উৎসবে
৫ জুন ২০১৯ ০০:৪১
বলা হয় উৎসব একটি সমাজের সংস্কৃতির প্রতিফলন। সমাজের সব রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতার বৈশিষ্ট্য একে একে এসে যুক্ত হয় উৎসবে। আমাদের ধর্মীয় পরিকাঠামো কখনো ভেঙেছে, কখনো বদলেছে। এর অনেক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ আছে। তবে মৌলিকতার ঐক্যে আমরা বারবার সংঘবদ্ধ হয়েছি এক সত্তায়। বাঙালি তার নিজস্ব রীতিতে উৎসবকে পালন করেছে সবাই মিলে। পহেলা বৈশাখ— বাংলা বছরের প্রথম দিন, আমাদের নিজস্ব উৎসব, বাঙালির উৎসব। তবে ঈদ মুসলিম বিশ্বের সবার উৎসব হলেও আমাদের এক নিজস্বতা দাঁড়িয়েছে এই উৎসবেও। বহু যুগ ধরে ঈদও বাংলাদেশের সব মানুষের সর্বজনীন উৎসব।
প্রতিবছর দু’টি ঈদে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকে মানুষ প্রিয়জনদের সাথে ঈদ করতে কিভাবে ঢাকা ছাড়বে। এবার ঈদ যাত্রা ছিল অনেক স্বস্তিদায়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বহুল প্রতিক্ষিত দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু চালু হয়েছে ঈদের আগেই। উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন এটি জনগণের জন্য তার ঈদ উপহার। সেতু দু’টি চালুর ফলে এবারের ঈদে যানজট এড়িয়ে স্বস্তিতে বাড়িতে প্রিয়জনদের কাছে ঘরে ফিরতে পেরেছেন দক্ষিণের মানুষজন।
দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু দু’টি ছাড়াও ঈদ উপহার হিসেবে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কে কোনাবাড়ি ও চন্দ্রা ফ্লাইওভার, কালিয়াকৈর, দেওহাটা, মির্জাপুর ও ঘারিন্দা আন্ডারপাস এবং কড্ডা-১ সেতু ও বাইমাইল সেতুও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া এই ঈদকে ঘিরে। উৎসবের আতিশয্যে, রঙে, মজলিসে, দেদার খুশি-খুশি অমোঘ প্রবণতায় এবার ঈদ এসেছে জৈষ্ঠ্য মাসে— কিছুটা বৃষ্টি, কিছুটা গরম। এই সময়টায় উৎসবে আমেজ আরও বেশি। কারণ চলছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের এই মহা উৎসবের ঠিক আগে আগে ট্রাই ন্যাশন কাপ জিতে টাইগার মাশরাফি বাহিনী প্রত্যাশা বাড়িয়ে রেখেছে বাঙালির জন্য। তাই এবার ঈদের বাড়তি উন্মাদনা— ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ।
যারা বাড়ি যান, তারা ঈদ করেন অনেক বেশি আপনজনের সঙ্গে, বড় পরিসরে। আর আমরা যারা যাই না, তারা সারাবছর অপেক্ষা করি— এই সময়টায় ঢাকাকে কাছে পেতে। এই সময়টায় এই শহরের কোলাহলহীন আমেজে ডুব দিয়ে কাটানো আমার মতো অনেকের অভ্যাস। সড়কগুলো ফাঁকা পাওয়া, সেই সড়কে একটু ঘুরে আসা, বন্ধুদের সঙ্গে একটু বেশি আড্ডা। অর্থাৎ ঈদ মানেই, ঢাকায় থেকে ঢাকাকে একটু চেটে পুটে খাওয়া, যেটা সারা বছর সম্ভব হয় না।
এরই মধ্যে ক্রিকেটের উৎসব, ঈদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এবার গ্রামবাংলায় সদ্য মাঠ থেকে ধানের ছড়া তুলেছে যে কৃষক, তার স্বস্তি নিয়ে সংশয় আমাদের সবার। কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের মূল্য পায়নি। যার হৃদয়ে সামান্য ভালবাসা আছে, কৃষকের চোখের জল, অন্তরের ক্ষোভ কিছুটা হলেও ভাবিয়েছে। সবচেয়ে সৃজনশীল, সবচেয়ে কষ্ঠসহিষ্ণু কৃষকের চোখে জল সত্ত্বেও ঈদ হবে, উৎসব হবে।
শুরুতে বলছিলাম, উৎসব একটি সমাজের সংস্কৃতির প্রতিফলন। আর আমাদের সংস্কৃতি মানে অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়া, বেদনায় ব্যাথিত হওয়া। কিন্তু তুমুল নগরায়নে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ভোগবাদী। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছি নানা বিভাজনে। ফলে আমাদের সংস্কৃতিবোধও কমছে প্রতিনিয়ত। আর তাই হয়তো কৃষকের বেদনায় তামাশা করে তার জন্য ধান কাটতে নামে অনেকে সিনেমার নায়কের মতো। রুপালি পর্দার নায়কের মতো এই তরুণরা জীবনকে দেখলেও কৃষকের জীবন সোনালি ফসলের মাঠের মতো নয়। কৃষকের জীবনসংগ্রাম, আনন্দ, উৎসব তার মতো করেই হোক। তাকে দাম দিতে না পারি, কিন্তু তার কষ্ট নিয়ে লোক দেখানো কোনো আয়োজন করলে সে যে তার শিকড়টাকেই হারিয়ে ফেলবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বসভায় আলোচিত। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয় আজ গগনচুম্বী। ঈদ এখন অনেক বড়ভাবে উদযাপিত হয় দেশজুড়ে। তবে একথাও ঠিক যে এখন অনেক বড় আয়োজনে ঈদ উদযাপন হলেও বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষ আগেও যেমন বঞ্চিত ছিলেন ঈদের আনন্দ থেকে, এখনো বঞ্চিত থাকছেন প্রতিনিয়ত। কিছুদিন আগেও জাকাতের নামে বিত্তবানরা ঈদের আগে আগে ছুঁড়ে দিতেন পয়সা, কাপড়। আর সাধারণ নিরন্ন, বঞ্চিত মানুষ তা কুড়িয়ে নিতেন কাড়াকাড়ি করে। আর তা নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে কত মৃত্যু দেখেছে এই মাটি, তার শেষ নেই। এখনো অনেক স্থানে, অনেক জনপদে তার কোনো হেরফের হয়নি। এইসব ঘটনা কিন্তু আমাদের হতভাগ্য, বঞ্চিত, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের চেহারাই তুলে ধরে।
তবুও ঈদ আসে, আসবে সব মানুষের হয়ে। আমাদের সব উৎসবের একটাই বিশেষত্ব, আর তা হলো— অসাম্প্রদায়িকতা। রাজনৈতিক কারণে এই সম্প্রীতি নষ্ট করার প্রচেষ্টা থাকলেও উৎসব এলেই বোঝা যায়, আমরা এক অসাম্প্রদায়িক জাতি। এই নীতি আর আদর্শের বাতাবরণেই সব সময় আমরা ধর্মীয় সংঘাতের পরিবর্তে শান্তির পথে সব উৎসবকে উদযাপিত করতে চাই সবসময়।
সবাইকে সারাবাংলা পরিবারের পক্ষ থেকে ঈদ মুবারক।
লেখক: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি
সারাবাংলা/টিআর