মা মানেই একজন সেরা সৃষ্টিশীল মানবী
১২ মে ২০১৯ ১৭:৩৪
বাতাসকে বার বার জাপটে ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা! বাতাস কি ধরা যায়? বাতাস ধরতে না পাওয়ায় কোথায় যেন হাহাকার! আমার রোজ জড়িয়ে ধরতে মন চায় কিন্তু আম্মা যে এখন কেবলি বাতাস। আমি অনুভব করি মাকে, মা আমাকে বাতাস হয়ে স্পর্শ করে।
মাতৃ বিয়োগ অপূরণীয়। এই শূন্যতায় ভয়ংকর অনুভবের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ হঠাৎ ডুঁকরে উঠে মন। আমার খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি আম্মা একবছর ধরে মাটিতে শুয়ে আছে। আম্মা অন্ধকারে, আর আমি আলো ভোগ করছি।
আমি লজ্জিত হই, রোজ পৃথিবীর আলো, হাওয়া, জমিনে বিনে পয়সায় দাঁড়িয়ে আছি কোন লোভে? কোন লাভের আশায়? অন্ধকারে মা শুয়ে আছে কী প্রচণ্ড গরম, শীত, ঝড় বৃষ্টির মাঝে। সেখানে কেমন আছে মা? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আম্মা একা একা কি করে? নিশ্চয়ই কাঁদে আমাদের জন্য; প্রার্থণা করে।
আম্মার কিভাবে সময় কাটছে? একটা বইও সাথে দেইনি কেউ। আম্মা সারাদিন বই পড়তে ভালোবাসতো। মিশরের রাজা-রানির মত অনেক দাস দাসী, জিনিসপত্রাদির প্রয়োজন ছিলনা, শুধু একটা বই আম্মার জন্য ছিল যথেষ্ট। হতে পারতো সেটা পবিত্র কুরআন। আম্মার কোরান পাঠের আওয়াজ কানে ভাসে, কত বছর শুনিনি। কুরআনের সুরে কত স্মৃতি। ছোটবেলায় রোজার দিনে আরবী পড়লে আমার ক্ষুধা লাগতো, আম্নাকে বললেই বকা খেতাম ঠিকই কিন্তু রোজায় ছোটমানুষ কষ্ট পাচ্ছি বলে বেশি কড়া কিছু বলতেন না। ক্ষুধা পেটে শুয়ে আম্মার কুরআন পাঠ শুনতাম। কখনো খুব কাছে শুয়ে পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পেটের ভাঁজগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে সেই সুরে ঘুমিয়ে পড়তাম।
আমার বুকের ভেতর চেপে আসে শ্বাস, এসব আর ভাবতে পারিনা। আমি হাঁতড়ে ফিরি স্মৃতি। কিচ্ছু ধরতে পারিনা। না শৈশব, না আম্মা, না স্মৃতি। কেউ নেই,কিছু নেই। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা হতভম্ব মানুষ। আম্মার শরীরেরই একটি টুকরো। মাকে মনে পড়লেই সেই শরীর কুকড়ে ছিঁড়ে আসে।
মাতাপিতার কেন মৃত্যু হবে? কোন সন্তান কি তার পিতা মাতার মৃত্যু ভাবতে পারে। তাঁরা নেই কী করে ভাবি? কোন মৃত মুখ আমাকে ভাবায় না। আমি আম্মার মৃত মুখ দেখিনি তাই আজও ভাবি আম্মা রংপুরে। রংপুরের পুরানো বাড়িটি জরাজীর্ণ মায়ায়ভরা শৈশবের স্মৃতি। প্রতিটি ইটে, শ্যাওলায় অতীত। বাড়ির যেখানেই তাকাই মনে হয় আম্মা হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছাদে,মাঠে, ঘরে, বাগানে সবখানে আম্মার মুখখানা। মনে হয় এই এটা বলছে, ওটা বলছে…, কত কত শব্দ আসছে কানে। কাঁকন, কাঁকন বলে ওই যে আম্মা ডাকছে। আমি দিব্যি শুনতে পাই। আম্মার ভালবাসার ডাক, কাকলী থেকে কাঁকন। এই নামে পৃথিবীতে শুধু আম্মাই আমাকে ডেকেছে। সেদিন স্বপ্নে দেখছি ওজু করে এসে আমার কাছে গামছা চাইছে, “কাঁকন গামছা দে,” আমি গামছাটা খুঁজেই পাচ্ছিনা। সব রোদে শুকানো কাপড়ের স্তুপ লণ্ডভণ্ড করে ফেলছি, কী একটা রুমাল দিয়ে বললাম ”এটা দিয়ে মুখ মুছেন। আম্মা আমার কাণ্ড দেখে বুঝতে পেরে বলে, অতো উতালা না হয়ে ভদ্রভাবে সোজা গিয়ে দেখা করে আসো। ছেলেটা ড্রয়িংরুমে বসে আছে।’ এইচ এস সি পড়ার সময় যেই আমি ঠিক সেই আমি লজ্জায় আম্মার চোখে তাকাতে পারিনা। আম্মারা মনের কথা সব বুঝে যায়। সন্তানের ভালো লাগা খারাপ লাগা কীভাবে মুখ পড়ে বলে দেয়।
ফলের স্বাদ তো বৃক্ষের জানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আগেকার একেকজন মা যেন বিশাল বৃক্ষদেবী। যেন ডাল পালা, শিকর, ফুলপাতা, ফলফলাদিতে অন্যন্য এক মানুষ। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সন্তান, নাতীপুতি, পাড়া প্রতিবেশী, সমাজের পরিচিত অপরিচিত সকলকেই ঘিরে তাঁর সুখ,দুঃখ, ভালবাসা, মমতা মিশানো দায়িত্বও বটে। নিজের বাবা মা, ভাইবোনের আত্মীয়স্বজন,স্বামীর ভাইবোন-তাদের আত্মীয়রা, সন্তানের শশুড়বাড়ির আত্মীয়, নাতি-নাতনির সম্মন্ধ সহ জগতের সকলকেই আত্মায় বেঁধে একজীবন পাড়ি দেয় নানান দায়িত্ব কর্তব্যে এই হাসিমুখী মা। আমরাও ছোটবেলায় দেখেছি আম্মা ভীষণ যত্নে কোন এক আগন্তুকে আপ্যায়ন করছে, অথচ আমরা তাকে চিনিই না। অনেক পাতায় পাতায় সে আত্মীয় কিংবা অন্যের পরিচিত। শশুড়বাড়ির অঞ্চলের একজন ভিখারির প্রতিও যেন মায়েরা দায়িত্বশীল। এই বাংলার সব অন্যন্য মায়েরা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই হারিয়ে যাচ্ছে, মা’র শিক্ষা। দেশীয় সংস্কৃতির আদবকায়দা,পারিবারিক ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, মানস গঠনের আদর্শ সহ একটি সুস্থ সমাজের হাতিয়ার তো একজন মা। প্রতিটি জীবনদানে মা’র অবদান ছাড়াও মা’র কন্ঠের প্রথম শব্দ শেখা থেকে হাঁটা চলা, ঘুম,খাওয়া,কাপড় পড়া,গোছল, মলত্যাগসহ কিনা মৌলিক শিক্ষা তিনি দেন। কাকপক্ষী, মানুষ, প্রাণী-প্রকৃতি পৃথিবী জানাতে মায়ের আনন্দে একেকটা শারিরিক ও মানসিক মানুষ বেড়ে ওঠে।
পৃথিবীতে যত প্রাণী তত মা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মা, মা মানেই একজন সেরা সৃষ্টিশীল মানবী। যতদিন মা বেঁচে থাকে অনেক অভিমান হয়। অবুঝের মত তাকে বুঝার ক্ষমতা হয়না। মা হারিয়ে গেলে বাতাস হয়ে যায়। মাকে বুঝতে পারি আর দেখতে পারিনা। ছুঁতে পারিনা।
আম্মা বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কেন এই অপূরনীয় শূন্যতা? কত কথা বলতে মন চায়। কত কিছু দিতে মন চায়। ক্ষমা চাইতে মন চায়। যা বলতে, করতে পারিনি তা করতে মন চায়। এক আকাশ ইচ্ছে হয় মনে। সময় সব কিছু শিখাবে এটাই নির্ধারিত হয়তো। আজ যে সৌভাগ্যবানদের মা কাছে আছেন কিন্তু আজো বুঝেননি তারাও একদিন এই অসহায়ত্ব স্বীকারোক্তি দিবেন আমি নিশ্চিত।
এতো একা কোনদিন লাগেনি, আম্মাকে হারিয়ে যা বুঝেছি। এতবার করে ডাকতো,” আয় রংপুর আয়। আয় দুইদিন ঘুড়ে যা।” যেতাম না। এখন আর কেউ ডাকে না। আমি হারিয়ে ফিরি বারবার, এখন সময় শুধু কাঁদবার। আম্মা ভাইবোনের জেল পালিয়ে, জামিনে কয়েকবার আমার কাছে এসেছে। আমার কাছে থাকতে আম্মা ভালোবাসতো এ সত্য স্বীকারে আম্মার কোন অধিকার ছিলনা। পরাধীন স্বীকারোক্তি আমাকে বলেছে বলেই আমি যন্ত্রণায় জ্বলে যাই। আমি আম্মার জন্য কিছু করতে পারিনি। আমার সকল বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেচনা ব্যর্থ। আমি অসফল একজন সন্তান। মা জন্য আমার যত দোয়াই করিনা কেন;আমার মন ভরে না। আমি অতৃপ্ত। মনে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে জীবনের যত শক্তি আছে সব দিয়ে বলি…. আম্মা!
আমার আম্মা আম্মা করে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে।
শাহনেওয়াজ কাকলী : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা
সারাবাংলা/এমএম