Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিউজিল্যান্ডে আজান ও বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রিত পহেলা বৈশাখ


১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৮:৩৩

গত মাসে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দু’টি মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সারাবিশ্বকে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেনটন ট্যারান্ট যে অন্ধ উন্মাদনা নিয়ে জুমার নামাজের সময় মসজিদে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল, এই উগ্রবাদী হামলার বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেছে, ঘৃণা জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সন্ত্রাসবাদী হামলা রোধে তারা মুসলমানদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেনি কিংবা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়নি মসজিদ বা উপাসনালয়। গুলির ভয়ে মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়নি। বরং এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো নিউজিল্যান্ড মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের ঘোষণা অনুযায়ী, সব রেডিও-টেলিভিশনে একযোগে প্রচারিত হয়েছে জুমার নামাজের আজান। হামলার শিকার দু’টিসহ সে দেশের সব মসজিদে নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করেছেন মুসলমানরা। আর সেই সময় মসজিদ এলাকায় জড়ো হয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে মসজিদের বাইরে নামাজের স্থানে দুই মিনিট নীরবতা পালনের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন।

বিজ্ঞাপন

কট্টর উগ্রবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে এটাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর উপায়। ঘৃণা ও ক্রোধ নিয়ে ব্রেনটন ট্যারান্ট যাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছিল, তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পক্ষে একযোগে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছে সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতার কোনো জায়গা নেই। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ জাগরণের এই এক বিরাট উদাহরণ। সারাবিশ্বের সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ডবাসী এই বার্তাই দিয়েছে যে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার পথ উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে কট্টরপন্থাকে পরাজিত করতে হয়।

কিন্তু বেশ ক’বছর ধরেই বাংলাদেশ হাঁটছে ঠিক উল্টো পথে। জঙ্গি হামলার হুমকি মোকাবিলা করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রাখা হয়েছে। প্রদর্শনীর অনুমতি না পাওয়ায় প্রায় বন্ধের পথে ঐতিহ্যবাদী যাত্রাপালা। সীমিত হয়ে পড়েছে বাউল গানের আসর। গ্রামাঞ্চলে মেলা আয়োজনে সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, বাঙালির প্রধান উৎসব নববর্ষ উদযাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। পহেলা বৈশাখের উৎসব উদযাপন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখের সব রকম আয়োজন বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইকে ঘরে বন্দি করে রাখা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসবকে সীমিত করার অর্থ হলো, মৌলবাদকে মাঠ ছেড়ে দেওয়া। এ ধরনের পদক্ষেপ উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কাছে নির্জলা আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আবহমান কাল ধরে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হচ্ছে বৈশাখী মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। সেই ঐতিহ্যের ধারায় বহু বছর ধরে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয়ও মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে সর্বস্তরের মানুষ। এই উৎসব বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। কারণ, পহেলা বৈশাখ এ দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি—নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণে এই উৎসব বাঙালির ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিভাজিত সমাজে মানুষকে বাঁধছে একই সংস্কৃতির সুতায়।

এই উৎসবকে সময়ের নিয়ন্ত্রণে বেঁধে দেওয়ার অর্থ হলো, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া। উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তো এটাই চায়! তারা চায় অসাম্প্রদায়িক উৎসব, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিল্প-সাহিত্য নিয়ন্ত্রণ করে মুক্তবুদ্ধি চর্চার সব রকম পথ রুদ্ধ করতে। পহেলা বৈশাখে উৎসব নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে তাদের সেই চাওয়াই কি পূরণ করা হচ্ছে না?

প্রশ্ন তোলা হচ্ছে নিরাপত্তার! নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। নিয়ন্ত্রণ করা তাদের কাজ নয়। তাদের কাজ মানুষ যেন নির্বিঘ্নে উৎসব উদযাপন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে কখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে নয়, উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাত থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে বড় উপায় অন্ধকারের ওই শক্তিকে ভীত করে তোলা। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও কট্টরপন্থার কোনো স্থান হবে না।

সে জন্য প্রয়োজন মুক্তবুদ্ধির চর্চার অবাধ পরিবেশ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রসারের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার পথ উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে উগ্রবাদকে পরাজিত করতে হবে। নিরাপত্তার নামে সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করা হলে, মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে রাখলে, উগ্রবাদীরা উৎসাহিত হবে। মাঠ ফাঁকা পেয়ে তারা আরও বেশি শক্তি অর্জন করবে এবং একসময় ঘরের ভেতর আঘাত করবে, যা সমাজকে নিয়ে যাবে গভীর অন্ধকারে।

লেখক: রাজু আহমেদ, চিফ রিপোর্টার, জিটিভি

বিজ্ঞাপন

সিইসিসহ নতুন ৪ কমিশনারের শপথ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:১০

আরো

সম্পর্কিত খবর