সাম টাইম ইন এপ্রিল
২০ এপ্রিল ২০১৯ ২০:২৬
আমার প্রতিবেশী জুলিয়া (ছদ্মনাম) আমার মতোই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করে। জুলিয়ার তিন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। জুলিয়ার স্বামী স্টেফান ওকেংগে (ছদ্মনাম) কনসলট্যানসি করেন। শ্বেতাঙ্গ জুলিয়া কানাডিয়ান আর কৃষ্ণাঙ্গ স্টেফান নরওয়ের নাগরিক। তাদের সন্তানেরা প্রায় বাদামিরঙের। ছেলেরা একজন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, আরেকজন কানাডায়। মেয়েটির নাম আনমেরি, সে স্কুলে পড়ে। উগান্ডাতেই থাকে মা বাবার সঙ্গে। নেক্সট ডোর প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের মধ্যে গল্পস্বল্প, প্রফেশন নিয়ে আলোচনা, সাম্প্রতিক মুভি, রেস্তোরা থেকে শুরু করে তরকারির বাটি আদান-প্রদানও চলে। জুলিয়া প্রথম জীবনে অনেকদিন ভারতে কাটিয়েছে। সে উপমহাদেশের রীতিনীতি কালচারের সঙ্গে ভালোই পরিচিত। তার ঝাল খাওয়ার বহর দেখে আমিও চমকে যাই। জুলিয়া, আমি আর স্টেফান সমবয়সী।
স্টেফান দোহারা গড়নের, হিলহিলে লম্বা, বামদিকের কাঁধটা কেন যেন বেশ ঝুলে পড়া, আফ্রিকান পুরুষদের রীতি অনুযায়ী তার মাথা কামানো নয়। সাদা কালো ছোট্ট ছোট্ট কোঁকড়ানো চুল, সাদা কালো ফ্রেঞ্চ কাটে সুদর্শন স্টেফান। আমাদের গল্পের সময় উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে আনা বা খালি হয়ে যাওয়া বাটিতে বাদাম ঢেলে দেওয়া—এসবে তার কোনো বিরক্তি নেই। হাসিখুশি স্টেফানের চোখের তারায় সবসময় এক ধরনের শূন্যতা থাকে বলে আমার মনে হয়। প্রায়ই গল্পের ক্লাইম্যাক্সে হঠাৎ স্টেফান একদম আনমনা হয়ে যায়। জুলিয়া কখনো স্পর্শ করে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ভদ্রতার বেড়া ডিঙিয়ে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি না। কথা প্রসঙ্গে জানি, স্টেফান মূলত রুয়ান্ডার মানুষ। জেনোসাইডের পরে নরওয়েতে থিতু হয়েছে। কালেভদ্রে দুই-একটা কথা রুয়ান্ডা জেনোসাইড আর বাংলাদেশ জেনোসাইড নিয়ে হয়। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের জেনোসাইড নিয়ে অনেক তথ্য জানে স্টেফান। সে আমার পোশাকি নাম নয়, ডাক নামে সম্বোধন করে। আমাদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য একাত্মতা তৈরি হয়, তা অনুভব করতে পারি।
গত কিছুদিন আমি আর জুলিয়া দুজনেই অফিসের কাজে বাইরে থাকায় সান্ধ্যকালীন কফি-চানাচুর আড্ডা হয়ে ওঠেনি। এরমধ্যে একদিন স্টেফানকে সিঁড়িতে দেখেছিলাম, স্বাভাবিক আনন্দের প্রকাশ ছিল না তার, কেমন যেন আত্মমগ্ন। গেলো সপ্তাহে জুলিয়া এলো পাস্তার বাটি নিয়ে। একটুখানি বসে গল্প করে গেলো। স্টেফান কেমন আছে জানতে চাইলে, জুলিয়া একটু থমকে একটু কী জানি ভেবে জানাল, এপ্রিল এলেই স্টেফান একটু কেমন যেন হয়ে যায়, তার এই এলোমেলো ভাব এবার একটু বেশি। কুড়ি বছর আগে যখন তারা সংসার পাতে, তখন এতটা ছিল না, যত দিন যাচ্ছে তত স্টেফানের মধ্যেকার অস্থিরতা বাড়ছে। জেনোসাইড সারভাইভার হিসেবে সাইকোসোশ্যাল ট্রিটমেন্ট হয়েছে তার কিন্তু এখন আবার লাগবে মনে হচ্ছে।
পরশু সন্ধ্যায় হঠাৎ জুলিয়ার ফোন। সে মেয়েকে সেইলিং ক্লাব থেকে আনতে এন্টেবে গিয়েছে, ফিরতে আরও ঘণ্টা দুয়েকের বেশি লাগতে পারে। স্টেফান গত কাল থেকে অসুস্থ, ফোনও ধরছে না, কিছু মনে না করলে আর ব্যস্ত না থাকলে আমি স্টেফানের খবর নিয়ে যেন জুলিয়াকে জানাই। আমাদের বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটগুলোতে কোনো ডোরবেল নেই। দরজায় দাঁড়িয়ে খটখট করছি, প্রায় মিনিট সাতেক পরে স্টেফান দরজা খুললো। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছে এখন, ফোন ধরছে না বলে জুলিয়া চিন্তা করছে। সেসবের উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলো, আচ্ছা ১৯৭১ এ কী! তোমার পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল? তুমি বাঁচলে কীভাবে? আমার মাথার মধ্যে বিজলী চমকাল যেন, এপ্রিলেই তো রুয়ান্ডার জেনোসাইড শুরু হয়েছিল। ভদ্রতা ভুলে গিয়ে বললাম, স্টেফান, চলো বসে কথা বলি। সে গিয়ে সোফায় বসে। আজ আমিই কফি বানিয়ে আনি। জুলিয়াকে টেক্সট করি, আমি কি স্টেফানের সঙ্গে বসে কফি খেতে পারি, তার আপত্তি না থাকলে? জুলিয়ার দ্রুত জবাব, তোমাকে আমি অনুরোধই করতে চেয়েছিলাম, স্টেফানের সঙ্গে খানিক বসার জন্য।
স্টেফানের বাবা হুতু সম্প্রদায়ের আর মা ছিলেন টুটসি। স্টেফানরা সাত ভাই বোন ছিল , তাদের পরিবারে আরও মিশ্র বিয়ে ছিল। তার বড় ভাই বিয়ে করেছিল টুটসি মেয়েকে। এক বোনের বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল আরেক টুটসি ছেলের সঙ্গে। তারা ছিল মডারেট হুতু পরিবার। স্টেফানের বাবা প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানার কেবিনেটে ছিলেন। টুটসিদের সঙ্গে ক্ষমতা ভগাভাগি চুক্তির একজন অন্যতম সমর্থক ছিলেন। ১৯৯৪ সালে এপ্রিলের ছয় তারিখ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের প্লেনগুলো করে নামানোর পর পরই শুরু হয় টুটসি আর মডারেট হুতুনিধন পর্ব। এপ্রিলের সাত তারিখ বৃষ্টি ভেজা কনকনে ঠাণ্ডা ভোররাতে, স্টেফানদের বাড়িতে ইন্টারহামুয়ে (হুতু সমর্থক মিলিশিয়া) হামলা করে এবং স্টেফানের বাবা মা, পাঁচ ভাই বোন, বাড়িতে থাকা তার এক মামাসহ মোট নয়জনকে খুন করে। তার ছোট দুই বোনের অসহায় আর্ত গলা এখনো শুনতে পায় সে, কিশোরী বোন দুজনকে ছেঁচড়ে অন্য ঘরে নিতে নিতে হুতু মিলিশিয়ারা বলছিল, এই মেয়েদের গর্ভে তারা প্রকৃত হুতুর সন্তান জন্ম দেবে।
তেইশ বছর বয়সী নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র স্টেফান আর তার মেজ বোন, যার বিয়ে হয়েছিল উগান্ডার অ্যাম্বারারায়, মাত্র কদিন আগে সে মায়ের কাছে এসেছিল প্রথম সন্তান প্রসবের জন্য। এই দুই জন বাড়ির পেছনের ভুট্টা ক্ষেতে লুকিয়ে প্রাণে বাঁচেছিল। পরিবারের সঙ্গে লেন্ট পরব উদযাপন করার জন্য অসলো থেকে একসপ্তাহ আগে দেশে ফেরা স্টেফান তার আসন্ন প্রসবা বোনকে নিয়ে কিগালি থেকে পালাতে চেষ্টা করে। রাস্তায় রাস্তায় রোড ব্লক দিয়ে আইডেন্টিটি কার্ড চেক করে হুতু মিলিশিয়ারা টুটসিদের খুন করছিল। তারা কোনো বুলেট খরচ করতে চায় না। ম্যাসেটি দিয়ে কুপিয়ে মারছিল টুটসিদের। দুই বা তিনটি রোড ব্লক স্টেফানের হুতু আইডি কার্ড দিয়ে পার হয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু চতুর্থ রোড ব্লকে কেউ একজন স্টেফানকে চিনে ফেলে তার মন্ত্রী বাবার মডারেট হুতু পরিচয় আর টুটসি মায়ের সন্তান হিসাবে। বিশ্বাসঘাতক আরশোলার বাচ্চা বলে তারা প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টেফানের বোনের ওপরে। স্টেফান এখনো শুনতে পায় বোনের চিৎকার , ম্যাসেটি দিয়ে প্রথমে বোনের পেট কেটে বাচ্চা বের করে আনে তারা। তারপরে বোনকে কুপিয়ে টুকরো করে ছুড়ে ফেলে পাশের কাঁদামাটিতে। সেই রোড ব্লকে আরও অনেক টুটসিকে খুন করছিলো তারা যেন কাটাকুটি খেলছে। স্টেফান কেবল মনে করতে পারে ‘নোংরা আরশোলার বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারও হাতের ম্যাসেটি ঝিকিয়ে উঠলো। তার বাম কাঁধ শরীর থেকে আলগা হয়ে গেলো যেন, আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফেরে তার তখন রাত গভীর। ঝমঝমে বৃষ্টিতে সে শুয়ে আছে মানুষের রক্ত মাখা কাদা আর মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে। সব মৃতদেহকে হুতু মিলিশিয়ারা রাস্তার পাশের কাঁচা ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল। ম্যাসেটির আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে স্টেফান। তাকেও মৃত মনে করে ঠেলে গর্তে ফেলছে তারা। সেই অন্ধকার রাতে ম্যাসেটির কোপে ঝুলে যাওয়া কাটা কাঁধ নিয়ে জলার ভেতর ভুট্টা খেতের আড়ালে হাঁটতে শুরু করে স্টেফান। কোনো এক গ্রামে কেউ তাকে কিছু গাছ গাছড়া ব্যবহার করে চিকিৎসা দেয়। দিনের পর দিন না খেয়ে কংকালসার স্টেফান রাতের অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে (জায়ার) কঙ্গো পৌঁছায়। আরও কয়েকশ বা কয়েক হাজার মানুষ ছিল সেই কাফেলায়। জায়ারে সে ট্রিটমেন্ট পায় তার জখমি কাঁধের। মিশনারি ডাক্তাররা বলেছিল, স্রেফ যিশুর ইচ্ছায় সে গ্যাংগ্রিন থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু স্টেফান জানে কোনো ঈশ্বর তাকে বাঁচায়নি, কোনো ঈশ্বর আছে বলেও সে মনে করে না, দয়া করে যে তাকে বনজ গাছের ওষুধ দিয়েছিল সেটাই তাকে রক্ষা করেছে। এক মানুষ তাকে খুন করতে চেয়েছিল, আরেকজন মানুষ তাকে জীবন দিয়েছে, ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা এখানে নেই। স্টেফান মনে করে সেই এপ্রিলে ঈশ্বর কিগালিতে উপস্থিত ছিলেন না।
মিশনারিদের ফিল্ড হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কেবল অন্তঃসত্ত্বা বোনের আর্তনাদ কানে বাজতো স্টেফানের। বোনটি তাদের বলেছিল তাকে খুন না করতে। অনাগত সন্তানটিকে সে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়। জায়ারের রিফিউজি ক্যাম্পে স্টেফানের জীবন শঙ্কার মুখে পড়ে কয়েকবার। পল কাগামেরর নেতৃত্বে রুয়ান্ডান পেট্রিয়াট্রিক ফ্রন্ট দেশের দখল নিতে শুরু করলে মে মাসের শেষ থেকে হুতুরা রুয়ান্ডা ছেড়ে জায়ারে শরণার্থী হিসাবে চলে আসতে শুরু করে। স্টেফান আবারো পথে নামে এবার গন্তব্য উগান্ডা। মৃত বোনের স্বামী তাকে প্রাথমিক সহায়তা দিলেও সে নিজেই স্ত্রী ও অনাগত সন্তান হারিয়ে শোকার্ত। উগান্ডাতে আরেক মিশনারি অরফ্যানেজে আশ্রয় নেয় সে। সেখান থেকেই মিশনারিদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। জুলাইয়ের শেষে মোটামুটি চলার মতো সুস্থতা ফিরে পেয়ে স্টেফান চলে আসে কেনিয়ায়। কাগামে তখন রুয়ান্ডার নেতৃত্ব নিয়েছেন। নাইরোবিতে এসে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনিয়ান সহপাঠীর পরিবারে সাময়িক জায়গা পায় স্টেফান। সেখান থেকেই ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে স্টেফান আবার পাড়ি জমায় ইউরোপে।
কথা বলতে বলতে আমার হাত ধরে বলে, জানো, ‘আমার মেঝো বোনের নাম ছিল অ্যাঞ্জেলিনা, আমরা তাকে লিনা বলে ডাকতাম। আর আমার মায়ের নাম ছিল আনমেরি। আমি টিস্যু পেপার এগিয়ে দেই অশ্রু মোছার জন্য, মুঠির মধ্যে সেটা দলা পাকাতে পাকাতে সে বলতে থাকে।
‘জেনোসাইডে আমার নিজের পরিবারসহ মায়ের দিকের প্রায় আটান্ন জন সদস্যকে হারিয়েছি আমি। আমার নিজের পরিবারের আমিই একমাত্র জীবিত মানুষ। পড়া শেষ করে চাকরি করেছি বেশ কিছুদিন, ১৯৯৪ সালের পরে এই প্রথম বর্ষাকালে আমি পূর্ব আফ্রিকাতে থাকছি। এপ্রিল এলে আমার অস্থির লাগে, সেই রাতের প্রতিটা মুহূর্ত আমি সিনেমার মতো দেখতে পাই। এপ্রিলের বৃষ্টি আমাকে অপ্রকৃতস্থ করে তুলে। আমি জানি আমাকে আমার সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে যেতে হবে। আমি বর্ষাকালে পূর্ব আফ্রিকাতে থাকতে চাই না। এপ্রিলের বৃষ্টি আমার ক্ষতকে জাগিয়ে তুলে প্রবল ভাবে। আমার মা বাবা ভাই বোনের রিমেইন্স (মৃত দেহের অবশিষ্টাংশ) কিছু পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো পরে কবর দেওয়া হয় জেনোসাইড মেমোরিয়ালের গণকবরে। লিনার মৃতদেহের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার মা বাবাকে যারা খুন করেছিল তারা অনেকেই বহাল তবিয়তে আছে। আমার নিজের কাকা অনেক টুটসিকে খুন করেছে, আমার বাবার ডিরেক্ট আর এক্সটেন্ডেন্ড ফ্যামিলি অনেক খুন করেছে, খুনের সহায়তা করেছে। আমি তখনো পরিষ্কার জানতাম না এখনো জানি না, আমি কি হুতু খুনেদের অংশ নাকি টুটসিদের অংশ? আমি প্রতিবছর যাই কিগালি। আমাদের সন্তানেরাও গিয়েছে কিগালি কিন্তু আমার আর ভালো লাগে না, কিগালি একটি শূন্য শহর। রুয়ান্ডা ইজ এম্পটি। রুয়ান্ডা হ্যাজ ইটস বডি অনলি, দ্য হার্ট হ্যাড বিন কিলড, দ্য সোওল হ্যাড বিন ডেস্ট্রয়ড!’
বাইরে ঝমঝম এপ্রিলের বৃষ্টি শুরু হয়েছে, স্টেফান শূন্য চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আমি বসে থাকি চুপচাপ।
বি.দ্র. সাম টাইম ইন এপ্রিল নামে রুয়ান্ডা জেনোসাইডের ওপর নির্মিত সিনেমার নামটি ব্যাবহার করা হয়েছে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, কাম্পালা, উগান্ডা
ইমেইল : [email protected]
লেখকের আরও লেখা: বাংলাদেশ ১৯৭১: গণহত্যা না জেনোসাইড?