কাশ্মীরের নতুন রাজনৈতিক যাত্রা, কেমন হবে?
৬ আগস্ট ২০১৯ ১৩:১৩
এই সিদ্ধান্ত কি সাহসী এবং সুদূরপ্রসারী? নাকি উপত্যকাটি হবে এই অঞ্চলের গাজা? ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ আইনি অধিকার ও মর্যাদা গত সোমবার বিলুপ্ত হয়ে গেল। একইসঙ্গে খারিজ হল ৩৫এ ধারাও। এখানেই শেষ নয়, ভারতের অঙ্গরাজ্যের পরিচিতি বিলুপ্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হল। লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীর এবার থেকে দুটি নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হবে। লাদাখের কোনও বিধানসভা থাকবে না। সরাসরি কেন্দ্রশাসিত। আর জম্মু-কাশ্মীরের জন্য থাকবে দিল্লি ধাঁচে বিধানসভা। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর পূর্ণ রাজ্য আর রইল না। থাকলনা জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ‘স্পেশাল স্ট্যাটাস’ বা বিশেষ মর্যাদা। অর্থাৎ এখন থেকে অন্য ভারতবাসী কাশ্মীরে জমি বা সম্পত্তি ক্রয়, শিল্পে বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরির আবেদন করতে পারবে।
মুসলিম প্রধান রাজ্যটিতে হিন্দু অভিজাতদের জন্য ১৯২৭ সালে কাশ্মীরের সে সময়ের শাসক হরি সিং এই বিশেষ মর্যাদার বিধান চালু করেছিলেন পরবর্তীতে মুসলিমরা এই মর্যাদা উপভোগ করে আসছে। এই বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবেশী পাঞ্জাব থেকে যেন কেউ সেখানে গিয়ে জমি ও ব্যবসা-বাণিজ্য দখলে নিতে না পারে।
উপত্যকার দুই নেতা মেহবুবা মুফুতি ও ওমর আবদুল্লাকে গৃহবন্দী করে, ৪৬ হাজার সেনা দিয়ে শ্রীনগরকে মুড়ে ফেলে আচমকা রাজ্যসভায় এই বিল পাশ করল মোদি সরকার।
একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মহারাজা হরি সিং বলেছিলেন তারা কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেননা। ১২ অক্টোবর মহারাজা হরি সিং এর পক্ষ থেকে দিল্লিতে বিবৃতি দিয়ে বলা হল, তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চান। তবে কাশ্মীরকে দখলে নিতে পাকিস্তান কিছু সৈন্য পাঠালে হরি সিং ভারতের সাহায্য চাইলেন। ভারত সাহায্য করতে রাজি, কিন্তু শর্ত, ভারতে সংযুক্ত হতে হবে তার জন্য।মহারাজা হরি সিং স্বাক্ষর করলেন। অস্থায়ী সেই সংযুক্তি স্থায়ীভাবে চলল এত বছর। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকে কাশ্মীর থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলে। কিন্তু কেউই সেটায় রাজি হয়নি। কাশ্মীরের প্রশাসন তখন শেখ আবদুল্লার দখলে। ততদিনে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল এবং গোপালস্বামী আয়েঙ্গার তিনজন শেখ আবদুল্লার সঙ্গে আলোচনা করে কাশ্মীরের ভারতে সংযুক্তির শর্ত হিসাবে ৩৭০ নং ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
এই ৩৭০ অনুচ্ছেদে বলা হল – প্রতিরক্ষা, অর্থ, যোগাযোগ আর বিদেশ সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কোনও আইন বলবৎ অথবা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে কথা বলতে হবে, সম্মতি নিতে হবে। কাশ্মীরবাসী নাগরিকত্ব, সম্পত্তির অধিকার এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধিকার ভোগ করবেন যা ভারতীয় সংবিধান থেকে পৃথক। এই আইন অনুযায়ী ভারতের অন্য রাজ্যের বাসিন্দারা কাশ্মীরে কোন সম্পত্তি, জমি কিনতে পারবে না। রাজ্য বিধানসভা স্থির করবে জম্মু কাশ্মীরের নাগরিক কারা হবে।
এখন আজ ৩৭০ ধারা খারিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসান হল দীর্ঘ ইতিহাসের। আর এর ফলে আগামীদিনে কাশ্মীরের বাইরে থেকে আসা ভারতবাসী জম্মু ও কাশ্মীরের জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেন। সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন, শিল্প স্থাপন থেকে শুরু করে ব্যবসা চালু করতে পারবেন। শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোন বিশেষ প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। ভারতের যে কোনও প্রান্তের মানুষ কাশ্মীরে এসে সাধারণ নাগরিক হিসাবেই বসবাস করতে পারেন। করতে পারবেন বিবাহ ও জীবিকা যাপনও।
কংগ্রেসসহ কয়েকটি দল এই বিলের বিরোধিতা করেছে। তবে বিজেপি পাশে পেয়েছে মায়াবতী ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের মতে, কাশ্মীরকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। আগামী দিনে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেক বিরোধী।
তবে অমিত শাহ বলেছেন ৩৭০ অনুচ্ছেদের ফলে গোটা দেশের সঙ্গে মিশতে পারেননি কাশ্মীরিরা। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা উপত্যকায় জমি কিনতে পারেননি। ফলে বিনিয়োগও হয়নি। মানুষ গরিবই রয়ে গিয়েছেন। ওই অনুচ্ছেদ উঠে গেলে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আরও ভাল করে দেশের সঙ্গে তার আত্মীকরণ ঘটবে। তার দাবি, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ নন, সে রাজ্যের তিনটি পরিবার যারা এ যাবৎ রাজত্ব করে এসেছে, তারাই সবচেয়ে আতঙ্কিত।
নেহরুর আমল থেকে চলে আসা সমস্যা কী ভাবে মোদী-আর অমিত শাহের হাত ধরে সমাধানের পথে এগোবে দেখার বিষয়। লাদাখকে আলাদা করে দিল্লীর কেজরিওয়াল ধরণের নখদন্তহীন সরকার হতে যাচ্ছে জম্মু-কাশ্মীরে। বলা চলে একজন হিন্দু শাসক বসছেন মুসলিম প্রধান উপত্যকায়।
৫ আগস্ট কাশ্মীর বাসীর জন্য দুঃস্বপ্নের দীর্ঘ যাত্রা শুরু কিনা সময়ই বলবে। তবে ভারতীয় সুশীল সমাজের অনেকে বলছেন, বিজেপির সর্বভারতীয় হিন্দুত্ববাদের নতুন অভয়ারণ্য হতে চলেছে ভূস্বর্গ।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, সারাবাংলা ও জিটিভি
সারবাংলা/এমএম