Monday 02 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদে


৮ জুলাই ২০১৯ ১৬:১০ | আপডেট: ৮ জুলাই ২০১৯ ১৬:২০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের কন্যা সন্তানের খুব শখ ছিল। কিন্তু আমাদের একমাত্র সন্তান ছেলে, আমাদের বেঁচে থাকার আনন্দ প্রসূন আমিন। কিন্তু কন্যা সন্তানের জন্য আমার তৃষ্ণাটা যায়নি। কয়েক বছর আগে ফেসবুকে কন্যা সন্তানের জন্য এই হাহাকারটা লিখেছিলাম। তারপর আমার বন্ধুদের অনেকেই তাদের কন্যাদের আমাকে দিতে চেয়েছেন। এভাবে দেশে, দেশের বাইরে আমার অন্তত ১৫ জন কন্যা আছে। তাদের কেউ আমাকে বাপজান ডাকে, কেউ বাপ্পি ডাকে, কেউ বাবা, কেউ আব্বু। মেয়ে না থাকার দুঃখ আমার ভুলিয়ে দিয়েছে এই মেয়েরা। আমি খারাপ বাবা, সবার খোঁজ রাখতে পারি না। কিন্তু মেয়েরা ঠিকই জন্মদিনে, বাবা দিবসে খোঁজ নেয়। এই মেয়েরা আমার জীবন কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে। এই মেয়েদের নিয়ে আমাদের আনন্দ যতটা, টেনশনও ততটাই। কাল রাতে বাসায় যেতেই মুক্তি বললো, পত্রিকায় কী কী সব খবর দেখছি। আমি তাকে একে একে কয়েকটা ঘটনা বললাম। পুরান ঢাকার বনগ্রাম রোডের ৭ বছরের শিশু সায়মার ধর্ষণ ও হত্যার কথা শোনার পর সে রীতিমত অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে শান্ত করতে সময় লাগলো। তার আবদার আমি যেন ফোন করে মেয়েদের খোঁজ নেই, যেন তাদের বাবা-মাকে সাবধান থাকতে বলি।
আমি মুক্তিকে বোঝাই, আমাদের কন্যারা তাদের বাবা-মার কাছে নিরাপদেই আছে। তাদের ফোন করে সাবধান থাকতে বলাটা, ‘মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি’র মত শোনাবে। মুক্তিকে স্বান্তনা দেই বটে, কিন্তু নিজের মনকেই বোঝাতে পারি না। আহারে, আমাদের কন্যারা নিরাপদে আছে তো? সায়মার ঘটনা শোনার পর কিছুই আর নিরাপদ মনে হয় না। সায়েমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। একদম আমাদের কন্যার বয়সী। অনুভব করার চেষ্টা করি, সায়েমার বাবা-মার বেদনা। ভাবি, আমাদের কষ্টই যদি এত কঠিন, বাবা-মা সইছেন কিভাবে?

বিজ্ঞাপন

৭ বছরের ফুটফুটে মেয়ে সায়মা। সবার আদরের। এই বয়সের ফুলের মত মেয়েদের দেখলে যে কেউ আদর করতে চাইবেন। কিন্তু সবার মন এক নয়। কার মনে যে ধর্ষক বাস করছে, কে জানে। সবার মন পড়ার মত কোনো স্ক্যানার তো নেই পৃথিবীতে। এই বয়সের একটা মেয়ে সারাক্ষণ হাসবে, খেলবে, বেড়াবে। গ্রামে এই বয়সের শিশুরা পাড়া মাথায় তুলে রাখে। শহরে গ্রাম নেই। এখানে একেকটি ভবন একেকটি গ্রাম। শিশুরা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ঘুরে বেড়ায়, বন্ধুদের সাথে খেলে। কিন্তু এটাও এখন আর নিরাপদ নয়। আপনার পাশেই হয়তো ওঁৎ পেতে আছে, আপনার সন্তানের ধর্ষক। সায়েমার ধর্ষক হারুন অর রশিদ তো একই ভবনের দুই তলা ওপরেই থাকতো। বিভুতিভূষণ বেঁচে থাকলে এখন আর পথের পাঁচালী লিখতে পারতেন না। দূর্গারা পারতো না পাড়া বেড়াতে। এখনকার বাংলাদেশে বিভূতিভূষণদের দূর্গাদের চঞ্চল শৈশব নয়, লিখতে হবে ভয়ঙ্কর শৈশবের গল্প।

ধর্ষণ প্রসঙ্গে আমি সবসময় বলতাম, মেয়েরা যেন সাহস করে রুখে দাড়ায়। ধর্ষকের ভয়ে মেয়েরা ঘরে বন্দী থাকবে, সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় চলে আসবে, নিজেদের আবৃত করে রাখকে বাড়তি পোশাকে; এ আমি চাইতাম না। আমি চাইতাম মেয়েরা, প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবে। নারীরা তাদের পছন্দের পোশাক পড়ে যতক্ষণ প্রয়োজন কাজ করবে। নারীরা ঘুরে বেড়াবে, বন্দী থাকবে ধর্ষকরা। বলতে খুব ভালো, কিন্তু কে যে ধর্ষক আপনি জানবেন কিভাবে। হয়তো আপনার পাশের টেবিলেই ধর্ষক বসে আছে। সুযোগের অভাবে সে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কর্মজীবী বা প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা না হয় সাবধান থাকবে, রুখে দাড়াবে। কিন্তু শিশুরা কী করবে? গত ৬ মাসে বাংলাদেশে ৪০০ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। শিশু মানে কিন্তু ৭ মাস থেকে ৭ বছর, ১২ বছর। সব বয়সের শিশু। ধর্ষকদের কাছে শিশু মানে শিশু নয়, একদলা মাংস। ব্লেড দিয়ে শিশুর যৌনাঙ্গ বড় করে ধর্ষণ করার মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও এই বাংলাদেশেই ঘটেছে। মামা, চাচা, খালুতো বটেই; এমনকি বাবার হাতেও সন্তান নিরাপদ নয়; এমন খবরও পত্রিকায় পড়েছি। তাই আপনার সন্তান কারো কাছেই নিরাপদ নয়। আনন্দময় শৈশব, বেড়ানো-খেলানোর শৈশবের কথা যা যা বলেছি; ভুলে যান। আপনার কন্যাকে চোখে চোখে রাখুন। ঘরের বাহির হতে দেবেন না। হলেও সারাক্ষণ সাথে থাকুন। আত্মীয় যত নিকটেরই হোক, কাউকে মেয়েকে গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে দেবেন না। কোনটা আদর, কোনটা যৌন নির্যাতন; আপনি বুঝবেন কিভাবে? সম্ভব হলে প্রতিদিন মেয়ের সাথে কথা বলুন। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কিনা খেয়াল রাখুন। সে হয়তো ভয়ে বা লজ্জায় আপনাকে বলবে না। তাকে আদর করে জেনে নিন, প্রতিদিন। কারো কাছে যেতে না চাইলে জোর করবেন না। একটি ছোট্ট ঘটনা, একটু অনাকাঙ্খিত ছোঁয়া আপনার কন্যার সারাজীবনের দুঃস্বপ্নের কারণ হতে পারে। আপনার একটু অসাবধানতা আপনার কন্যার জীবনও কেড়ে নিতে পারে। শুধু মুত্যু হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু ভাবুন ৭ বছরের শিশু সায়মা হয়তো হারুণ অর রশিদকে আঙ্কেল বলেই ডাকতো। মৃত্যুর আগে পৃথিবী সম্পর্কে কী ভয়ানক স্মৃতি নিয়ে গেল আমাদের এই ফুলটা, এই কন্যাটা।

সাবধানতা ছাড়া আমি আপাতত ধর্ষণের হাত থেকে শিশুদের বাঁচানোর আপাতত কোনো উপায় দেখছি না। কারণ সায়মার ধর্ষক হারুণ অর রশিদ তো ঘটনার আগ পর্যন্ত সবার চোখে ভালো মানুষই ছিল। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, অভিযোগ নেই। আপনি কিভাবে তাকে সন্দেহ করবেন। তাই সাবধান থাকতে হবে। আর ৬ মাসে ৪০০ শিশুর ধর্ষকদের দ্রুত বিচার বিচার করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। আগের ধর্ষনের কঠিন সাজা হতে দেখলেই কেবল নতুন করে একই অপরাধ করার আগে ভাববে। কিন্তু আমরা পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন ধর্ষণের খবর পড়ি। কিন্তু ধর্ষকদের শাস্তির খবর ততটা পাই না। তার মানে সব ধর্ষণ ঘটনার সাজা হয়না। অনেকেই হয়তো সাক্ষির অভাবে পার পেয়ে যায়। আর ধর্ষণের তো সাক্ষি থাকে না। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে হবু ধর্ষকরা ভয় পায়, সাবধান হয়।

আগে যখন সন্তান নিরাপদ থাকতো,. তখন বাবা-মা প্রার্থনা করতো, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। কিন্তু এখন আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ নয়। বেঁচে থাকলে পরে দুধভাত খাওয়ানো যাবে। আমার প্রার্থনা, আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদে।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
সারাবাংলা/পিএম

ধর্ষন প্রভাষ আমিন মত-দ্বিমত শিশু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর