ক্রিকেটার আর চিকিৎসক: আমাদের নায়কেরা
১ মে ২০১৯ ০০:৫৭
কিছু কিছু পেশা আছে যা পেশার উপজীব্যকে ছাড়িয়ে আবেগের পরিমণ্ডলে স্থান করে নেয়। তেমনি দু’টি পেশার মানুষ হচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার আর চিকিৎসক। ক্রিকেট আমাদের কাছে কেবল খেলা নয়, দেশপ্রেম আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একটি নাম। তেমনি শত বছর ধরে চিকিৎসকেরা এই প্রাচ্যে সবচেয়ে সম্মানীয় পেশাজীবী হিসেবে রয়েছেন শ্রদ্ধার স্থানে। সাহিত্যে, সিনেমায় এবং বাস্তবেও চিকিৎসকরা সম্মান পেয়ে আসছেন। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য তার নির্বাচনি এলাকার হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তার ভিডিও কথোপকথনটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে।
‘তিনি ঠিক করেছেন না বেঠিক করেছেন’, ‘তিনি তার সীমা কতটুকু ছাড়িয়েছেন’, ‘চিকিৎসকের অনুপস্থিতির একশ একটি কারণ’ ইত্যাদি নিয়ে সহস্র অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম। কিন্তু এই চাপানউতোরের খেলায় না হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎকর্ষ, না হচ্ছে কোনো যৌক্তিক বোধের প্রকাশ। আমার সতীর্থ বন্ধুবর চিকিৎসকদের ‘হেতুক’ বা ‘অহেতুক’ উত্তেজনা আমাদের আরও খেলো করে তুলছে। এই লেখার এতটুকু পড়েই বিপ্লবী বন্ধুরা ‘হারে রে রে’ করে উঠবেন এই বলে যে, ‘তুমি বেটা সুশীল, দলদাস; আমাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ’।
আবার যদি বলি, অধিনায়ক মাশরাফি আচরণে ‘যথেষ্ট সহনশীলতা’ দেখাতে পারেননি, যা অধিনায়কসুলভ তো নয়ই এবং তার জনপ্রতিনিধিসুলভ আচরণের সঙ্গেও ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’, তখন চিকিৎসকদের একহাত দেখে নেওয়া ফেসবুকযোদ্ধারা বলতে থাকবেন— ‘তুমি বেটা ডাক্তার হইছ আমাদের টাকায়। এখন মাশরাফির মতো মহানায়কের সমালোচনা করো। কসাই কোথাকার!’
কিন্তু এই ইস্যুটিকে যদি ‘জনপ্রতিনিধি বনাম সরকারী কর্মকর্তা’ বা ‘ক্রিকেটার বনাম চিকিৎসক’ দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে একটু যৌক্তিক অবস্থান থেকে দেখি, তাহলে উভয়ের জন্যই মঙ্গল। মাশরাফি কেবল একজন এমপি নন, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় দলের অধিনায়ক। মাশরাফির দেশপ্রেম নিয়ে, দেশের প্রতি তার আবেগ নিয়ে সন্দেহপ্রকাশ করতে পারেন, এমন মানুষ বাংলাদেশে কেউ নেই। এমনকি যারা আজ তার প্রতি বিষোদগার করছেন, বলুন তো খেলার মাঠে মাশরাফির একেকটি রানের জন্য আপনার দু’হাত কি একবারও আবেগে আর উত্তেজনায় জড়ো হয়নি? জাতীয় সংগীতের সঙ্গে মাশরাফির বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আপনার চোখের কোণে কি কখনো পানি টলটল করেনি? যদি না করে তবে বলব, আপনি দেশকে যথেষ্ট ভালোবাসেন না।
এখন নড়াইল সদর হাসপাতালে মাশরাফির আচরণকে কোনোভাবেই ডিফেন্ড করার কিছু নেই। ভিডিওতে দেখা যায়, এমপি মহোদয়ের সঙ্গে উপস্থিত কেউ কেউ (হতে পারেন তারা এলাকার সংবাদকর্মী বা সমাজসেবক) তাকে নানাভাবে উসকাচ্ছেন, প্ররোচিত করছেন। তিনি প্ররোচিত হয়ে যে আচরণ করেছেন, টেলিফোনে যে ভাষার ব্যবহার করেছেন, তা যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার জন্য অস্বস্তিকর, অবমাননাকর এবং আমাদের জাতীয় অধিনায়কের আচরণের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। সংবাদকর্মীদের উসকানিতে প্ররোচিত না হয়ে তিনি চিকিৎসককে বলতে পারতেন, ‘আপনার অননুমোদিত স্টেশন লিভের কারণে আমি এলাকার এমপি হিসেবে দারুণ লজ্জিত। আমি বোধহয় আপনাদের আস্থা-ভালোবাসা অর্জন করতে পারিনি। তাই আপনারা আপনাদের হাসপাতালের সমস্যা আমার কাছে বলেন না, বিনা অনুমতিতে স্টেশন লিভ করেন, জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হলেও রোববারে অপারেশন করতে চান। আর আমি আরও দুঃখ পাচ্ছি যে আপনারা আমাকে ভয় পান। এজন্য আমার সঙ্গে কথা না বলে টেলিফোনের অপর প্রান্তে চুপ করে আছেন।’
মাশরাফি এভাবে বললে সেই অত্যুৎসাহী সংবাদকর্মী আশকারা পেতেন না, টেলিফোনের অপর প্রান্তের চিকিৎসকও লজ্জায় মাথা নত করে ফেলতেন। আর মাশরাফি নিজেও নায়ক হিসেবে চিহ্নিত হতেন। কিন্তু বিধিবাম! অধিনায়ক পরিচালিত হলেন সাইডলাইনের খেলোয়াড় দ্বারা, পা ফেললেন সুযোগ সন্ধানীদের ফাঁদে, উত্তেজিত হয়ে গেলেন। এমন কিছু শব্দের ব্যবহার করলেন, যা সুযোগ সন্ধানীদের বগল বাজানোতে ঢোলের বাড়ি দিলো।
চিকিৎসকরাও হাতের কাছে পেয়ে গেলেন মোক্ষম ইস্যু। এর আগের বগুড়া, কক্সবাজার আর ফরিদপুরের অভিজ্ঞতাকে হৃদয়ে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফেসবুকে। মাশরাফির বেতন, খেলার মাঠে তার পারফরম্যান্স, এমনকি ব্যক্তিগত অশালীন গালাগালিতে পর্যবসিত হলো তাদের প্রতিবাদ। ‘কপালকুণ্ডলা’য় বঙ্কিমচন্দ্র অন্ধ রজনীর পক্ষে বলেন, ‘তোমার সুখ দুঃখে আমার সুখ দুঃখ পরিমিত হইতে পারে না।’ এই বাক্যটি ভুলে গিয়ে অযৌক্তিক তুলনায় রত হলেন চিকিৎসকেরা। ম্যাচ জেতার সঙ্গে চিকিৎসকের জীবন বাঁচানোর তুলনা আসলে চিকিৎসকদের সম্মানের জন্যই হানিকর। একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
এই মাশরাফিই কিন্তু একদিন বলেছিলেন, ‘আমি একজন ক্রিকেটার। কিন্তু আমি কি কারও জীবন বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কিন্তু দেশের সেরা ডাক্তারদের জন্য কেউ তালি দেয় না। তাদের প্রশংসা করুন। তারা আরও জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা।’ এতক্ষণে আমার চিকিৎসকবন্ধুরা নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমি মাশরাফির ‘পা চাটা দালাল’, ‘সরকারের পেইড রাইটার’। আপনারা ভেবে দেখুন, মাশরাফির অ্যাকশন আর তার প্রতিক্রিয়ায় চিকিৎসকদের বেসামাল আচরণে সমপর্যায়ের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু বগল বাজাচ্ছেন। ‘বোঝো এইবার, খাও ঠেলা’— অর্থাৎ মাশরাফি যে অপমান করেছেন, তা অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তার গায়েই লাগেনি।
এর ব্যাখা হচ্ছে দুটি— এক, অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা চিকিৎসকদের সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মনেই করেন না, কারণ এই ঘটনা একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের সঙ্গে হলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় নড়েচড়ে বসতেন। দুই, চিকিৎসকরা নিজেরাই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে নিজেদের উত্তরণ করাতে পারেননি। তাই এতদিন যারা চেয়েছিল যেনতেন প্রকারে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত করে নিজের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, তারা চুপ করে আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের অনেক বন্ধু-স্বজনেরা নেতিবাচকতার চর্চা করেই চলেছেন। কেবল ‘নাই নাই’ বলে নিজের হতাশাকে আমাদের মধ্যে সংক্রমিত করছেন। ফলে আমি-আপনি সবাই কখনো কখনো যুক্তি ভুলে নেতিবাচক মন্তব্য করে ফেলছি। এটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘কনফর্মিটি’। অর্থাৎ একটি বিষয়কে ভুল জেনেও সেটাকে সমর্থন করা। এমনটি নয় যে আমি এই কনফর্মিটির বাইরে, আমি-আপনি সবাই একই সমস্যায় ভুগছি। যুক্তি দিয়ে চিন্তা না করে স্রোতে গা ভাসাচ্ছি। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চিকিৎসাব্যবস্থা, সাধারণের মুখোমুখি হচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আমার-আপনার সবার চিন্তা আর আচরণের পরিবর্তন প্রয়োজন।
বন্ধুবর সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা ফেসবুকে লিখেছেন, “কেউ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেন না, সবাই কথা বলেন ডাক্তারদের হাসপাতালে না থাকা নিয়ে। তাদের ‘ফাইজলামি করেন’ বলা সহজ, কারণ ডাক্তারদের দিক থেকে কোনো প্রতিবাদের সম্ভাবনা নেই।” কথা সত্য, চিকিৎসকেরা এমন কোনো যৌক্তিক প্রতিবাদের উদাহারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিবাদ মানে ধর্মঘট না, কর্মবিরতি না, মানববন্ধন বা কালো ব্যাজ না, জ্বালাও-পোড়াও বা ফেসবুকে অশালীন ভাষার ব্যবহার না। প্রতিবাদ হচ্ছে প্রকৃষ্ট রূপে নিজের মতবাদ জানান দেওয়া।
আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন মানসিক রোগের চিকিৎসক। সেই পেশার জায়গা থেকে বলতে পারি, চিকিৎসাব্যবস্থার অনিয়ম দূর করতে গিয়ে সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা সবসময় বিপথগামী হয়েছেন। তারা বিষয়টিকে ব্যক্তিগত করে ফেলেছেন। মূল সমস্যার মূলোৎপাটন করার চেয়ে চিকিৎসকের পিণ্ডি চটকানোকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। আর অন্যদিকে চিকিৎসকেরাও প্রতিবাদের নামে ব্যক্তিগত হতাশা অশ্লীলভাবে প্রকাশ করেছেন, আর নেতারা পিঠ (আসলে পদ) বাঁচাতে রুটিন কর্মসূচি দিয়েছেন। যুক্তি দিয়ে প্রকৃষ্টভাবে নিজের মতবাদ (প্রতিবাদ) কোনো পক্ষই প্রকাশ করেননি। ফলে যুক্তিবোধের স্থান দখল করে নিয়েছে আবেগ।
আমার কথা অতি সামান্য— হিরোকে ভিলেন, আর ভিলেনকে হিরো বানানোর প্রয়োজন নেই। সিনেমার জগতে এখন সত্যিকারের ভিলেন কেউ নয়, হিরো আর আ্যান্টি-হিরো। হিরোর মত আ্যান্টি-হিরোও কিন্তু জনপ্রিয় চরিত্র হয়ে উঠতে পারে। আমরা চাই না, আমাদের অতি আবেগ আর ভালোবাসার, শ্রদ্ধা আর সম্মানের দু’টো পেশা মুখোমুখি দাঁড়াক। চিকিৎসা পেশার মতো সম্মানজনক পেশায় যারা নিয়োজিত, তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় আত্মসমালোচনাও যেন করতে পারেন। না হলে অধিক আত্মম্ভরিতা জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। দশটি ভালো কাজ কখনো একটি অন্যায়কে সিদ্ধ করে না। চক্ষুষ্মানের সঙ্গে যেমন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে তুলনা করা যায় না, তেমনি মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুর জীবন বাঁচানো, বৃক্ষমানবের হাত ঠিক করে দেওয়া আর পাঁচশ শয্যার হাসপাতালে আড়াই হাজার রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সঙ্গে অফিস টাইমে প্র্যাকটিস করা বা হাসপাতালে অনুপস্থিতির তুলনা বা যুক্তি কখনোই চলে না।
চারদিকে ‘নায়কের ভূমিকায় কেবলই পার্শ্বচরিত্র’। এই আকালের যুগে আমাদের যে ক’জন নায়ক রয়েছেন তাদের আচরণ হোক নায়কোচিত, দৃপ্ত, শাণিত আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মোসাহেব আর সস্তা জনপ্রিয়তা যেন নায়কের আচরণের নিয়ামক না হয়ে ওঠে। ‘ডাক্তার ধমকালে পাবলিক খায়’— এই মাইন্ডসেট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিত্বে কোনো ‘টিআরপি’ নেই, আছে কেবল জনকল্যাণ। কল্যাণকর সমাজব্যবস্থায় কেউ ভিলেন বা আ্যান্টি-হিরো না, সেখানে সবাই হিরো। আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা বড় কর্তা, সুশীল সমাজ আর জনপ্রতিনিধিরা যতদিন এই মাইন্ডসেটে আসতে না পারবেন, দেশের আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শ্রমিক, কৃষক, খেলোয়াড়সহ সকল পেশায় নিয়োজিত সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারবেন, ততদিন কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আর কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে চারপাশ ভরে যাবে মোসাহেব, চাটুকার, সুযোগসন্ধানী আর ভিলেনে; একে একে হারিয়ে যাবে আমাদের নায়কেরা। ডাক্তার, ক্রিকেটার, শিক্ষক বা সাংবাদিক— কোনো নায়ককেই আমরা হারাতে চাই না।
লেখক: চিকিৎসক
সারাবাংলা/টিআর