নুসরাতের লড়াইটা কে চালাবে এখন?
১১ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৪০
‘আমরা আসলে আজ সারাদিনই হাসপাতালে ছিলাম। নুসরাতকে দেখতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসেছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ের ডাক্তার নেতারাও তাকে দেখে গেছেন। সাড়ে ছয়টা বা সাতটার দিকে আমি হাসপাতাল ত্যাগ করি। কিছুক্ষণ পরই শুনি, নুসরাত খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ফিরে আসি। শেষ মুহূর্তে নুসরাত আসলে ভেনটিলেটারে ছিল। তার অনুভুতিটা আসলে […] বোঝার মতো কিছু ছিল না। তার সারা শরীরে সেফটিসেনিয়া হয়েছিল। আমাদের শরীরের ৮০ শতাংশ চামড়া বেসিক প্রটেকশন দেয়। সেই ৮০শতাংশ চামড়াই যখন পুড়ে যায়, তখন রোগজীবাণু খুব সহজেই শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সংক্রমিত হয়। নুসরাতের বেলায়ও তাই হয়েছিল। তার শরীর পুড়ে যাওয়ায় কিডনি অকেজো হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে তার কার্ডিয়াক যে সিস্টেমটা […] হার্ট তখন আর কাজ করছিল না। তারপরও আমরা তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করার পরও নুসরাতকে বাঁচাতে পারিনি।’
একজন চিকিৎসক নুসরাতের শেষ মুহূর্তের জীবন সংগ্রামের হৃদয় বিদারক বর্ণনা দিয়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন, নুসরাতের এই মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। নারীর জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে নুসরাতের করুণ মৃত্যুর ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
প্রিয় পাঠক, নুসরাতের করুণ মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাকেও ব্যথিত করেছে। নিশ্চয়ই অনেকের মতো আপনিও এই নির্দয়, নিষ্ঠুর ঘটনার বিচার চান? কিন্তু আদৌ কি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হবে বলে মনে করেন? হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেছে নুসরাত। এরপরই না অপরাধীদের সম্পর্কে অনেক অভিযোগ শুনতে পারছি।
অভিযুক্ত মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলা সম্পর্কে কত কথাই না এখন প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু নুসরাতকেই নয়, এর আগেও অনেক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেছেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে কখনো অর্থের লোভ দেখিয়ে, কখনো বা ঠেঙ্গারে বাহিনীর মাধ্যমে জীবননাশের ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছেন। নুসরাতকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর ঠেঙ্গারে বাহিনীকে দিয়ে আগের মতো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নুসরাতের শরীরে অ্যাসিড নিক্ষেপ করান মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেফতার করে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নুসরাত যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন সোনাগাজীতে লম্পট প্রিন্সিপালের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে প্রিন্সিপালেরই ভাড়া করা মানুষ।
প্রকাশ্য সমাবেশে মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন অনেকে। ওই সমাবেশে একজন বক্তার বক্তব্য ছিল খুবই আপত্তিকর। প্রকাশ্য সমাবেশে তিনি বলেছেন, সোনাগাজী মাদ্রাসায় যেমন ছাত্রলীগের জন্ম হয়, তেমনি ছাত্রদলের জন্ম হয়। আবার শিবিরেরও জন্ম হয়। পাশাপাশি আলেমেরও জন্ম হয়। কাজেই এই মাদ্রাসার সম্মানিত প্রিন্সিপালকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
প্রিয় পাঠক, ভাবতে পারেন প্রকাশ্য সমাবেশে একজন দুশ্চরিত্রবান মাদ্রাসা প্রিন্সিপালের পক্ষে কী হুঁশিয়ারিই না দেওয়া হয়েছে! ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ যখন তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনকার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা গেছে পুলিশের সঙ্গে জামাই আদরের পরিবেশে হেঁটে যাচ্ছেন মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলা। চেহারায় অপরাধের লেসমাত্র নাই। বরং চেহারায় এক ধরনের ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাচ্ছিল। ভাবটা এমন, তোরা আমার কিছুই করতে পারবি না। মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলার ওই ছবি যখনই চোখের সামনে ভাসে তখনই একটা প্রশ্ন মাথায় আসে অপরাধ করেও কীভাবে এত শান্ত থাকে মানুষ?
ছোটবেলা থেকে এমন শিক্ষা পেয়েছি যে, শিক্ষককে দেখলে অজান্তে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাটা যেন একটু বেশি। কিন্তু সম্প্রতি সিরাজ-উদ-দৌলার কদর্যকীর্তিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি আপত্তিকর ঘটনায় মাদ্রাসা শিক্ষকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে যারপরনাই ব্যথিত দেশের সাধারণ মানুষ। মাদ্রাসা-শিক্ষকদের আমরা সম্মান করে বলি—হুজুর। বড়ই শ্রদ্ধার ব্যক্তি তিনি। সোনাগাজী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলার কদর্যকীর্তির পর মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জানি না—এই প্রশ্নগুলোর জবাব কার কাছে পাব। প্রশ্নগুলো উত্থাপন করার আগে নুসরাতের করুণ মৃত্যুর ঘটনার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি হেড লাইন তুলে ধরতে চাই। প্রথম আলো ঘটনার শিরোনাম দিয়েছে—‘শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেল মেয়েটি’। পাশেই আর একটি ছোট হেড লাইন ছাপা হয়েছে—‘চক্রের শক্তিতে বলিয়ান অধ্যক্ষ’। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে—‘পৈশাচিক আগুনে শেষ প্রতিবাদী মেয়েটি’। নুসরাতকে পোড়ানোর আগে ফেনীর মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের গোপন কক্ষে বৈঠক। সমকাল লিখেছে—‘বাঁচানো গেলো না নুসরাতকে’। ইত্তেফাকে শিরোনাম হয়েছে—‘সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন নুসরাত’। আগের দিন ছাদে গিয়ে রেকি করে ঘাতকরা। মানবজমিন শিরোনাম করেছে—‘সেই অধ্যক্ষের যত কেলেঙ্কারি। নুসরাতকে বাঁচানো গেলো না!’
বিভিন্ন পত্রিকায় শিরোনামের সূত্র ধরেই প্রশ্নগুলো করতে চাই। নুসরাতের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার পর জানা গেলো ঘাতক মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল কতটা অমানুষ ছিলেন। শুধু নুসরাতকেই তিনি যৌন হয়রানি করেননি। এর আগেও প্রতিষ্ঠানের একাধিক ছাত্রী প্রিন্সিপাল দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে। তারপরও তিনি কীভাবে কোনো ক্ষমতাবলে সোনাগাজীতে একজন মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল হিসেবে দাপট দেখাতেন? এখানেই আসে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া শিশুসাহিত্যিক খাইরুল বাবুই-এর একটি মন্তব্য তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছেন, মাদ্রাসায় হুজুর কর্তৃক ধর্ষণ হচ্ছে, তারা চুপ। বলাৎকার হচ্ছে, তারা চুপ। খুন হচ্ছে তারা চুপ। দেশে এত ধর্মীয় সংগঠন, এত এত ইসলাম বিশেষজ্ঞ। নানা সময়ে ইসলাম রক্ষার আন্দোলনে প্রচুর সোচ্চার তারা। মানুষ রক্ষায় রা নেই। তারা ধর্ম বোঝে, মানুষ বোঝে না। মানুষের ধর্ম কী? তারা কী জানে? তাদের কারও ঘরে কি নুসরাতরা জন্মায় না? তাদের মনে কি একটুও কাঁপন ওঠে না? ভেজে না চোখ?
কথায় আছে বজ্জাত হাতি খাদে পড়লে কেউ আর পাশে থাকে না। মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলা বজ্জাত হাতির মতোই খাদে পড়ে গেছেন। এবার দেখার বিষয় কে বা কার তার পাশে দাঁড়ায়? নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনার যথাযথ বিচার হয় কি না, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুসরাতের অকাল মৃত্যুর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মূলত প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক হস্তক্ষেপে নুসরাতকে সুচিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নুসরাতের চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নুসরাতকে বাঁচানো যায়নি।
পত্রিকায় পড়লাম মাদ্রাসা প্রিন্সিপালের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার পর তামান্না ও সাথী নামের দুই বান্ধবীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন নুসরাত। তাতে লেখাছিল ‘আমি লড়ব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।’ হ্যাঁ, নুসরাত শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তই লড়েছেন এবং লড়াইটা দিয়ে গেছেন দেশের সচেতন মানুষের কাঁধে। আশা করি, দেশের সচেতন সাধারণ মানুষই নুসরাতের লড়াইটা চালিয়ে যাবে। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো নুসরাতকে এভাবে জীবন দিতে না হয়।
নুসরাত না ফেরার দেশে অনেক ভালো থাকো তুমি! অনেক ভালো থেকো বোন। আমিন। ছুম্মা আমিন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক, আনন্দ আলো