রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও দলকানাদের উল্টোস্রোত
১৮ আগস্ট ২০১৯ ১০:৪৮
একবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক সিবিএ নেতার মেয়ের বিয়ের গল্প লিখেছিলাম। ভদ্রলোক পদে ক্লার্ক হলেও দলীয় পদে শীর্ষে মানে সভাপতি। মেয়ের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাজধানীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে ৪ হাজার লোককে খাইয়েছিলেন। মেয়ের ছবি দেখলাম হিরে আর জহরতে মোড়ানো। হিসেব কষে দেখলাম কমছে কম কোটি টাকার বিয়ে এটা। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম ওই সিবিএ নেতা জমিদার বংশীয় নন। তবে এরই মধ্যে গ্রামে একটা দেখার মতো কিংবা বলা চলে দেখাবার মতো মসজিদও তৈরি করছেন। যা খুব সাড়া ফেলেছে।
কীর্তিমানের এই কৃর্তিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এই ভদ্রলোককে দুর থেকে চিনতাম প্রায় ১২-১৩ বছর। সফেদ পাজামা-পাজ্জাবী পরেন, ক্লিন সেভ করেন, কড়া পারভিউম মাখেন আর ব্যাংকের এ কর্তা ও কর্তার রুমে ঘুরে বেড়ান। যখন তখন বিনা বাক্যব্যয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের রুমে ঢুকে পড়তেন। দু’একটা আদেশ- নিষেধ পাল্টাতেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সামনে এমন ভাবে বসতেন, কথা বলতেন যেন তিনি ব্যাংকের মালিকপক্ষের লোক, তার আঙ্গুলের ইশারায় এমডিকে উঠতে বসতে হবে।
এই সিবিএ নেতা কিংবা নেতাদের দৌড়ত্বের গল্প খানিকবাদে আরও বলবো। তার আগে দু’জন দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার গল্পটা বলি। দু’জনই আবার একদা সাংবাদিক ছিলেন। ছাত্রজীবনে দলীয় ঝা-া তুলে ধরে শ্লোগানে শ্লোগানে ক্যাম্পাস মাতিয়েছেন। না, তাদের সেই কর্মকা- বৃথা যায়নি। ব্যাংকের সকল নিয়মকানুন উপেক্ষা করে একজনকে সিনিয়র অফিসার আরেকজনকে সরাসরি অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল জনসংযোগ বিভাগে।
দু‘জনেই যে কি কেলেংকারী ঘটালেন, কয়েক বছরের মাথায় একজনকে চাকরি ছাড়া করা হলো আরেকজনকে জনসংযোগ বিভাগ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
শোনা যায়, এই দলকানারা ব্যাংকের প্রচার কাজের বাজেটের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন কৌশলে। ব্যাংকের ভাষায় তাদের ‘সেভ’ করতে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এবার আসুন পরিচালকদের নিয়ে দু‘চারটে কথা বলা যাক। গত ১০ বছরের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে যে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার বেশির ভাগ দলীয় বিবেচনায়। ব্যাংক চালানোর অভিজ্ঞতা থাক বা না থাক সেটা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। মানলাম, সরকারের নীতিবাস্তবায়নে দলীয় লোকের দরকার আছে। কিন্তু এই দলকানারা যখন সরকারের নীতি বাস্তবায়নে কাজ না করে নিজের আখের গোছানোর কাজ করেন তখন কি কোনো কথা থাকে?
হলমার্কের ঘটনা যখন ঘটলো দলীয় পরিচালকে ঠাসা ছিল সোনালী ব্যাংক। জনতাকে ব্যাংকে যখন ৫ হাজার কোটি টাকার কেলেংকারি বের হয় তখন দলীয় পরিচালকের আধিক্যই চোখে পড়ে বেশি। তাহলে এসব কেন ঘটে? ঘটে কারণ এই দলকানারা উল্টোস্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। তাদেরকে দেখিনি বা গত ১০ বছরে শুনিনি বড় একটা ইন্ড্রাস্টি, সৃজনশীল উদ্যোক্তার জন্য সুপারিশ করেছেন। এমন উদাহরণ না থাকলেও তাদের চোখের সামনে দিয়ে ঋণ অনুমোদন করে বিদেশে পাচারের উদাহরণ রয়েছে।
শুধু পরিচালকরা কেন চেয়ারম্যানরাও কি কম যান? সিএসআর খাতের টাকা ব্যক্তিখাতে ব্যবহার, নিজ কর্মের পুস্তিকা প্রকাশের নামে টাকা লোপাটের অভিযোগও তো এক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রয়েছে। দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ হলেও তাকে দ্বিতীয়বার আর বসানো হয়নি চেয়ারম্যানের চেয়ারে।
সিবিএ নেতাদের নিয়ে কথা বলছিলাম। ঋণ অনুমোদনের পর তাদের কমিশন ছাড়া ঋণ ছাড় করানো মুশকিল-এটা ভুক্তভোগীরাই বলেন।
ব্যাংকের ক্যালেন্ডার চাহিদামত তাদের দেয়া না হলে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে ব্যাংককেও টাকা দিতে হয় তাদের ইচ্ছে মাফিক। ওই অনুষ্ঠানে এমডি ভালো আসন না পেলেও সিবিএ নেতা কিন্তু প্রথম সারিতে। অনেক সময় দেখেছি এমডি হেঁটে অনুষ্ঠান স্থলে যাচ্ছেন আর সিবিএ সভাপাতি পাজেরো গাড়ি হাঁকাচ্ছেন।
গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কোনো সুখবর নেই। সম্প্রতি ব্যাংক বাঁচাতে সরকারের কাছে একজন এমডি কয়েক হাজার কোটি টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই প্রস্তাব নাকোচ হয়েছে। ব্যাংকটি এক সময়ে শীর্ষে ছিল। এখন তলানিতে তার অবস্থান। গত এক দশকের দুর্বৃত্তায়নের ফল ভোগ করছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোতে যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের রুমের সামনে খানিক্ষণ কাটান দেখতে পাবেন তদবির, তদবির আর তদবির।
দলকানাদের এই দুর্বৃত্তায়নের মচ্ছ্বব বন্ধ করতে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছে ২০০৯ সালে। ফল কিছুই হয়নি। উল্টো সিবিএ শক্তিশালী হয়েছে। যারা শ্রমিক কর্মচারীর কল্যাণে কাজ করার নামে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এদের অপকর্মের কথা পত্রিকায় আনা হলে সাংবাদিককে অবরুদ্ধ করা হয়েছে, লাঞ্ছিত করা হয়েছে বহুবার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলবে কে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক? না সেখানেও অর্থমন্ত্রণালয়ের সাথে তাদের রশি-টানাটানি আছে। একজন আরেকজনের সিদ্ধান্তকে মানা-না মানার সংস্কৃতি এখানে দীর্ঘদিনের।
শুনেছি যুক্তরাষ্ট্রে যখন সরকার বদল হয় তখন নতুন সরকার তার দলীয় লোক নিয়ে হোয়াইট হাউজে ঢোকে। যাতে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন বা কাজ করতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশেও কিন্তু বড় বড় জায়গাগুলো দলীয়দের দখলে। যোগ্য হোক বা না হোক দলীয় বিবেচনায় এগিয়ে থাকলেই তার কপাল খুলে গেলো।
এবার শেষ কথায় আসি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই দলকানাদের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। অর্থমন্ত্রণালয়ের চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতাকে এখানে বাড়াতে হবে। এমডি বা অন্যান্য পদে নিয়োগের সময়ে দলীয় বিবেচনার পাশাপাশি অবশ্যই মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বপরি রাষ্ট্রায়ত্ত মানেই এখানে যা খুশি তাই করার মানসিকতা পরিহার করে সরকারের নীতিবাস্তবায়নে যারা কাজ করবে তাদেরকেই নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে ফল হয়তো কিছুটা আসতে পারে।
টুটুল রহমান, সাংবাদিক ও ফ্রিল্যান্স রাইটার
সারাবাংলা/এমএম