Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাস্থ্যমন্ত্রী না ফিরলে কী হয়?


৩১ জুলাই ২০১৯ ১৭:৫০

একই সঙ্গে দুটি খবর দেখে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঈদুল আযহাসহ সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এটা এক ধরনের স্বস্তির খবর। ডেঙ্গু দেশে এক ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তাই রেকর্ড ছাড়ানো ডেঙ্গু পরিস্থতি সামাল দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদের ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে অফিস করছেন, এই ভাবনাটাই স্বস্তিদায়ক।

বিজ্ঞাপন

তবে আরেকটি খবর দারুণ অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবার ছুটি বাতিল হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিখোঁজ হয়ে গেছেন। এইরকম দুর্যোগ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে না দেখে খোঁজ নিতে গেলে তার জনসংযোগ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে মন্ত্রী মানিকগঞ্জে তার এলাকায় গেছেন। দুদিন পর অফিস করবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জন্য নিজের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়াটা অনেক অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি এলাকাতেও যাননি। মন্ত্রিসভার এমন একজন সিনিয়র সদস্যের প্রায় নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা উদ্বেগেরই বটে। পরে আরও অনুসন্ধান করে সাংবাদিকরা নিশ্চিত হয়েছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত শনিবার (২৭ জুলাই) স্ব-পরিবারে মালয়েশিয়া গেছেন। এই সফরের সাথে সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা ডেঙ্গুর কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সফর। হঠাৎ মধ্যরাতে বিবেক জেগে না উঠলে তাঁর ফেরার কথা ৪ আগস্ট। সফরটা মূলত নয়দিনের। এই খবরটি প্রথমে আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। দেখে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি ট্রল বা ফান। পরে গণমাধ্যমে দেখার পর কষ্ট হলেও বিশ্বাস করেছি। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে লুকোচুরি’। পড়ার পর আমার গাইতে ইচ্ছা করছিল, ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প, তারপর হাতছানি অল্প’।

বিজ্ঞাপন

হাতছানি অল্প হোক আর বেশি, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল কাটানোর পর আমি কী বলব, কী লিখব; ভেবে পাচ্ছি না। এই অবস্থাকেই বোধহয় বলে- কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরে ভাবতে বসলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা স্বস্তির না অস্বস্তির, আনন্দের না বেদনার, শঙ্কার না সম্ভাবনার। অনেক হিসেব কষে দেখলাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আটদিনের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে ভালো করেছেন। প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের অন্তত একটি পরিবার ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকল, এটাই বা কম কি। ডেঙ্গু যখন ৬২ জেলায় ছড়িয়ে গেছে, তখন একটি পরিবারকে ঝুঁকির বাইরে রাখতে পারাটা অবশ্যই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করবে। আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেন তার টিকিট চেঞ্জ করে নেন। ডেঙ্গু মৌসুম পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগে যেন তারা দেশে না ফেরেন। জেনেশুনে পরিবারের সবাইকে এই ঝুঁকিতে ফেলার কোনো মানেই হয় না। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো অবগত- এবারের এডিস মশার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। অর্থমন্ত্রী, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, সিভিল সার্জন, ডাক্তার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবের স্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; কাউকেই ছাড়ে না। ভিআইপি বললে ফেরি থেমে যায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক এডিস মশা কাউকেই ভয় পায় না। সবচেয়ে ভালো হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানিয়ে সেখানে থেকে গেলে। তিনি মাসে একবার এসে সই দিয়ে গেলেই হবে। কারণ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর থাকা না থাকায় কিছুই যায় আসে না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবার ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত কিন্তু মন্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পরে নেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্বাবধানে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক লড়াই চলছে। মাঝখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকলে বরং কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো। তবে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে বিনোদন ছুটিতে আছেন; আর সাবেক দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও আ ফ ম রুহুল হক হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন; এটা দেখতে কারও কারও কাছে খারাপ লাগতে পারে। সাবেক দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি ইচ্ছা করে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বিপাকে ফেলার জন্য মাঠে নেমেছেন? এই চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি!

স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন দেশে ছিলেন, তখন ডেঙ্গু দমনে কী করেছেন? অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম, তিনি ঢাকা মেডিকেলে ডেঙ্গু নিয়ে এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে অংশ নিয়ে ক্ল্যাসিক সব বক্তব্য দিয়েছেন। সপরিবারে দেশ ছাড়ার দুদিন আগে ২৫ জুলাই ঢামেকের এক সেমিনারে ডেঙ্গু নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ওইদিন তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের জানতে হবে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ জন মারা যায়। সাপের কামড়ে মারা যায় ১০ জন করে এবং হার্ট অ্যাটাকেও শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে খবর তো আমরা রাখি না। গত কয়েক মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছে মাত্র আটজন। আমরা চাই না, এ নিয়ে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি হোক। আতঙ্ক সৃষ্টি করে এমন কিছু প্রকাশ করবেন না। ডেঙ্গু এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দোষ দিয়ে লাভ নেই। ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে, এটা নিশ্চিত করেই তিনি দেশ ছেড়েছেন। ডেঙ্গুর সাথে সড়ক দুর্ঘটনা, সাপের কামড়, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর তুলনা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেকে আধুনিক আপেক্ষিকতাবাদের জনক হিসেবে প্রমাণ করেছেন। সেই সেমিনারেই তিনি রোহিঙ্গাদের প্রজনন ক্ষমতার সাথে এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতার তুলনা করে তুলনাতত্ত্বে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। জাহিদ মালেক স্বীকার করেছেন, ‘আমরা মশার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। যেভাবে রোহিঙ্গা বাড়ছে, আমাদের দেশে সেভাবে মশার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। প্রজনন কম হলে এডিস মশা কম হতো। মানুষ মশার কামড় কম খেত। ডেঙ্গু কম হতো।’

জাহিদ মালেকের এই এডিস মশার প্রজনন তত্ত্ব বাংলাদেশের রাজনীতির উদ্ধৃতি অভিধানকে সমৃদ্ধ করবে। এরশাদের আমলে শাহ মোয়াজ্জেমের ‘দুই নারীর মিলনে কিছুই উৎপন্ন হয় না’, বিএনপি আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়া গেছে’ বা আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীরের ‘বিএনপি-জামাতের নাড়াচাড়ায় রানা প্লাজা ধস’-এর পাশে অবশ্যই ঠাঁই পাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এই প্রজনন তত্ত্ব।

ইতিহাসে এ অঞ্চলের দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীকে এখনও মানুষ মনে রেখেছে ঢাকাকে মশামুক্ত করার জন্য। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময়ও অনেকে তাকে স্মরণ করছেন। আর জাহিদ মালেককে মনে রাখবে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য। এমন একজন ক্ষণজন্মা, বিনোদনদায়ী স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আমরা হারাতে চাই না। প্লিজ, আপনারা তাকে খারাপ বলবেন না। ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেই তিনি বিশ্রামে গেছেন। সাংবাদিকরা অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। এখন ডেঙ্গুর নামে যা হচ্ছে, যে মৃত্যুর খবর আসছে; তার পুরোটাই গুজব। সাংবাদিকরা সড়ক দুর্ঘটনা, সাপের কামড়, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর খবর ফেলে ডেঙ্গুর পেছনে লেগেছেন। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, গুজবে কান দেবেন না। আপনি ও আপনার পরিবার নিরাপদে থাকুন।

* এই লেখা শেষ করার পর জানলাম, নিন্দুকদের অত্যাচারে সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার রাতেই দেশে ফিরছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আমরা এই বাঙালি জাতিটাই খারাপ। কারও ভালো দেখতে পারি না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে না ফিরলে কী হয়?

প্রভাষ আমিন : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
[email protected]

ছুটি বাতিল প্রভাষ আমিন ভ্রমণ স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর