বিশ্বজিৎ থেকে রিফাত: বিচারহীনতার দীর্ঘ কালো ছায়া
২৭ জুন ২০১৯ ১১:০৮
বরগুনার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও যখন ফেসবুকে ভাইরাল হয়, তখন আমি এটিএন নিউজের লাইভ টক শো’তে ছিলাম। এটিএন নিউজ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই লাশ, রক্ত ও বীভৎস ছবি দেখায় না। টক শো’র বিরতিতে নিউজরুম থেকে জানতে চাইলো, এ ঘটনা কীভাবে কাভার করবে। আমি বললাম, ভিডিওটি যেন ব্লার করে দেয়া হয়। পরে দ্রুত কয়েকটি অনলাইনে চোখ বোলালাম। ঘটনার যে বিবরণ পড়লাম, সাথে কয়েকটি স্টিল ছবি দেখলাম; তাতে ভিডিওটি দেখার সাহস করে উঠতে পারিনি।
ইতিমধ্যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ‘ভায়োলেন্ট কনটেন্ট’ হিসেবে ভিডিওটি সরিয়ে নিয়েছে। তবুও আমি জানি, একটি ছেলেকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিওটি দেখা থেকে আমি রেহাই পাবো না। বাংলাদেশের ২৬টি টিভি চ্যানেলে দিন-রাত দেখানো হবে, আমি এড়াতে পারবো না। রিফাতকে কোপানোর দৃশ্য না দেখলেও, ঘটনাটি শোনার পর থেকে আমার চোখে ভাসছে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎকে কোপানোর দৃশ্য, একদম সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত। বিশ্বজিৎ হত্যার সেই দৃশ্য আমাকে অনেকবার দেখতে হয়েছে। সেই দৃশ্য এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বিশ্বজিৎ হত্যার কথা মনে করে অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
বছর পঁচিশের রিফাত শরীফের হত্যার ভিডিও না দেখলেও বিভিন্ন নিউজের সাথে তার একটি ছবি ছাপা হয়েছে। এমন সুন্দর একটি যুবকের এমন নৃশংস মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। মাস দুয়েক আগে রিফাত শরীফ বরগুনা কলেজের ছাত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নিকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু নয়ন বন্ড নামে এক বখাটে মিন্নিকে নিজের সাবেক স্ত্রী দাবি করে তাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। বখাটে নয়ন ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে। এ নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে নয়নের বিরোধ হয়। স্ত্রীকে নয়নের উৎপাত থেকে বাঁচাতে রিফাত প্রতিদিন তাকে কলেজে পৌছে দিতেন এবং ফিরিয়ে নিতেন। বুধবার সকালেও মিন্নিকে কলেজে দিয়ে ফেরার সময় নয়ন বন্ড ও তার বন্ধুদের হামলার শিকার হন রিফাত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নয়ন ছাড়াও তার বন্ধু রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও রাব্বি আকন ফরাজীসহ কয়েকজন হামলায় অংশ নেয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নাকি নয়ন ও রিফাত ফরাজীকে রামদা দিয়ে কোপাতে দেখা গেছে।
স্বামীর ওপর হামলার খবর পেয়ে ছুটে আসেন মিন্নি। তিনি রিফাতকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মিন্নি নয়নকে ঠেকাতে গেলে ফরাজী কোপায়, ফরাজীকে ঠেকাতে গেলে নয়ন কোপায়। এভাবে অসহায় মিন্নির চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রিফাত। স্বামীকে বাঁচাতে না পারা মিন্নির অসহায়ত্ব আমাদের সবাইকে গ্রাস করেছে। রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ভিডিওতে অন্তত ১০ জন উৎসুক দর্শককেও নাকি দেখা গেছে। বিভিন্ন স্টিল ছবিতে সেই দর্শকদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি, সবাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখেছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, উপস্থিত দর্শকরা কি চেষ্টা করলে রিফাতকে বাঁচাতে পারতেন না? ফেসবুকে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক, যারা ফেসবুকে বিপ্লব করছেন, তারা কি ঘটনাস্থলে থাকলে প্রতিবাদ করতেন নাকি দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। আমি ঠিক জানি না। একা না হলেও সবাই মিলে ‘ধর ধর’ করে ধাওয়া দিলে হয়তো রিফাতকে বাঁচানো যেতো। ঘটনা যেহেতু বরগুনা কলেজের গেটে, কেউ একজন হাঁক দিলে, কলেজ থেকেও অনেক এগিয়ে আসতে পারতো। বিশ্বজিতের সময়ও আমি এই প্রশ্নটি তুলেছিলাম, যতজন ফটোগ্রাফার বিশ্বজিতকে কোপানোর ছবি তুলেছে, তারা মিলে চেষ্টা করলেও হয়তো ছেলেটিকে বাঁচানো যেতো। আমি ঠিক জানি না, এভাবেই কী আমরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো? আর কতদিন? আর কতদিন? কবে এই নির্বিকারত্বের, প্রতিবাদহীনতার অবসান ঘটবে?
তবে এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি, যতদিন আগের খুনের বিচার না হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হবে, যতদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলবে; ততদিন এই নৃশংসতাও চলবে। বুধবার রিফাত হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর ফেসবুকে অনেকেই হত্যাকারীদের ক্রসফায়ারের দাবি করেছেন। আমি প্রতিবাদ করেছি, আমি বরাবরই ক্রসফায়ার, গুমসহ সব ধরনের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের বিপক্ষে। আমি চাই বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর সাজা হোক। ক্রসফায়ার হলো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রমাণ। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে বলেই, শিক্ষিত মানুষ প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের দাবি তোলেন। আমি ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে হলেও আমার প্রতিবাদ আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসছে। ভেতর থেকে কেউ একজন আমাকে বলছে, তুই যে সুশীলগিরি করিস, ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করিস, তুই কি রিফাতের হত্যার বিচার করতে পারবি? তুই কি বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের বিচার করতে পেরেছিস? আমি চমকে উঠি, তাইতো ৭ বছর আগে প্রকাশ্য দিবালোকে, টিভি ক্যামেরার সামনে, অসংখ্য দর্শকের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হলো বিশ্বজিতকে। তার কী বিচার হয়েছে?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। ঠিক এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে আসামীদের মধ্যে মাত্র আটজন গ্রেপ্তার ছিল, বাকি ১৩ জনই পলাতক। কিন্তু হাইকোর্ট বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৮ জনের মধ্যে ২ জনকে বেকসুর খালাস, ৬ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং ২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। সেই সাথে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া দুই আসামীকেও খালাস দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা দুইজনের মধ্যে একজন গ্রেপ্তার আছে। আর ৩ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে।
তার মানে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ২১ আসামীর মধ্যে মাত্র ৪ জন এখন কারাগারে আছে। বাকি ১৭ জন হয় পলাতক, নয় বেকসুর খালাস। আপিল বিভাগের রিভিউ শেষে যদি রাষ্ট্রপতি ক্ষমা না করেন, তাহলে বিশ্বজিতকে হত্যার দায়ে একজনের ফাঁসি হতে পারে। তাও কবে কেউ জানে না। এই যদি হয় বিচারের হাল, তাহলে তো দেশে ক্রসফায়ারের সমর্থক বাড়বেই।
আমার প্রশ্ন, হাইকোর্টের যে বিচারপতি বিশ্বজিত হত্যা মামলায় আপিলের রায় দিলেন, তিনি কি অন্ধ? বিচার কক্ষে না হোক, তিনি কি বাসায় টিভিতে দেখেননি- কারা, কিভাবে, কয়জন মিলে বিশ্বজিতকে মেরেছে? এই মামলায় এত সাক্ষ্য প্রমাণের কী আছে? আদালত হত্যার ভিডিওটি প্লে করবে, আসামীদের চেহারার সাথে মেলাবে, ফাঁসি দেবে, কার্যকর করবে; শেষ।
যতদিন বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হবে, বিচার প্রক্রিয়ার অন্ধত্ব না ঘুচবে; ততদিন ক্রসফায়ারের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়বে। আমি অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছি, হয় ক্রসফায়ার বন্ধ হোক, নইলে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা। এক দেশে দুই রকম বিচার চলতে পারে না। তবে শেষ পর্যন্ত প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে চাই।
চাই বটে, কিন্তু আমি জানি, বিশ্বজিৎ হত্যার ন্যায়বিচার হয়নি বলেই রিফাত হত্যা ঘটেছে। রিফাত হতারও বিচার হবে না, পরে আরেকজন খুনি উৎসাহিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরুতে না পারলে; এ ধরনের কোপাকুপি চলবেই। কয়েকদিন আমরা ফেসবুকে বিপ্লব করবো, তারপর আবার ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাবো।
প্রভাষ আমিন : কলাম লেখক, সাংবাদিক। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
সারাবাংলা/পিএম