ছাত্রলীগের হামলা ন্যাক্কারজনক, আমরা মর্মাহত: বিবৃতিতে শিক্ষকরা
২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ১৯:০৪
সারাবাংলা ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ন্যাক্কারজনক বলে মন্তব্য করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ জন শিক্ষক। শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই ঘটনায় মর্মাহত- উল্লেখ করেন।
এতে শিক্ষকরা বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হল ছাত্র আন্দোলন, নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠনের দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন। সাম্প্রতিক সময়ে পহেলা বৈশাখে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব আন্দোলনের দাবিগুলোকে মানা হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি গড়ে ওঠা নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মত থাকতে পারে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির ন্যায্যতা এবং আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের অনেকের মতভিন্নতা আছে। তবে, শিক্ষার্থীরা যেকোনো দাবিতে উপাচার্যের কাছে যেতে পারেন। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, গত ১৫ জানুয়ারি এই দাবিতে যখন আন্দোলন চলছিলো, তখন সেই আন্দোলনের সমন্বয়কারীকে শিক্ষার্থীদের সামনে থেকেই ভিসি অফিসের ভেতরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হলেও প্রায় দুই দিন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী শিক্ষার্থীদের ঘিরে ধরে ছাত্রলীগ নামধারীরা, তাদের ওপর নানাভাবে যৌন হয়রানি করে এবং অশালীন গালিগালাজ করে, যার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলনে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের এই হামলা বিক্ষুব্ধ করে তোলে শিক্ষার্থীদের।
আমরা মনে করি, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ন্যায্য হলে তা মেনে নিয়ে কিংবা দাবির যৌক্তিকতা না থাকলে সেখানে শিক্ষার্থীদের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ও ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশাসন সে পথে না গিয়ে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে এরপর নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা ব্যানারে চিহ্নিত নিপীড়কদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেয়। যেহেতু নিপীড়নবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ বিচার না পাওয়ার উদাহরণ রয়েছে, সে কারণেই প্রশাসনের এই দাবি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের টালবাহানা শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
আমরা লক্ষ্য করলাম, বিচার চাইতে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে গেলেও প্রক্টর তাদের কথা না শুনে তার অফিসের সামনে কলাপসিবল গেটটিতে তালা লাগিয়ে দেন। প্রক্টরের এই আচরণ শিক্ষার্থীদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারই ফলশ্রুতিতে তালা ভাঙতে গিয়ে প্রক্টর অফিসের কলাপসিবল গেটটি ভেঙে ফেলে শিক্ষার্থীরা। এরপর প্রক্টর ঘটনাস্থলে আসেন এবং শিক্ষার্থীরা প্রক্টরকে সঙ্গে নিয়েই উপাচার্যের কাছে যান এবং আটচল্লিশ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানায়। পরবর্তীতে উল্টো ৫০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নামে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা দায়ের করে- যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌক্তিকভাবে এই ধারণা জন্মায় যে, নিপীড়নকারী ছাত্রলীগের নেতাদেরকে রক্ষা করতেই এই মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা দেখেছি, বছর দেড়েক আগে তৎকালীন উপাচার্যের গাড়িতে ছাত্রলীগ হামলা করে গাড়ির কাঁচ ভেঙে দিলেও তার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরে থাক, কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী যখন শিক্ষার্থীরা ভিসির কার্যালয় ঘেরাও করতে গেলো, তখন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে কথা না বলে একাধিক ফটকে তালা দিয়ে রাখলেন। অথচ উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও শিক্ষার্থীদের একটি প্রচলিত সাধারণ কর্মসূচি এবং সেটিকে প্রতিহত করতে বাইরের ফটকে তালা দিয়ে রাখার ঘটনা কাম্য নয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে উপাচার্যের কক্ষের সামনে অবস্থান নেয় এবং উপাচার্যকে অবরোধ করে রাখে। দীর্ঘসময় পর উপাচার্য অন্য আরেকটি সভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার কক্ষ ত্যাগ করতে চাইলে আন্দোলনকারীরা তার পথরোধ করে। উপাচার্যের বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি এবং ঘেরাও প্রত্যাহার করতে রাজি হয়নি। এই সময় আমরা দেখি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উপাচার্যকে ‘উদ্ধার’ করার নামে উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করে। দফায় দফায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে তাদের ওপর হামলা করা হয়। এই হামলায় আহত হয় ৫০ জন শিক্ষার্থী। নিপীড়নের বিচার চাইতে এসে আবারো নিপীড়নের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। অথচ হামলার ঘটনার পরের দিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বকে বহিষ্কারের দাবিতে ছাত্রলীগ ভিসি কার্যালয় ঘেরাও করলে তখন উপাচার্যের কার্যালয়ের বাইরের ফটক কিন্তু উন্মুক্তই ছিল! এতে পুনরায় প্রমাণিত হলো যে প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না।
আমরা মনে করি, সহিষ্ণুতার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব, শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের আধিপত্য, স্বায়ত্ত্বশাসনের মর্মবাণী বিস্মিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দলীয়করণ ও লেজুরবৃত্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায়, শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া উত্থাপনের কোনো প্লাটফর্ম পাচ্ছে না। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একক দখলদারিত্ব থাকায় যেকোনো প্রতিবাদকে দমন করা সহজ হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যহত হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রশাসন আইনি পন্থাব্যবহার না করে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করায় অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। এর ধারবাহিকতায় শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রশাসন যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না, সংবাদমাধ্যমে পাঠানো প্রেসবিজ্ঞপ্তিই তার প্রমাণ। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা এবং আন্দোলন দমাতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ও ভাবমূর্তিকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন ও হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাই। সেই সঙ্গে আমরা মনে করি, এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা এড়াতে, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ছাত্রদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেও আমরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। এর পাশাপাশি আমরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার্থে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেহাল করিম, এম এম আকাশ, গীতি আরা নাসরীন, কাবেরী গায়েন, ফাহমিদুল হক, তানজীম উদ্দিন খান, সামিনা লুৎফা, মোহাম্মদ আজম, মোশাহিদা সুলতানা, দেবাশীষ কুণ্ডু, সাজ্জাদ এইচ সিদ্দিকী, মুনাসির কামাল, অতনু রব্বানী, দীপ্তি দত্ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ, নাসিম আখতার হোসাইন, সৈয়দ নিজার আলম, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, আইনুন নাহার, রায়হান রাইন, মানস চৌধুরী, পারভীন জলি, হিমেল বরকত, খন্দকার হালিমা আখতার রিবন, রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, মোশরেফা অদিতি হক, মাহমুদুল হাসান সুমন, স্বাধীন সেন, সাঈদ ফেরদৌস, শরমিন্দ নিলোর্মি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভী চৌধুরী, তানভীর আহসান, ফারহানা সুস্মিতা, সৌম্য সরকার, কাজী অর্ক রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর রাজী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম দত্ত, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল, বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষক সুকান্ত বিশ্বাস, কাজী মশিউর রহমান, হাবিবুর রহমান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভুঁইয়া, মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. আবুল কাশেম, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গাজী এম এ জলিল।
সারাবাংলা/এটি