিন সাবমেরিন ক্যাবল বসানোর অনুমতি দেয়নি, আজ তাদেরই খুঁজতে যেতে হয় ফেসবুকে। এখন দলীয় সভা মানেই প্রেস ক্লাব আর বড়জোড় মহানগর নাট্যমঞ্চ। ব্যস এইটুকুই। দলীয় লোকজন এখন গরম রাখছেন ফেসবুক। অল্প সত্যি আর অনেক বেশি মিথ্যার খিচুরিতে সরকারকে মাঝে সাঝেই বেকায়দাও রাখছেন তারা। এইতো কদিন আগেই কোটা বিরোধী আর নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের নামে ভালোই খেল দেখানো গিয়েছিল। ভালই বেকায়দায় পড়েছিল সরকারও। বিশেষ করে ওই যে নায়িকাটা, নামটা কেন যেন কিছুতেই মনে আসছে না বারেক সাহেবের – ফেসবুকে কেঁদে-কেটে ভালই নাকানি-চুবানি খাইয়েছিল সরকারকে। বারেক সাহেবের তো মনে হচ্ছিলো গিয়ে একটু নেচে আসেন তার সাথে।
‘আচ্ছা, দলের নেতাদের কি এতটুকুও শিক্ষা হয় না?’ এরাতো রাজপথে নাই-ই, নাই ফেসবুকেও। এরা না শিখলো সরকারি দলের কাছ থেকে, না নায়িকাদের কাছ থেকে। এরা শুধু নয়া পল্টনে বসে বসে আতলামি আর শরৎ বাবুর ভাষায় প্রেস ব্রিফিং করতে ওস্তাদ। ভাবতেই গা টা জলে যায় বারেক সাহেবের। সাধারণ মানুষ যে কি ভাবেন তা ওপরওয়ালাই ভাল জানেন। তবে এসব দাঁত ভাঙ্গা শব্দ সাধারণ মানুষের উপর যে কোন আসর তৈরি করেনা সেটুকু অন্তত ভালই বোঝেন বারেক সাহেব। আর এটুকু বোঝার জন্য সম্ভবত রাজনীতিবিদ হওয়ার দরকার পরে না বলেই মনে হয় বারেক সাহেবের কাছে। দলের জনপ্রিয়তা যে এখন কোন ড্রেনে তা একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর যাই পারুক কোনো দলকে যে রাজনীতিতে টিকিয়ে রাখতে পারেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত বারেক সাহেব। ডেইনোসরের গৌরবে যে এদেশের রাজনীতিতে আর ফিরে আসা যাবে না তা ভালই জানেন বারেক সাহেব। সমস্যা হচ্ছে তেলাপোকার চতুরতায় টিকে থাকার যোগ্যতাও দলের নেতাদের মধ্যে দেখছেন না তিনি।
ইদানিং ফেসবুকেই দলের খোঁজ খবর রাখেন বারেক সাহেব। সেদিন ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে দেখলেন লন্ডনের একটি আলোচনা সভার ভিডিও। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন। একজন বক্তা তার বক্তব্যের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধে ‘আনুমানিক ত্রিশ লাখ’ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রবাসী বড় নেতার কাছে ঝাড়ি খেলেন। বেচারা বোধহয় একটু হলেও ধারনা করেছিলেন ত্রিশ লাখের সত্যটি নেতার খুব একটা পছন্দ হবে না। তাই ‘আনুমানিক’ বলে ব্যালেন্স করার চেষ্টাও করেছিলেন। কাজ হয়নি। নেতার ঝাড়ি খেয়ে নিজের বক্তব্য সংশোধন করে ‘তিন লক্ষ’ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন করে বক্তব্য শুরু করলেন ভদ্রলোক। ‘তারা যে পাকিস্তানের দালাল সেটাতো সবার জানা’। রাজাকারদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিতো তারাই বানিয়েছিলেন। আইএসআই প্রধানতো পাকিস্তানের আদালতে জবানবন্দীই দিয়েছেন তার দলকে তারা নির্বাচনে কত টাকা দিয়েছেন। তাই বলে এসব জিনিস এভাবে চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলে ফেসবুকেও যে রাজনীতি করার জায়গাটা আর থাকে না তা দলের নেতারা যে কবে বুঝবেন ভাবেন বারেক সাহেব।
ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দলের বড় নেতার পরিণতি তো আজ চোখের সামনে। নিজেতো ডুবলেনই, ডোবালেন দলটাকেও। একাকি প্রাসাদপম অট্টালিকায় যে এক বছরের বেশি সময় পাড় করে দিলেন তা নিয়ে দেশের মানুষের কোন ভাবান্তার আছে বলে বনে হয় না বারেক সাহেবের। তখনতো না হয় বলা গিয়েছিল তথ্য উপাত্ত নেই, নেই গবেষনা ইত্যাদি, ইত্যাদি। কুল রক্ষা হয়নি বটে, অন্তত এসব বলে মুখতো রক্ষা হয়েছিল দলের কানা সমর্থকদের কাছে। এখনতো আর সেই সুযোগও নেই। সাম্প্রতিক গবেষণায়তো উঠে এসেছে একাত্তরের শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নয়, কম পক্ষে পয়ত্রিশ লাখ। তাহলে এখন গায়ের জোড়ে এসব বক্তব্য দিয়ে ত্রিশ কে তিন বানিয়ে কার কি লাভ হয় কে জানে। দলের তো অন্তত কোন লাভ হয় না। খুশিও হননা দেশের মানুষ। দলের নেতাকর্মী? তারাও খুশি হন বলে তো মনে হয় না। তাহলে কাকে খুশি করতে এসব বলা কে জানে।
ত্রিশ কেন তিন, এর ব্যাখ্যা দিতে দিতে বারেক সাহেবদের এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এটা কি পাকিস্তানিদের খুশি করতে? কে জানে? হয়তো বা! অবশ্য পাকিস্তানিদের খুশি করে দলের যে কি লাভ হয় তা মাথায় ঢোকেনা বারেক সাহেবের। ঢোকার দরকারও নেই। যারা বলেন তারা দরকারটা বুঝলেই বারেক সাহেব খুশি। সমস্যা হচ্ছে দলের আর দশজন নেতাকর্মীর মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর ধাক্কাটা তাকে সামলাতে হয়, এই যা। বারেক সাহেবের দুশ্চিন্তা একটা জায়গাতেই। প্রত্যাশা ছিল ‘ডিজিটাল তেলাপোকা’ হয়ে রাজনীতিতে বেঁচে থাকবেন। এখনতো সেটাও কঠিন হয়ে দাড়াচ্ছে।
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) : চিকিৎসক ও কলাম লেখক।