Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুখের ঘরে দুঃখের আগুন


২২ জুলাই ২০১৯ ১৩:৩৩

কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর, কী বিভৎস। একদল মানুষ তাকে পৈশাচিক ভঙ্গিতে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। শরীরে লাথি মারছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ মোবাইল ফোনে এই নৃশংস ঘটনার দৃশ্যধারণ করছে। অনেকে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সেলফিও তুলছে। আর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ আনন্দচিত্তে ঘটনা দেখছে। যেন মানুষ মানুষকে পিটুনি দিচ্ছে এই দৃশ্য দেখার মতো আর কোনো সেরা আনন্দ পৃথিবীতে নাই। আর তাই যারা সেলফি তুলছে তাদের চোখে-মুখেও যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। কোনোভাবেই এই মুহূর্তটাকে মিস করা যাবে না। আর যারা বীর দর্পে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে এক অসহায় নারীকে পেটাচ্ছে তাদের ভাবভঙ্গি এবং উদ্ধত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কাজটা তারা করছেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রশ্ন হলো কে বা কারা তাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়েছে? মানলাম ছেলেধরা সন্দেহে নয় বাস্তবে একেবারে হাতে নাতে এমন কোনো অপরাধী ধরা পড়লো। তাকে কী এভাবেই নিষ্ঠুর কায়দায় পিটিয়ে মেরে ফেলব? নাকি তাকে পুলিশে সোপর্দ করব? সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারও উপর নির্দয়, নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন করা কী আদৌ বীরত্বের মধ্যে পড়ে? এভাবে চলতে থাকলে আজ যারা ছেলে ধরা সন্দেহে একজন মাকে পিঠিয়ে মারল তাদেরই কেউ যে ভবিষ্যতে এমন সংকটের মধ্যে পড়বেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

বিজ্ঞাপন

ঘটনাটা কী হৃদয় বিদারক দেখুন। তাসলিমা আক্তার রেনু তার ছোট্ট মেয়ে তুবাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বাড্ডা এলাকার একটি স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার নিয়ম নাই। এটা হয়তো তাসলিমার জানা ছিল না। তাই সে বছরের মাঝামাঝি সময়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যায়। তাতেই নাকি সন্দেহ দেখা দেয় তাকে ঘিরে। ছেলেধরা সন্দেহে তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে একদল তরুণ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে বাইরে এনে বেদম প্রহার করতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে এলাকার শত শত মানুষ জড়ো হয়। এই ঘটনার একাধিক ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে শত শত উৎসুখ মানুষের মাঝে একজন অসহায় নারীকে লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে কয়েকজন তরুণ। মহিলাকে লাথিও মারছে তারা। পাশে দাঁড়িয়ে অনেকেই নিজেদের মোবাইল ফোনে এই দৃশ্য ধারন করছে। অন্যরা চারপাশে দাঁড়িয়ে স্রেফ মজা দেখছে।

এখন প্রশ্ন হলো এটা কি মজার কোনো দৃশ্য? মানুষ মানুষকে প্রকাশ্যে নির্দয়ভাবে পেটাবে, মেরে ফেলবে এই দৃশ্য দেখা কী খুবই আনন্দের? তাহলে আমাদের কি করা উচিৎ? আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত।
আমার এই কথা শুনে হয়তো অনেকে বলবেন, মুখে এরকম ভালো ভালো কথা বলা খুবই সহজ। বাস্তবে করে দেখান না রে ভাই। মানছি মুখে বলা সহজ। বাস্তবে করে দেখানো খুবই কঠিন। কিন্তু ঢাকার বাড্ডায় ছেলে ধরা সন্দেহে তাসলিমা আক্তার রেনুকে যে কায়দায় নির্দয়ভাবে মেয়ে ফেলা হলো তার প্রতিবাদ করা কী খুবই কঠিন ছিল? ধরা যাক তাসলিমা প্রকৃত অপরাধী। তাই বলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? তাকে যখন প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিল কয়েকজন তরুণ তখন উপস্থিত শত শত মানুষের মনে কী একবারও প্রশ্নটা জাগেনি যে আসল অপরাধীরও প্রকৃত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। শত শত মানুষের মাঝে একজনও কী সাহস করে বলতে পারতেন না যে, ভাই আপনারা থামেন। এইভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আসেন আমরা আগে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করি…।

প্রিয় পাঠক, ছেলেধরা সন্দেহে এই যে আমরা তাসলিমা আক্তার রেনুকে মেরে ফেললাম, ভবিষ্যতে যে আমার অথবা আপনার, আপনাদের কারও ক্ষেত্রে এমন ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কী? রাস্তা দিয়ে নিজের ছোট ছেলে অথবা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কারণে হয়তো তার মন খারাপ। শখের কোনো জিনিসের জন্য বায়না ধরেছিল ছেলে অথবা মেয়েটি। কিনে দিতে পারেননি। তাই সে রাস্তায় অনেক মানুষের সামনে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। আপনি তার কান্না থামাকে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাকে যতই বলেন কান্না থামা সে ততই জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। এক পর্যায়ে অভিমান করে সে হয়তো আপনার সাথে বাসায় যেতে চাইল না। আর এই মুহুর্তটাকেই কেউ কাজে লাগাতে চাইল। ‘ছেলেধরা’ এসেছে… আপনারা কে কোথায় আছেন… এই একটি চিৎকারই বুঝি যথেষ্ট। তখন কোথা থেকে যে পঙ্গপালের মতো সাধারন মানুষ ছুটে আসবে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এটা কি কোনো সভ্য দেশের চিত্র হতে পারে? চিলে কান নিয়ে গেছে এই চিৎকার শুনে আপনি তো আগে দেখবেন সত্যি সত্যি চিল আপনার অথবা অন্যকারও কান নিয়ে গেছে কিনা। নাকি না জেনেই আকাশের চিলকে ধরার জন্য দৌড় ঝাপ শুরু করে দেবেন?

আমরা যেন দিনে দিনে ঘটনা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ নয় ঘটনা দুর্ঘটনার দর্শক হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছি। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ মানুষকে খুন করে আমরা সমবেতভাবে ওই দৃশ্য দেখি, ভিডিও করি, সেলফি তুলি। কিন্তু ঘটনার প্রতিবাদ করি না। বরগুনার সেই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের ঘটনাই যদি বলি, কী দেখলাম? প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রীর সামনে একজন তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। দূরে দাঁড়িয়ে এই লোমহর্ষক খুনের ঘটনা শত শত মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতিবাদ করার মতো একজনও কি ছিলেন না? একজন যদি সাহস করে ‘ধর’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারতেন তাহলে বোধকরি বরগুনার ওই অসহায় তরুণকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। একইভাবে ঢাকার বাড্ডার ঘটনায় একজনও যদি প্রতিবাদের সুর তুলতে পারতেন তাহলে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হতো!

চোখের সামনে নৃশংস ঘটনা দেখার পরও কেন সাধারন মানুষ প্রতিবাদী হচ্ছে না? এব্যাপারে সাধারন কিছু মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম। তাদের অভিন্ন বক্তব্য এরকম, ভাই পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা কথাটা নিশ্চয়ই জানেন? চোখের সামনে সন্ত্রাসী ঘটনা দেখার পরও সাধারন মানুষ কেন এগিয়ে আসেনা তার অনেক কারণ আছে। প্রধান কারণ হলো স্বাক্ষীর নিরাপত্তা। ধরেন আমি একটা ঘটনা দেখেছি। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো ঘটনার স্বাক্ষী কে? চলেন থানায় যেতে হবে। থানায় গেলাম। তারপর যে কী যন্ত্রনা শুরু হবে তা ভাবলে ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে আপনার। আসামী পক্ষ জীবননাশের হুমকি দিতে থাকবে। আদালতে হাজিরা দিতে গিয়া আপনার ব্যক্তিগত জীবন ‘ফানা ফানা’ হয়ে যাবে। স্বাক্ষী দিতে গিয়া এত ঝামেলা কে নিবে ভাই?

তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াল? স্বাক্ষী দিতে গিয়ে অহেতুক ঝামেলায় আমরা কেউই জড়াতে রাজি নই। কিন্তু আজ না হোক কাল যদি এ ধরনের কোন দুর্ঘটনায় আপনি পড়েন তাহলে পরিত্রাণ পাবেন কীভাবে? কাজেই আসুন সকল সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হই। অন্যের ঘরে আগুন দেখে ভাববেন না আপনি নিরাপদ। একদিন আপনার সুখের ঘরেও দুঃখের এই আগুন লাগতে পারে। কাজেই সময় থাকতে সাবধান হন।

রেজানুর রহমান: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
সারাবাংলা/পিএম

গণপিটুনি মত-দ্বিমত মৃত্যু রেজানুর রহমান

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর