দুষ্কৃতায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নবজন্মের দিন একুশে আগস্ট
২১ আগস্ট ২০১৯ ০৯:৫৩
প্রতি বছর ২১ আগস্ট এলে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে— বিএনপির রাজনীতির শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? অনেক আগে থেকে পরিসংখ্যান নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০০১-এর নির্বাচনে জেতার পর দেশব্যাপী ধর্ষণের উৎসব, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, সারাদেশে নৈরাজ্য এগুলো ছিল শাসনামালের পুরো সময়টাতেই। কিন্তু রাজনৈতিক খুন এক ভিন্ন বিষয়। একের পর এক ঘটনা ঘটছিলই। তবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ তার দলের পুরো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বিলীন করে দেওয়ার জন্য যে কাজটি করেছিল, সেই বিবেচনায় সহিংস রাজনীতিতে এই দল একেবারে প্রথম স্থানটি দখল করেছে।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে অনেক কথা আছে, কিন্তু এটিকে রীতিমত একটি শিল্পে পরিণত করার গৌরব আর কারও নেই, নেই দুষ্কৃতায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করার। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো সরকারের আমলে কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায়-দায়িত্ব সরকারি দলের থাকলেও তাকে কি পুরো দায় তাকে দেওয়া যায়? সবসময় দেওয়া যায় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দিতে হয়। একুশে আগস্ট তেমনি এক ঘটনা যার দায় বিএনপিকেই নিতে হবে।
২০০৪ সালের একুশে অগাস্ট শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন সিনিয়র নেতারা। দলটির প্রধান ও তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ছিলেন ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি। নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করেই বিকট শব্দ। সাংবাদিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১২টির বেশি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল। আরও কয়েকটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাৎক্ষণিক মারা যায় ২৩ জন নেতাকর্মী। গুরুতর আহত হয়ে কয়েকদিন লড়াই করে মারা যান মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমান। শেখ হাসিনা বেঁচেছেন, কারণ তাকে মঞ্চের সব নেতা মানববর্ম বানিয়ে রক্ষা করেছেন।
বিএনপিকে কেন এই হামলার দায় নিতে হবে, তার কতগুলো সহজ সমীকরণ আছে। হামলার পর রক্তে ভেজা সড়ক, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়ানো চারদিকে। আশপাশের দোকানদার, সাধারণ মানুষ সাহায্যে জন্য ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশ? তারা কাঁদানো গ্যাস ছুঁড়েছে, সাধারণ মানুষকে লাঠিপেটা করেছে যেন আহত-নিহতদের হাসপাতালে নেওয়া না যায়। হাসপাতালে দায়িত্বরত জাতীয়তাবাদী চিকিৎসকরা আহতদের চিকিৎসা না দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিস ডেকে পানি ছিটিয়ে দ্রুত রক্তের দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছে সরকার। আর পুলিশের উপস্থিতিতেই শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার সময় তার গাড়িতে গুলি করা হয়েছে। এই সবকিছু প্রমাণ করে— একটি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছিল পুলিশ ও প্রশাসন।
নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজি নামের জঙ্গি সংগঠনের নেতা মুফতি হান্নান এই হামলার মূল কারিগর। আর তিনি এসব করতে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতা ও সে সময়ের উপমন্ত্রী আবদুস সালামের সরকারি বাসায়। হান্নানকে মদত দিয়েছে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। খালেদা জিয়ার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনএসআই, সিআইডি ও পুলিশের প্রতিটি বিভাগ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে চেষ্টা করেছিল। কোথা থেকে একজন নিরীহ জজ মিয়াকে হাজির করে রাষ্ট্রীয় অর্থ তার পেছেনে খরচ করে নতুন গল্প বানাবার চেষ্টা করেছে।
বাঙালি অতি রাজনীতি সচেতন। তবুও সে বিরুদ্ধবাদী বা প্রতিপক্ষের ঘরে আগুন দেয়, লুটপাট চালায় এবং ধারালো অস্ত্রাঘাতে তাদের খুন করে। কিন্তু রাজনীতির খুনি চরিত্র ইতিহাসে দু’বার দেখা গেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নস্যাৎ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬-এ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০১-এ জামাত নিয়ন্ত্রিত বিএনপি ক্ষমতায় এসে আরেকটি ১৯৭৫ ঘটানোর জন্যই ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের মত সবচেয়ে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করেছিল।
একুশে আগস্টের মতো ঘটনা যারা ঘটাতে পারে, তাদের সঙ্গে আর কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা চলে না— আওয়ামী লীগের ভেতর এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণা অবিবেচিত নয়। যারা ঘটনা দেখেছেন, যারা ঘটনার ভিকটিম হয়েছেন, তারা জানেন কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে এই ঘটনা। বিচার করেনি, তদন্তের নামে নাটক করেছে বিএনপি সরকার; আর তার দলের নেতারা হাস্যরস করেছেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে, হতাহতদের নিয়ে।
এখন ঘটনার বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে। সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে আর কতদিন লাগবে, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এতগুলো মানুষকে মারা হয়েছে, সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ তদন্ত অবশ্যই জরুরি। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, সেই সময়ের শাসক দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এটি ছিল রাজনীতির এক পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন। চিহ্নিত জঙ্গি মুফতি হান্নানকে দলের আর প্রশাসনের ছায়ায় আশ্রয় দিয়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা করে গণহত্যার ঘটনা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে– কারণ এই ঘটনার মাধ্যমেই ১৯৭৫-এর পর দুষ্কৃতায়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশে নতুন করে জন্ম লাভ করেছিল।
লেখক: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি