এতিমদের পেটে চামড়া সিন্ডিকেটের লাথি
১৫ আগস্ট ২০১৯ ২১:৩৪
কোরবানির পশুর চামড়া আসলে বাণিজ্যের বিষয় নয়। কিন্তু দেশের চামড়া শিল্পের মূল কাঁচামালটা আসে এই কোরবানির ঈদে। তাই বাণিজ্য না হয়েও ঈদের চামড়া বাংলাদেশে অনেক বড় বাণিজ্যও, টাকার অংকে তো বটেই। চামড়া শিল্পের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য, তারপরও কোরবানির চামড়াকে বাণিজ্য নয় বললাম কেন? কারণ কোরবানির চামড়া যায় বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা আর এতিমখানায়।
বাংলাদেশের অনেক এতিমখানা আছে, যাদের আয়ের একটা বড় উৎস কোরবানির চামড়া। চামড়া সংগ্রহ ভালো হলে এতিমদের খাওয়া ভালো হয়। তাই চামড়া নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা খুব দরাদরি করে না। ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি ঈদের আগেই মাদরাসার ছাত্ররা দল বেঁধে ঘরে ঘরে গিয়ে চামড়া চেয়ে রাখতো। ঈদের দিন নামতো চামড়া সংগ্রহে। কেউ কেউ সরাসরি চামড়া দান করে দিতেন মাদরাসা বা এতিমখানায়। আবার কেউ চামড়া বিক্রি করে বিভিন্ন মাদরাসায় ভাগ করে দিতেন।
যাই হোক, চামড়া বিক্রির টাকা শেষ পর্যন্ত যেত এতিমের পাতেই। ছেলেবেলায় দেখতাম পাড়ায় পাড়ায় মাঝারি গোছের মাস্তানরা একদিনের জন্য চামড়া ব্যবসায়ী বনে যেত। তারা পাড়ার মুরব্বিদের কাছ থেকে হালকা-পাতলা ঝাড়ি দিয়ে কিছুটা কম দামে চামড়া সংগ্রহ করতো এবং পরে আড়তদারদের কাছে কিছুটা বেশি দাম বিক্রি করত।
তাতে কিছুটা লাভ হতো। এই দিয়ে তারা ঈদের আনন্দ করত। যারা বড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত, ঈদের পর চামড়া ব্যবসার টাকা দিয়ে তাদের কাউকে কাউকে নতুন মোটরসাইকেলও কিনতে দেখেছি। কিন্তু আগেই যেটা বলেছি, চামড়া বিক্রির টাকাটা শেষ পর্যন্ত যায় এতিমদের পাতে। মাদরাসায় থাকা এতিমদের জন্য কোরবানির ঈদ, নিছক ঈদ নয়; চামড়া উৎসব। এবার সেই এতিমদের উৎসবের আলো নিভিয়ে দিয়েছে কিছু পশু, মানুষের মতো দেখতে কিছু পশু এতিমদের পেটে লাথি মেরেছে।
এবার চামড়া বাজারে যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টাই পরিকল্পিত। গত ৬ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়েছিল। চামড়া ব্যবসায়ীরা চেয়েছিল চামড়ার দাম যেন কম ধরা হয়। কিন্তু সরকার তাদের কথা রাখেনি। সরকার দাম বাড়ায়ওনি, গতবছরের দামটাই বহাল রেখেছিল। হয়তো এ কারণেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন। সরকার তাদের আবদার রাখেনি, তাই কি তারা সরকারকে একটা শিক্ষা দিয়ে দিলেন?
এবার যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন বলছি; কারণ আমাদের কারো স্মৃতিতে এমন বিপর্যয় নেই। পত্রিকায় পড়ছি, ৩১ বছরের মধ্যে এবার চামড়ার দাম সবচেয়ে কম। মূদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ইতিহাসের সবচেয়ে কম দামে এবার চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। অনেকেই অভ্যাসবশত লিখেছেন, পানির দরে চামড়া বিক্রি হয়েছে। এটা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশে এখন পানিও এত সস্তায় মেলে না। এবার আসলে আড়তদাররা প্রায় বিনা পয়সায় চামড়া সংগ্রহ করেছে। কাউকে কাউকে পরিবহন খরচ দেওয়া হয়েছে শুধু। লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩শ টাকায়।
যাদের আত্মসম্মান আছে, তারা আড়তদারদের মুখের ওপর টাকা ছুড়ে দিয়ে চামড়া নিয়েই ফিরে এসেছেন। ক’দিন আগে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ধান ক্ষেতে আগুন দিয়েছিলেন কৃষকরা। এবার চামড়া ব্যবসায়ীরা শত শত, হাজার হাজার চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে বা সিটি করপোরেশনের ময়লার ডিপোতে ছুঁড়ে ফেলেছে। এসবই মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের প্রকাশ। কিন্তু ক্ষোভ দিয়ে তো আর পকেট ভরবে না। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের সবাই এবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ মৌসুমি চামড়া ব্যবসাটা আসলে একদিনের। কারণ সাধারণ ব্যবসায়ীদের চামড়া সংরক্ষণের কোনো কৌশল নেই।
তাই আড়তদাররা প্রায় বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করতে পেরেছে। এখন তারা এই চামড়া সংরক্ষণ করবে। চামড়া ব্যবসায়ীদের সাথে এখন এই আড়াতদাররা দর কষাকষি করবে। সরকারের সাথে দর কষাকষি করবে। এখন আড়তদাররা বলছেন, তাদের হাতে টাকা নেই। তাই বাজারে ক্রেতা কম ছিল। তাই দাম পড়ে গেছে। তাদের অভিযোগ, চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের ৩৫০ কোটি টাকার মতো পাওনা আছে। টাকা না পাওয়াতেই তারা চামড়া কিনতে পারেননি।
আর চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তদারদের হাতে টাকা আছে। এই ঠেলাঠেলি দেখে আমার মজাই লাগছে। আমি জানি, আড়তদার, চামড়া ব্যবসায়ী ঠিকই নিজেদের ভাগটা বুঝে নেবে। মাঝে নিঃস্ব হয়ে গেল মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা, পেটে লাথি পড়লো এতিমদের।
সমস্যাটা হলো সরকারের। চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়েই তারা দায়িত্ব সেরেছে। সেটা মনিটর করেনি। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে যারা সবকিছু মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেন, তারাও সেই সিন্ডিকেটেরই সহযোগী। সরকার দাম ঠিক করে দেবে এবং সেই দাম বাজারে আছে কি না তা নিশ্চিত করবে। গরিব, এতিম, প্রান্তিদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। বাণিজ্যমন্ত্রী চামড়া বাজারে এই ধসের জন্য ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন।
কিন্তু শুধু দায়ী করলেই হবে না, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঈদের পরদিন কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে। এতে নাকি চামড়ার দামের ধস ঠেকানো যাবে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আর পাোষানো যাবে না। জানি না কেন, সব সময় ডাক্তার আসার আগেই আমাদের রোগী মারা যায়। চাল আমদানির বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে নিতে নিঃস্ব হয়ে যায় ধানচাষীরা। কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত আসতে আসতে পথে বসে যায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্যমন্ত্রী সরাসরি ব্যবসায়ীদের দায়ী করলেও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বরং একটু কৌশলী। তিনি বলেছেন, চামড়ার এই দরপতনের জন্য সিন্ডিকেট দায়ী কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুনি আর হাসি আমি। বাংলাদেশে এখন সব কিছুতেই সিন্ডিকেট। সবার চোখের সামনে শেয়ারবাজার থেকে কারসাজি করে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা, কয় জনের সাজা হয়েছে? ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে, কারো কিছু হয়েছে?
আর একদিনের চামড়া সিন্ডিকেটকে ওবায়দুল কাদের শাস্তির আওতায় আনবেন! বিশ্বাস করুন, এ নিছক সান্ত্বনা বাণী। যারা এতিমদের ৫শ’ কোটি টাকা লুটে নিলো তাদের কারোই কিছু হবে না। হবে না জানি, তবু আমার মনে কিছু শাস্তির কথা আসে। আমি সবসময় সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে। তাই দাবি করছি, এ ধরনের সিন্ডিকেটবাজদের জন্য প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় কিছু নতুন শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। যেমন যারা চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটবাজি করবে, তাদের শাস্তি হবে। চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া বা চামড়া তুলে লবণ লাগিয়ে দেওয়া।
এসবই আসলে ক্ষোভের কথা। কারোই কিছু হবে না। সাধারণ ব্যবসায়ীরা আর এতিমরা তাদের অভিশাপ দিয়েই যাবে। এটুকুই সান্ত্বনা।
লেখক: প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক