Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সুযোগে’ বাঙ্গালি!


২১ জুলাই ২০১৯ ১২:২৮

বাঙ্গালিদের অর্থাৎ আমাদের আগে বলা হতো ‘হুজুগে বাঙালি’। হুজুগ উঠলে যা খুশি করে ফেলতে পারতাম আমরা। ভালো-মন্দ, আগ-পিছ এসব কিছু চিন্তা করতাম না। ‘হুজুগ’ বিশেষণের মধ্যে একটা ইতিবাচক দিকও ছিলো। ‘হুজুগ’ দিয়ে আমরা অনেক কিছু জয়ও করেছি অতীতে। সেসময় সেই হুজুগটা না উঠলে হয়তো অনেক বড় ঘটনা ঘটতোই না।

দিনে দিনে আমরা অনেক বদলে গেছি। হুজুগের দিন শেষ। এখন আমরা ‘সুযোগে’ বাঙ্গালি। সুযোগ বুঝে কাজ-কর্ম করি। ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, আগ-পিছ এসব বিচার-বিবেচনা করে আমরা পা বাড়াই। যাকে বলে পুরোপুরি সুযোগ সন্ধানী। আমরা সুযোগ বুঝে সাহসি হই। আমাদের বড় বড় নীতিকথাও সুযোগ নির্ভর। যে কারণে সমাজে সোচ্চার না হয়ে আমরা এখন অনেক বেশি সোচ্চার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কারণ সেখানে প্রচারের সুযোগ বেশি আর ঝুঁকি নেই বললেই চলে।

বিজ্ঞাপন

ফলে নয়ন বন্ডরা যখন প্রকাশ্য দিনের আলোয় আমাদের চোখের সামনে একজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে তখন আমরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি। প্রতিবাদ করি না। বাঁধা দেই না। কারণ তাদের হাতে অস্ত্র আছে। ঝুঁকি নেওয়ার মতো অতোটা বোকা আমরা নই।

আবার সেই আমরাই যখন দেখি একজন নিরস্ত্র মানুষের পিছু পিছু কেউ ধর ধর বলে ধাওয়া করছে, দ্রুতই সেই মিছিলে সামিল হয়ে যাই। এবং ধরতে পারলে তুমুল উৎসাহে মারধোরেও অংশ নেই। এবং একেবারে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করিনা।

ছেলেধরা অভিযোগে সম্প্রতি দুই সন্তানের এক জননীকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। আর এই বর্বরতা চলেছে খোদ রাজধানীতে। ভাবা যায়? একদল সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ আরেকজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে! এরা কি আদৌ সুস্থ!

বিজ্ঞাপন

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে অর্থাৎ গণপিটুনিতে যারা অংশ নিয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি জানতো না তারা মহিলাটিকে কেন মারছে। তারা পিছু ধাওয়া করেছে কারণ অন্য অনেকে ধাওয়া করছিলো। তারা মেরেছে কারণ অন্যরাও মারছিল। তারা মেরেছে কারণ যাকে মারছে সে নিরস্ত্র ছিল। তার দিক থেকে পাল্টা আঘাত আসার কোনও সম্ভাবনা ছিলনা। তারা মেরেছে কারণ এভাবে সবাই একযোগে কাউকে মারলে এমনকি মারতে মারতে মেরে ফেললেও তার কোনও বিচার হয়না। অতীতে এ ধরণের কাজের কোনও বিচার হয়নি। আমাদের দেশে এযাবত যত গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে অধিকাংশের বেলাতেই এই কথা সত্য। যারা মেরেছে তাদের একটা বড় অংশই জানে না যাকে মারলো তাকে কেন মারলো।

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, আইনের প্রতি, পুলিশের প্রতি মানুষের এক ধরণের অবিশ্বাস আর অনিহা তৈরি হওয়ার কারণে এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটছে।

তাদের কাছে তাহলে পাল্টা প্রশ্ন, বিষয়টা যদি পুরোপুরি সেরকমই হয় তাহলে বরগুনাতে কুপিয়ে মারার যে ঘটনা ঘটলো কিংবা বিশ্বজিৎকে মারার যে ঘটনা ঘটলো সেসময় মানুষ প্রতিবাদী হলো না কেন? কেন তারা বাঁধা দিলো না। সেসব ঘটনার সময়তো চারপাশে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমাদের প্রতিবাদ কি তবে শুধু নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের বেলায়!

আসলে কোনও যুক্তিতেই বিনা বিচারে একজন মানুষকে মেরে ফেলার মতো বর্বরতাকে, নৃশংসতাকে বৈধতা দেওয়া যায় না। অভিযোগ প্রমাণের আগে যেখানে কাউকে সাজাই দেয়া যায়না। সেখানে অভিযোগ তুলে রীতিমতো হত্যা! দিন দিন এ ধরণের হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, যে কোনও সময়ে যে কেউই কিন্তু এ ধরণের ঘটনার শিকার হতে পারে। কারণ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, বিরোধ থেকেও নিরীহ মানুষকে ছেলেধরা কিংবা ছিনতাইকারী সাজিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া বিরল কিছু না। কারণ ধর… ধর… বললেই এখানে কাজ হয়ে যায়। আর শুরুতেই বলেছি, দিনে দিনে আমরা ‘সুযোগে বাঙ্গালি’তে পরিণত হয়েছি। সুতরাং আমাদের দ্বারা কিছুই অসম্ভব না।

গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলার মানে হচ্ছে অনেকে মিলে সম্মিলিতভাবে একজনকে খুন করা। এই যে দুই সন্তানের মা যে মহিলাকে বিনা বিচারে ছেলেধরা বলে মেরে ফেলা হলো সেটি রীতিমতো খুন। যে খুনে যে বর্বরতায় তথাকথিত অনেক শিক্ষিত মানুষও হয়তো অংশ নিয়েছেন। কারণ ঘটনাটি ঘটেছে একটি স্কুল প্রাঙ্গণে। তারাও নিশ্চয়ই অংশ নিয়েছেন অথবা বাঁধা দেননি। তাহলে বিদ্যালয়ে কিসের আলো জ্বালাচ্ছি আমরা!

আচ্ছা, যে সন্তান দুটো আজ মা-হারা হলো তাদের কথা একটিবার ভাবুনতো। তারা হয়তো মায়ের অপেক্ষায় ছিলো। দুপুরে মা ঘরে ফিরে তাদের মুখে খাবার তুলে দেবে। তাদের বাবা থেকেও নেই। মা-ই ছিলো একমাত্র অবলম্বন। এই শিশু দুটির সামনে আমরা কি নজির রাখলাম!

এই খুনের বিচার হওয়া উচিত। অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যদি এর বিচার না হয় তাহলে আইনের প্রতি মানুষের যৎ সামান্য যে আস্থাটুকু আছে সেটাও বিলীন হয়ে যাবে। আর রাষ্ট্র যদি এর বিচার না করে তাহলে প্রকৃতিই একদিন এর বিচার করবে। কারণ প্রকৃতির চেয়ে বড় বিচারক আর নেই।

পলাশ মাহবুব : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। উপসম্পাদক, সারাবাংলা।

গণপিটুনি পলাশ মাহবুব বিনাবিচার বিশ্বজিৎ মত-দ্বিমত সুযোগে হত্যা হুজুগে

বিজ্ঞাপন

আদানি গ্রুপের নতুন সংকট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর