শ্রীলংকা- নতুন করে পেলো সংঘাত-সহিংসতা
২২ এপ্রিল ২০১৯ ১৫:০০
রক্তাক্ত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা। ইস্টার সানডের ধারাবাহিক বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কলম্বোর কোচিকাডের সেন্ট এন্থনি চার্চ, পশ্চিমের উপকূল শহর নেগোম্বোর সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চ, এবং পূর্বের বাত্তিকালোয়া শহরের জ়িওন চার্চে পরপর বিস্ফোরণ ঘটলো। তিনটি পাঁচতারা হোটেল— শাংগ্রি লা, দ্য সিনামন গ্র্যান্ড হোটেল (এটি আবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভনের কাছেই এবং এখানে আগেও বিস্ফোরণ ঘটেছে), এবং দ্য কিংসবেরি হোটেলে বিস্ফোরণ হয়েছে।
শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস পৃথিবীর জানা। প্রায় তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু দেখেছে দ্বীপ দেশটি। সেসময় তামিল টাইগারদের আত্মঘাতি বোমা হামলার সাথে পরিচিতই ছিল এর জনগণ। কিন্তু এবার চার্চ আর হোটেলে যে সিরিজ বোমা হামলা হলো, তা এক নতুন অবস্থার মুখোমুখি করেছে লংকানদের। ২০০৯-এ তামিল টাইগারদের বিরুদ্দে রাষ্ট্রের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সমাজে সহনশীলতা, উদারতার যে প্রচেষ্টা চলছিলো, তা যেন থমকে গেলো এমন হিংসাত্মক হামলায়।
কেউ এখনো দায়িত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দেয়নি। তবে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন হামলা করেছে ইসলামী জঙ্গি গ্রুপ এনটিজে – ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত। হামলাকারীরা লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেই পরিকল্পনা করে এসেছিল। খ্রীষ্টান সম্প্রদায় এবং হোটেলে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হত্যা করে তারা জানান দিয়েছে, পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই তারা আঘাত করতে সক্ষম।
যে কয়টি চার্চ আক্রান্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিরই ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এখানে দেশ বিদেশ থেকে নিয়তই পর্যটকরা আসছেন। প্রশ্ন হল এই দেশটি যে ২০০৯-এর পর থেকে বহুত্ববাদের চর্চা করছিল তা কি ভেঙ্গে যেতে বসেছে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উগ্রবাদী হামলায়?
শ্রীলংকা ঐতিহাসিকভাবে বহু ধর্মের মিলন স্থান। বৌদ্ধরা সবচেয়ে আদি। এরপর এসেছে হিন্দুরা। মুসলিমরা এসেছে মধ্যযুগে এই দ্বীপ দেশের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে। আর ১৬ শতকে ইউরোপীয় উপনিবেশের হাত ধরে আসে খ্রিষ্টানরা। নানা ধর্মের উপস্থিতি যে দেশটিতে সবসময় সম্প্রীতি বজায় রেখেছে তা বলা যাবেনা। কিন্তু দ্বীপ দেশে ধর্মীয় জিঘাংসার এমন রূপ, এমন আঘাত, এমন হত্যা আর ধংসলীলা আর কখনো দেখেনি কেউ।
ভারত মহাসাগরের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ শ্রীলংকা। কিন্তু সবক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ছিলনা দেশটি। আনেকদিন ধরেই সংখ্যালঘু মুসলিম সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ নজরদারিতে ছিলো দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর। এই ক্ষুদ্র জঙ্গি সংগঠনসমূহ সিরিয়ার আইএস মনোভাবাপন্ন এমন কথা উচ্চারিতও হচ্ছিলো এবং তারা যেকোন সময় খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করতে পারে, এমন আশংকাও করা হয়েছিলো। সেটাই সত্য প্রমাণিত হলো।
শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু তামিল ও সংখ্যাগরিষ্ট সিংহলিদের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে এলেও তাতে ভাটা পড়েনি। সিংহলিরা মূলত বৌদ্ধ। আর তামিলদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা রয়েছেন। কিন্তু বিবাদ যে আরও গভীরে প্রবেশ করেছে, সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছিল। একটি খ্রিস্টান গোষ্ঠীর দাবি, এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত বছর শ্রীলঙ্কার খ্রিষ্টানদের উপর হামলা ও হুমকির ৮৬টি ঘটনা ঘটেছিলো। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ঘটেছে ২৬টি ঘটনা। ২০১৮ সালে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের বক্তব্য ছিলো, শ্রীলঙ্কায় ধর্মাচরণের স্থানগুলি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হচ্ছে খ্রিষ্টানদের ওপর। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মাচরণের স্থানগুলি বন্ধ করে দেওয়ার অনবরত চেষ্টা চালাচ্ছেন। হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে মুসলিমদেরও। এমনকী মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার কারণে শ্রীলঙ্কার সরকারকে জরুরি অবস্থা জারি করতেও হয়েছিলো। কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনগুলির আবার দাবি, মুসলিমরা ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করছে। পবিত্র বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলিকে ধ্বংস করছে। এরই মধ্যে বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে এক বছর আগে নজরে চলে আসে এনটিজে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সম্প্রতি চার্চে হামলার চক্রান্ত শুরু করে কট্টরপন্থী এই মুসলিম সংগঠনটি।
বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। পোপ ফ্রান্সিস থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবাই সহানুভূতি জানাচ্ছেন লংকানদের। একটা কথা বলতেই হয়, ইসলামিক হামলা এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। আত্মঘাতি হামলার সাথে পরিচিতই ছিল এই জনপদ, তবে এবার নব পরিচয় ঘটলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে। শ্রীলংকা এই হামলায় মানুষসহ কত কি হারিয়েছে তার তালিকা বড় হতে থাকবে। তবে এক দশক পর আবার নতুন করে পেলো সংঘাত আর সহিংসতা। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা বুঝি আবার থমকে গেলো এই দ্বীপ দেশে।
* সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি
সারাবাংলা/এমএম