Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব মশা দিবস: মশা তুমি মুসিবত


২০ আগস্ট ২০১৯ ০৯:২২

এক ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। এক ঘরোয়া আলোচনায় হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন,

-আচ্ছা বলুন তো, মশা কখন কামড়ানো থামায়?

আমি ভেবেছি এর উত্তর জটিল কিছু হবে। জবাব দিতে পারিনি দেখে উনি রেগে বললেন,

-যখন আপনি কষে একটা থাপ্পড় লাগাবেন।

তার অভিনয় করে দেখানোর ভঙ্গিমাটা ভালো ছিল। লোকটার কথা আলবৎ সত্য এবং আমার মতে, থাপ্পড়টা ঠিক জায়গা মতন পড়তে হবে।

সবমিলিয়ে একটা অস্থির সময় পার করছি আমরা। চারপাশে মশা নিয়ে যা ঘটছে তাতে বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। ঘুম থেকে ওঠে যখন দেখি মাথার ওপর পাজি মশা ঘুরঘুর করছে, তখন ভাবি ইতরটা রাতে আমার সর্বনাশ করে দেয়নি তো!

আলসেমির কারণে এখনো মশারির ব্যবহার শুরু করিনি। চাইলেই আমাকে সময়ের তুলনায় বেশ সাহসী বলতে পারেন। আসুন মশা নিয়ে আরও কিছু মশকরা করি।

আমার গণিতের শিক্ষক, শশীবাবু। বেশ ভালো অংক বোঝাতেন। তাছাড়া, সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো মহামানবদের কথা আমি তার মুখেই প্রথম শুনি। তিনি ছিলেন নিরামিষাশী। বিশ্বাস করতেন প্রাণী হত্যা মহাপাপ। তাই নিয়ম-কানুন মেনে চলার চেষ্টা করতেন। ক্লাসে বা প্রাইভেট পড়ায় আমরা যখন মশা মারতাম, চেষ্টা ছিল পরিস্থিতিটা কতটা রক্তাক্ত করা যায়। যা স্বভাবতই তিনি পছন্দ করতেন না। যখন পড়তে বসতাম, দেখতাম তার হাতে একটা মশা বসেছে আর তিনি সেটাকে অনামিকার হালকা আঘাতে ‘আহত’ করছেন। যেন এটি উড়ে চলে যায়।

তবে এখন মশা মারার জন্য শুধু কয়েল নয় আরও আধুনিক ও নৃশংস পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছে। যেমন ইলেকট্রিক ব্যাট। হাতপাখার মতো বাতাস করে মুহূর্তেই বিদ্যুতের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া যায় মশার দেহ। পুড়ে ছাই হওয়ার শব্দটা যখন কানে আসে তখন কিছুটা খারাপই লাগে।

বিজ্ঞাপন

সে যাইহোক, আমি হয়ত ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। তবে সত্যি কথা বলতে, ছয়-পায়ের এই ভ্যাম্পায়ারটাকে থামানো বেশ মুশকিলের কাজ। বহুকাল আগে কে না কে যেন বলেছিলেন ‘মশা মারতে কামান দাগানো’ নিয়ে কথা।

বহুল প্রচলিত এই উক্তিটির কিন্তু যথার্থ ব্যবহার হচ্ছে না। জেনে রাখুন, প্রতিবছর মশাবাহিত রোগ পৃথিবীতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। আর এরসঙ্গে যোগ হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়াসহ ১৩ ধরনের রোগ ছড়িয়ে বেড়ায় এই ঘাতক মশা।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মশার প্রাদুর্ভাব বেশি। অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অপরিচ্ছন্নতা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মশাদের সংখ্যা ও টিকে থাকার ক্ষমতাও বেড়েছে বহুগুণ। তাই এখন প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করেও মশা কমানো যাচ্ছে না।

তাই আমি বলি কি, শুধু কামান কেন? শ-খানেক পরমাণু বোমা মেরে হয়তো পুরো মানবজাতিটাকেই সহজেই শেষ করে দেওয়া যাবে। তবে মশারা থেকে যাবে ঠিকই বহাল তবিয়তে।

ব্যাপারটা হলো, কোনো দেশ বা শহরে যতই কীটনাশক ব্যবহার করা হউক না কেন, কিছু না কিছু মশা বেঁচেই যায়। তারপর শুরু হয় এদের বংশবিস্তার। এধরনের চেষ্টা একবার লাতিন আমেরকিায় চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। সেই ডাইনোসরের সময়কাল থেকে মশারা দাপট দেখিয়ে আসছে। টিকে থাকতে পারে পৃথিবীর শেষ অব্দিও।

ধূর, ছাই! আলোচনা গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। আমি বরং দালাইলামার প্রসঙ্গ তুলি। মশা প্রজাতিকে ছোট করে না দেখতে উপদেশ দিয়েছেন এই ধর্মগুরু। শুধু তাই নয়, মশারা মানুষের মোটিভেশনের কারণ হতে পারে বলেও জানিয়েছেন দালাইলামা। তার উক্তি, ‘যদি ভাবো তুমি ছোট বলে পার্থক্য গড়তে ব্যর্থ, তাহলে ঘরে একটা মশা নিয়ে ঘুমাও।’

বিজ্ঞাপন

দালাইলামা মহৎ প্রজাতির মানুষ। তার মাথায় কত কিছুই না ঘুরতে পারে। তবে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার এই সময়ে আমার-আপনার কারোই ইচ্ছে নেই এসব কথা যাচাই করে দেখার। আর যেহেতু তিনি থাকেন পাহাড়ে, মশার উৎপাত গুরুর ভালোই জানার কথা!

তবে মশা নিয়ে সুযোগসন্ধানীরা কিন্তু ভাবেন একটু ভিন্নভাবে। যেমন ধরুন আপনার কোনো এক বজ্জাত বন্ধু টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। কি আর করা বন্ধু বলে কথা! রাগ ঝাড়তে হলে হাতের পাঁচ আঙ্গুল প্রসারিত করে ওর পিঠে দাগ ফেলে দিন। তারপর বলুন ওর পিঠে মশা বসেছিল। আপনি তো উপকারই করতে চাচ্ছিলেন। মশা কামড়ালে কত কী যে হতে পারে তার কি গ্যারান্টি আছে!

কদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মশা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তো রীতিমত বর্ণবাদী মন্তব্যই করে ফেললেন। তিনি জানালেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকিউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।’

মন্ত্রী মহোদয় রোহিঙ্গাদের অপমান করে কথা বলায় কিছু মানুষ কিন্তু খুশিই হয়েছে। তবে মশারা কিন্তু আবার এসব শ্রেণি-গোষ্ঠী মাথায় রেখে রক্ত চুষে না।

গবেষকরা বলেন, আমরা নিঃশ্বাসে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ি মশা তা ৭০-৭৫ ফুট দূরত্বে থেকে শনাক্ত করতে পারে। ও তাদের শিকার বাছাই করে। মশাদের এই প্রক্রিয়ায় কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি, ডাক্তার-সাংবাদিক বা রোহিঙ্গা-বাঙালি শ্রেণিভেদ নেই।

এ বিষয়টা আবার বুঝতে পেরেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। ওই যে কথায় আছে না, কেউ কেউ ঠেকে শিখে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আল্লাহ যেন কাউকে ডেঙ্গু না দেয়। এই রোগ নিয়ে মশকরা করা ঠিক নয়।

তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জন্য কবির দুই ছত্র আমার মনে পড়েছে, ‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে, দংশেনি যারে’।

রাজধানী ঢাকায় মশা নিধন নিয়ে হয়েছে আবার সমস্যা। পত্রিকায় পড়েছিলাম অভিযোগ। ঢাকার উত্তরে মশার ওষুধ ছিটালে মশারা যায় দক্ষিণে, আর দক্ষিণে ছিটালে তারা যায় উত্তরে। বড় মুসিবতের বিষয়।

আবার মশার ওষুধেও রয়েছে গোলমাল। আমার কথা হচ্ছে, আরে, গোলমাল তো হবেই। দেশে একটা সমস্যা হয়েছে আর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা গোলমাল বাঁধাননি এমনটা কি সচরাচর হয়েছে কখনো! তাও এবার ডেঙ্গু বলে কথা। চলতি বছর বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে ১২শ’র বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। তাই উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়র মশাই বারবার সেসব কথা আমাদের মনে করিয়ে ‘স্বস্তি’ দিয়েছেন।

এখন আবার হয়ত কারও মনে প্রশ্ন জাগছে, মশা আসলে কেন কামড়ায়? এরা কি ভ্যাম্পায়ার যে রক্ত খেয়ে বাঁচে? উত্তর হলো, ‘না।’ মশা মানুষকে কামড়ায় তবে ‘স্ত্রী মশা’। প্রজাতি টিকিয়ে রাখা ও বংশবিস্তারের স্বার্থে। খাবার হিসেবে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় মশাই পানি, ফল ও ফুলের মধু খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু  স্ত্রী মশা তার ডিমের পুষ্টির জন্য শোষণ করে রক্ত। কারণ তার প্রয়োজন প্রোটিন। খাবার বেলায় মশারা আবার মানুষের মতোই একটু লোভী! একটি মশা তার তিনগুণ ওজনের সমান রক্ত শোষণ করতে পারে। জীবনচক্রে পুরুষ মশা বাঁচে ১০ দিনের মতো এবং উপযুক্ত পরিবেশে স্ত্রী মশা বাঁচে ৬-৮ সপ্তাহ। তবে শীতযাপনের সময় ৬ মাসও এদের বেঁচে থাকা সম্ভব।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে মশার ওপর আপনাদের রাগটা একটু তাঁতিয়ে দেব। কেউ কেউ জানেন না হয়ত, অনেক বিখ্যাত মানুষের মৃত্যু হয়েছে মশার কামড়ে হওয়া রোগে। যেমন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ম্যালেরিয়া রোগে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন ইংরেজি সাহিত্যের কবি বায়রন। তাছাড়া, এই রোগে আরও প্রাণ গেছে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা ও বিখ্যাত স্কটিস ভ্রমণপিপাসু ডেভিড লিভিংস্টোনের। কি একটা অবস্থা ভাবুন তো!

তবে মশাদের শারীরিক গঠন থেকে বিজ্ঞানীরা কিন্তু শিখেছেন কিছু। মশার রক্তচোষা নল অনুকরণ করে তারা বানিয়েছেন, হাইপোডারমিক সুঁচ। যা ব্যবহার করলে ব্যথা কম লাগে। এছাড়া, মস্তিষ্কের চিকিৎসায়ও ইলেকট্রোড তৈরিতে মশার নল নিয়ে হয়েছে গবেষণা।

আচ্ছা বাপু, এবার আসল কথাটা সহজে বলি। মশা নিয়ে বিস্তর এত কেচ্ছা-কাহিনীর একটাই উদ্দেশ্য- কারণ, আজ ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস।

এই যে হাজার বছর ধরে মশারা পরোক্ষভাবে গণহারে মানুষ নিধন করে চলেছে, এটা কিন্তু মানুষ জানতোই না। ১৮৭৭ সালে ব্রিটিশ ডক্টর প্যাট্রিক ম্যানসন এই বিষয়টি প্রথম আবিষ্কার করেন। এরপর ১৮৯৪ সালে গবেষক রোনাল্ড রস লক্ষ্য করেন মশার ম্যালেরিয়া জীবাণু বহনের প্রক্রিয়াটি। টানা কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৮৯৭ সালে তিনি নিশ্চিত হন, অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে।

আর তার এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের দিনটি স্মরণ করে ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট প্রথম পালন করা হয় ‘বিশ্ব মশা দিবস।’

এবার আপনাদের প্রতি আমার উপদেশ বাণী হচ্ছে, মশাবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ থাকতে সতর্কতা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের বাড়ির আঙিনা, অফিস-আদালত, নির্মাণাধীন স্থাপনা সব জায়গা রাখতে হবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। যাতে মশারা আবাসস্থল গড়তে না পারে। সেইসঙ্গে, এই বার্তাই ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে।

লেখক: নিউজরুম এডিটর,সারাবাংলা ডটনেট ও দৈনিক সারাবাংলা

বিশ্ব মশা দিবস মশা

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর