শবে বরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়
২১ এপ্রিল ২০১৯ ১৮:৫০
ঢাকা: আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটিকে হাদিসে ‘লাইলাতু নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বছরে যে পাঁচটি রাত ফজিলতপূর্ণ, এর অন্যতম এ রাত। রাতটি ‘শবে বরাত’ বা ‘লাইলাতুল বরাত’ নামে পরিচিত।
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর রাতটি পালিত হয়। মসজিদগুলো এ রাতে কানায় কানায় ভরে যায়। মুসল্লিরা এ রাতে ইবাদতে নিমগ্ন হন। আবহমান কাল থেকে আমরা পবিত্র আবহে, উৎসবের আমেজে শবে বরাত পালন করতে দেখে আসছি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বিতর্ক লক্ষ করা যায়। একপক্ষ মনে করে, এ রাতের বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। এ রাতে উৎসব করে নফল ইবাদতের কোনো মানে হয় না। বরং কেউ কেউ এটিকে ইসলামের নতুন আবিষ্কার বা বিদাত হিসেবে মনে করেন। বিশেষত যারা সহিহ হাদিসকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং মধ্যপ্রাচ্যকে অনুসরণ করেন, তারা শবে বরাত পালনের ঘোরবিরোধী।
তাদের বক্তব্য হলো, কোরআনের কোথাও এ রাতের কথা উল্লেখ নেই। সহিহ হাদিস সূত্রেও এ রাতের ফজিলতের কথা জানা যায়নি। যে হাদিস সূত্রে এ রাতকে ফজিলতপূর্ণ মনে করা হয়, সেই হাদিসের সূত্র খুবই দুর্বল বলেও তারা দাবি করেন।
আবার আমাদের সমাজে আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা শবে বরাতকে ‘মুক্তির মহা উপলক্ষ’ হিসেবে মনে করেন। সারাবছর ধর্মকর্মের কোনো ধার না ধারলেও এই রাতে পাক্বা মুসল্লি হয়ে যান, নফল ইবাদতে সারারাত কাটান। আবার এ রাতের পরও তাদের মধ্যে থাকে না ধর্মের কোনো ছাপ। এ রাতকে তারা ‘বরাত’ বা ভাগ্যের রাত হিসেবে জানেন। তাদের ধারণা, এ রাতে আল্লাহ ভাগ্য লেখেন। তাই এই রাতে
ইবাদত করলে সব গোনাহ থেকে মুক্তি মিলবে, খুলে যাবে ভাগ্যের দুয়ার। এ জন্য সারাবছর যাই করুক এ রাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন মুসলমানরা। অনেকে এই রাতের নাম দিয়েছেন ‘নামাজের রাত’। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলেও সেগুলো পালনে তাদের মধ্যে তেমন আন্তরিকতা চোখে পড়ে না। অথচ এ রাতের নফল ইবাদত নিয়ে শুরু হয় ব্যস্ততা।
মূলত আমাদের সমাজে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি উভয়টাই হচ্ছে। যারা বলছেন ইসলামে শবে বরাতের অস্তিত্ব নেই, তারা হাদিসের সূত্রের দুর্বলতার দোহাই দিচ্ছেন। অথচ হাদিসের মূলনীতি হলো, হাদিস দুর্বল হলেও তা ফজিলত সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য। দুর্বল হাদিস দিয়ে কোনো বিধান আরোপ করা যায় না। শবে বরাতে যারা ইবাদত করেন, তারা তা ফরজ-ওয়াজিব হিসেবে করেন না, নফল হিসেবেই করেন। যারা ইবাদত করেন, তারা তিরমিজি শরিফ ও ইবনে মাজাহ শরিফসহ বিভিন্ন কিতাবকে অনুসরণ করেন। এই রাতের ফজিলতসংক্রান্ত একাধিক হাদিস রয়েছে। সেগুলোর সূত্র দুর্বল হতে পারে, তা অস্বীকার কোনো সুযোগ নেই।
ফজিলতের ক্ষেত্রে হাদিসের সূত্রটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্য শবে বরাতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হঠকারিতা ও ইসলাম সম্পর্কে অযাচিত বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়। এ রাতের প্রতি মুসলমানদের যে আবেগ ও বিশ্বাস, তার মূল্য দেওয়া উচিত। অন্তত এই রাতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ কাজ করে। এই রাতের উসিলায় অনেকে সঠিক পথের দিশা লাভ করেন।
তবে, এ কথা সত্য, আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে অতিরিক্ত ও ইসলামবর্জিত যে মাতামাতি করা হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে আমলের গুরুত্ব যতটুকু, সেটা সেই পর্যায়েই রাখা উচিত। আমাদের সমাজের অবস্থা হলো, কেউ ফরজ নামাজ পড়ছে না, প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কোনো কাজ করছে, তাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয় না। অথচ কেউ শবে বরাতে মসজিদে গেলো না, নফল রোজা রাখলো না, তাকে অনেক খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়। এটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। এই রাতের ইবাদত ঐচ্ছিক বিষয়। কেউ পারলে করবে না পারলে করবে না। নফল কোনো ইবাদতকে বাধ্যবাধকতা মনে করা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। আর নফল ইবাদত হবে ব্যক্তিগতভাবে। আনুষ্ঠানিকতা ও হাঁকডাক করে নফল ইবাদতের কোনো মানে হয় না।
শবে বরাতকে কেন্দ্র করে কিছু অযাচিত কর্মকাণ্ডও আমাদের সমাজে ঘটে থাকে। এই রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি গর্হিত কাজ। এতে অপসংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ইবাদতেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। শবে বরাতের আতশবাজি ও অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
বছর কয়েক বছর আগে রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং মিরপুরে বিহারি ক্যাম্পে আগুন দিয়ে দশজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আতশবাজিসহ সবধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবছরই কিছু না কিছু ঘটে। এ ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা উচিত।
শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটির একটি প্রচলন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে। এর সঙ্গে ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই। আপনি চাইলে যেকোনো সময় হালুয়া-রুটি খেতে পারেন, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। কিন্তু এটা শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হলে সওয়াব তো হবেই না বরং গোনাহ হবে। কারণ ইসলাম যা সমর্থন করে না এমন কোনো কাজ সওয়াবের নিয়তে করা গোনাহ। সওয়াবের নামে নতুন কিছুর প্রচলন করাকে ইসলামের পরিভাষায় বিদাত ও রুসুমাত বলা হয়। এটা জঘন্য গোনাহের কাজ। অনেকে না বুঝেই এসব করে গোনাহের ভাগীদার হচ্ছেন।
আমাদের সমাজে বহুকাল ধরে শবে বরাত পালিত হয়ে আসছে। এটি ইসলামি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতকাল পরে এসে এখানে হাদিসের বিশুদ্ধতার মাত্রা খোঁজা অযাচিত বিতর্কের সৃষ্টি করবে। যারা এটাকে ফজিলতপূর্ণ মনে করবেন, তারা তাদের মতো করে পালন করবেন। তবে অবশ্যই শরিয়তের গণ্ডির ভেতরে থেকে করতে হবে। আর যারা মনে করছেন, এটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা উচিত নয়, তারা এটি পালন থেকে বিরত থাকতে পারেন। নফল এই ইবাদত কেউ না করলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে বিষয়টিকে ইস্যু করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা, অনৈক্য ও দলাদলি উসকে দেওয়া কোনো প্রকৃত মুসলমানের কাজ নয়। এটি জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কোরআনে ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ঘৃণা করা হয়েছে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
সারাবাংলা/একে