‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’
৩০ এপ্রিল ২০১৯ ২০:১৪
গণফোরামের দুই সাংসদ শপথ নিয়েছেন আগেই। বিএনপি সাংসদ জাহিদুর রহমান জাহিদের শপথের পর গুঞ্জন ছিল, বিএনপির বাকি এমপিদের সবাই বা কেউ কেউ ২৯ এপ্রিলের মধ্যেই শপথ নেবেন। ২৯ এপ্রিল সকাল থেকেই সাংবাদিকরা পাহারা বসান জাতীয় সংসদ ভবনে।
বিএনপির আরো চার এমপির শপথ নিতে যাওয়াটা তাই অস্বাভাবিক বা চমক জাগানো কিছু ছিল না। চমকটা আসে তখনই, যখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাংসদ হারুনুর রশিদ জানিয়ে দেন, তারা দলীয় সিদ্ধান্তে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই শপথ নিয়েছেন। হারুনুর রশিদের এই বক্তব্যের আগ পর্যন্ত এই বিষয়ে কারো কোনো ধারণাই ছিল না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও কমিটির সব সদস্য শপথের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু তারেক রহমান একাই সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দেন। দলের মহাসচিব, যিনি নিজেও একজন নির্বাচিত, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, বৈঠকে তারেক রহমানকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। আর পত্রিকায় লেখা হয়েছে, তারেক রহমান চেয়ে একক ক্ষমতা নিয়েছিলেন। কিন্তু তারেক রহমানের এককভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত বিএনপির শত শত নেতাকর্মী এবং লাখো সমর্থকের আবেগের সমান্তরাল নয়। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ছাড়া বিএনপির বাকি সবাই শপথের বিপক্ষে ছিলেন।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বরাবরই চেয়েছি, বিএনপি সংসদে আসুক। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন খুবই খারাপ হয়েছে; এটাই ধারণা। কিন্তু বিএনপি এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, আসলে চেষ্টাও করেনি। সেক্ষেত্রে তাদের সংসদে যাওয়া ছাড়া ভালো কোনো বিকল্প ছিল না। এমনিতেই এখন দেশে গণতান্ত্রিক স্পেস সীমিত। সংসদে গেলে তাও কিছুটা কথা বলার সুযোগ হয়। আর সংসদে গেলেই যে রাজপথে আন্দোলন করা যাবে না বা বাইরে কথা বলা যাবে না, তেমনও তো কোনো কথা নেই। তাই প্রবল স্পেস সঙ্কটের এই সময়ে সংসদে যাওয়া একটি খুবই ভালো, যৌক্তিক ও গঠনমূলক সিদ্ধান্ত। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো তা খুবই বাজে, অযৌক্তিক ও আত্মপ্রবঞ্চনামূলক। গত ২ এপ্রিল গণফোরাম সাংসদ মোকাব্বির খান শপথ নেয়ার দিন আমি ‘হারাধনের আটটি ছেলে, রইলো বাকি ছয়’ শিরোনামে লেখায় লিখেছিলাম, ‘হারাধনের ৮টি ছেলের মধ্যে দুটি ছেলেই সংসদে চলে যাচ্ছে। রইলো বাকি ছয়। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শপথ না নিলে আসন শূন্য হয়ে যাবে। আমার ধারণা, বিএনপির ৬ সংসদ সদস্যের সবাই শেষ পর্যন্ত শপথ নেবেন। ৬ জন না নিলেও অধিকাংশই দলীয়ভাবে কোনো একটি যুক্তি দিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে শপথ নিতে পারেন। তেমন না হলে বিএনপির ৬ সংসদ সদস্যের মধ্যেও ভাঙন ধরতে পারে।’ এই লেখা এবং সংসদে যাওয়ার পক্ষে বলায় গত চার মাসে আমাকে প্রচুর গালি শুনতে হয়েছে। যারা গালি দিয়েছেন, তারা কি এখন সরি বলবেন? আমাকে না বলেন, নিজেকে নিজে বলে নেবেন আশা করি। আমাকে নিয়মিত গালি শুনতে হয়। তাই গালি নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে বিএনপি নেতাদের জন্য, যারা এতদিন শপথের বিরুদ্ধে গলা ফাটালেন। বিশেষ করে খারাপ লাগছে বিএনপির আবাসিক নেতা রুহুল কবির রিজভির জন্য। এই নয়াপল্টন বিপ্লবী শপথের পরেও বলছেন, যারা শপথ নিয়েছে তাদের বহিস্কার করা হবে। প্রমাণিত হলো তিনি যে প্রতিদিন নয়াপল্টন থেকে শব্দ বোমা ছোড়েন, তাতে কোনো বারুদ থাকে না। তিনি আসলে কিছুই জানেন না। তবে শুধু রিজভি কেন, বিএনপির এই শপথ ক্যু’এর কথা কেউই জানতেন না।
বিএনপি নেতারা এতদিন যারা শপথ নিয়েছে- তাদের বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক বলে আসছিলেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দুদিন আগেও বলেছেন, তারা থুথুর সাগরে ভেসে যাবেন। এখন কে ভাসবেন থুথুর সাগরে? নিজেদের থুথু নিজেদেরই গেলার অবস্থা। বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, যারা শপথ নিয়েছেন, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। এখন তো বিএনপিরই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দশা। সুলতান মনসুর, মোকাব্বির আর জাহিদ যদি এখন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন, তাহলে?
শপথ নেয়ার অপরাধে জাহিদুরকে বহিস্কার করেছে বিএনপি। শোনা যাচ্ছে, তিনি দলের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসছেন। কিন্তু তিনি কেন ক্ষমা চাইবেন? বিএনপিরই বরং নাকে খত দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা উচিত। জাহিদুরের শপথের পর বলা হচ্ছিল, সরকার চাপ দিয়ে শপথ নিতে বাধ্য করছে। কিন্তু এবার তো সিদ্ধান্ত নিলেন তারেক রহমান। তাকে কে চাপ দিলো?
আমার শোনা সবচেয়ে অশ্লীল বাক্য হলো, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। চার মাস ধরে শপথের বিরুদ্ধে বলে, এখন এক বাক্যে সব জায়েজ করতে চাইছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু নিজেদের এতদিনের কথা শুনে কি বিএনপি নেতাদের একটুও লজ্জা লাগবে না? মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সংসদে কথা বলার সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ও রাজপথের সংগ্রামকে যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াকে আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। জাতীয় রাজনীতির এই সঙ্কটময় জটিল প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা, মুক্তি এবং গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমাদের দল সংসদে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ এটা তো আনুষ্ঠানিক কারণ। কিন্তু আসল কারণটা কেউই স্বীকার করছে না। মির্জা ফখরুল কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সবাই জানেন, সমঝোতা হয়েছে। শিগগিরই খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে কেউই অবাক হবেন না আশা করি। আমিও চাই ৭৩ বছর বয়সী অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্তি পান। কিন্তু সরকারের সাথে আপস করে আপসহীন নেত্রীর সম্ভাব্য মুক্তি আমার ভালো লাগবে না। তবুও খালেদা জিয়া মুক্তি পাক, তার যথাযথ চিকিৎসা হোক। রাজনীতি বেরিয়ে আসুক প্রতিহিংসার ধারা থেকে।
তবে বিএনপির শপথ নাটক এখনও শেষ হয়নি। সবাই শপথ নিলেও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল নেননি। তিনি বলছেন, তিনি সময় বাড়ানোরও আবেদন করেননি। তার মানে তিনি শপথ নিচ্ছেন না। দলীয় সিদ্ধান্ত কি মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়? নাকি তিনি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করছেন? নাকি তারেক রহমান দ্বিধাবিভক্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন? এই প্রশ্ন আসলে কাকে করবো? বিএনপির সিদ্ধান্ত কে জানে?
রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব বলে একটা কথা আছে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের উদাহরণ হিসেবে বিএনপির নাম উচ্চারিত হলে অবাক হবো না।
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক