Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইবোলা এক ঘাতকের নাম…


৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৬:৪৯

৭ জুন, ২০১৯। ফোনের রিং টোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়িতে আমেরিকান সময় রাত সাড়ে চারটা। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে নম্বরটা বাংলাদেশের নয় দেখে হাঁফ ছাড়লাম। অবশ্য অসময়ে অফিসের ফোন মানেও ঝামেলার কিছু, হয় চুরি ডাকাতি হয়েছে বা কে জানে কোনও স্টাফ খুনও হয়ে যেতে পারে। অথবা পুলিশি ঝামেলা কিংবা কোনও স্টাফ অপহরণ হয়েছে!

আফ্রিকাতে এসব চলতেই থাকে। ফোনের অপর প্রান্তে আমার হেলথ প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা: ফ্রাংকো’র উত্তেজিত গলা, “আপা, কাসেসে’র কাছে এক হেলথ সেন্টারে ইবোলা ডিটেকটেড হয়েছে। বছর পাঁচেকের এক কঙ্গোলিজ বাচ্চা, কঙ্গো থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে উগান্ডাতে চিকিৎসা নিতে এসেছিল। ইবোলা লক্ষণ।” কাসেসে হচ্ছে উগান্ডার দক্ষিণ পশ্চিমের সীমান্ত জেলা। ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো আর রুয়ান্ডার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। ফ্রাংকোর গলায় খানিক শঙ্কা। ইবোলা মারাত্মকভাবে ছোঁয়াচে রোগ। কাসেসে আর বুন্ডিবুজো জেলাগুলিতে আমাদের সমস্ত কার্যক্রম সীমান্ত ঘেঁষা জনপদে। যদি সত্যি ইবোলা হয়ে থাকে আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিক সময়মত না নেওয়া যায় তবে মহা সর্বনাশ।

বিজ্ঞাপন

ছুটিতে আমেরিকায় ছিলাম। নির্ধারিত সময়ের আগে আফ্রিকায় চলে আসার জন্য চেষ্টা করেও কোনও ফ্লাইটে টিকিট কনফার্ম করা গেলো না। আমেরিকার মানুষজন গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে আমেরিকার বাইরে আর নন-আমেরিকানরা আমেরিকা ভ্রমণে ব্যস্ত। উড়ে না আসতে পারলেও ছুটির অবকাশ আর কিছুই বাকি রইলো না। ইবোলা রেসপন্সের কো-অরডিনেশন করতে নিউইয়র্ক অফিসে আস্তানা গাড়লাম বাকী ক’দিনের জন্য।

এখানে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড বলা দরকার মনে করছি। ২০১৩-১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ইবোলা ভাইরাস। পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিয়নসহ কয়েকটি দেশে মারাত্মক সংক্রামক এ ভাইরাসজনিত রোগটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় মূলত পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা আক্রমণ শুরু হলে ও সীমাবদ্ধ থাকলেও সারা পৃথিবী যেহেতু একটি গ্লোবাল ভিলেজের অন্তর্ভুক্ত, তাই নানা সূত্রে এই মহামারি ইবোলা আক্রান্ত রোগী বা তাদের স্পর্শের মাধ্যমে সন্দেহভাজন আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে আমেরিকাতেও।

বিজ্ঞাপন

উইকিপিডিয়ার তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে প্রথম শনাক্ত হয় ইবোলা ভাইরাস। মধ্য আফ্রিকার ইবোলা নদীর তীরে প্রথম সংক্রমণ ঘটে বলে নদীটির নামেই ভাইরাসটির নামকরণ হয়। ইংরেজিতে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছে ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ বা ইভিডি। চিকিৎসকরা মনে করেন, বাদুড়ের খাওয়া ফল থেকে এ ভাইরাস মানুষের দেহে প্রথম প্রবেশ করে। পরে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে শুরু করে। দেহ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল থেকে এ রোগ ছড়ায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সবশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে মোট ২১ হাজারের বেশি ইবোলা আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা গেছে। এর মধ্যে এগারো হাজার মৃত্যু রিপোরটেড হয়েছে। এই মৃত্যুর সিংহভাগ পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন আর গিনিতে । এ রোগের একশো ভাগ কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। কয়েক দফা এ রোগের বিস্তার ঘটলেও ২০১৩-১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে এর বিস্তার প্রাণসংহারী ছিল। এগারো হাজারের বেশি নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে কয়েক’শ চিকিৎসক ও নার্স পর্যন্ত আছেন। সবচেয়ে বিপদের কথা, আক্রান্ত বলে চিহ্নিতদের প্রায় ৭০ শতাংশই মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩-১৪ সালের ইবোলার মহামারিকে কয়েক দশকের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। আক্রান্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে ২০১৪ সালের ইবোলার নেতিবাচক প্রভাবের ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিলো।

গত জুন মাসে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোতে ইবোলায় মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে ডাব্লিউএইচও নিশ্চিত করে জানিয়েছে যে ২০১৯ সালের জুন নাগাদ কঙ্গোতে ইবোলা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সংস্থাটির মতে এপ্রিলের শেষ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গড়ে ৭৭ জন কঙ্গোলিজ ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে প্রায় ২লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কঙ্গোর সীমান্ত সংলগ্ন রাষ্ট্র উগান্ডা ও রুয়ান্ডায় এই সংক্রমণ ছাড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

উপরের ব্যাকড্রপে আমার হেলথ প্রোগ্রাম ম্যানেজারের ফোনকলের গুরুত্ব ধারনা করা যায়। আমার ফেরার টিকিট জুনের ১৬ তারিখে। এর মধ্যেই জুনের ১১ তারিখে উগান্ডা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানা গেলো, কঙ্গোলিজ শিশুটি কনফারমড ইবোলা এবং সে ১২ তারিখে মারা গেলো। মৃত শিশুটিকে যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেনে কবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অসুস্থ শিশুটির প্রায় ১২১ জন কন্ট্যাক্ট আইডেন্টিফাই করা হয়েছে এবং কন্ট্যান্টদের নজরে রাখা হয়েছে। তাদের আলাদা রাখা হয়েছে। ইবোলা প্রতিরোধের নিয়ম হল সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে চলা, যেহেতু রোগটি আক্রান্তের দেহ নিঃসরিত তরল যেমন রক্ত, ঘাম, থুথু ইত্যাদি থেকে ছড়ায় তাই ইবোলা আক্রান্তদের দাফনের সময় মৃতদেহকে গোসল দিতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়।

সরকারের তরফে ইবোলা শনাক্ত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজন সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের গুজব ছড়াতে শুরু করে। এই অবস্থায় প্রথম আর প্রধান কাজ হলো আমার স্টাফদের মানসিক দৃঢ়তা ধরে রাখা আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার স্টাফদের প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরোধ সামগ্রী দ্রুত সরবরাহ করা। নিউইয়র্কে বসেই কাম্পালার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে সবকিছুর ব্যবস্থা করার জন্য গাইড করা। ট্রেনিং আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার, জুতার তলায় স্প্রে করার জিংক ইত্যাদির জন্য কিছু ফান্ডিং যোগাড় করতে করতেই ফেরার দিন চলে এলো। এর মধ্যে সকল স্টাফের কাছে ইমেইল করলাম, যে আমি দূরে থাকলেও তাদের নিরাপত্তার কথা প্রতিনিয়ত ভাবছি এবং আমি তাদের সঙ্গেই আছি। বিপদের সময় এসব কমুনিকেশন স্টাফ এবং ম্যানেজমেন্টের মধ্যে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া তৈরিতে সহায়তা করে।

জুনের ১৭ তারিখ দুপুরে কাম্পালা পৌঁছেই সকল স্টাফের সঙ্গে মিটিং করলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ফিল্ড স্টাফ বিশেষ করে যারা কাসেসে ফোরট পোর্টাল এলাকায় কর্মরত তারা আতঙ্কিত। স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। প্রতিরোধের জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করলাম।

পরের সপ্তাহ এক সংকটময় সপ্তাহ। সকল স্টাফকে ট্রেনিং দেয়া হলো কিভাবে ইবোলা প্রতিরোধ করা যায়। পুরো হাত জড়িয়ে হ্যান্ডশেইক করা বারণ, কনুই ঠেকিয়ে উইশ করা, ফুল স্লিভ জামা পরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করা, বাইরের খাবর খাওয়া বারণ। গেইম মিট বা শিকার করা জন্তুর মাংস উগান্ডায় ডেলিক্যাসি, সেই প্রিয় গেইম মিট খাওয়া নিষিদ্ধ। হাগ করা বা জড়িয়ে ধরা উচিত কাজ হবে না, এমনকি ভেজা চুমুও রিস্কি। ফিল্ড স্টাফদের কিছু কনডম সরবরাহ করা হলো। অফিসে ঢুকার সময় গেইটের মুখে জিংক স্প্রে করার ব্যবস্থা হলো।

অফিস থেকে সকল স্টাফকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লভস দেয়া হলো বিশেষ করে হেলথ প্রোগ্রাম আর ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের ফিল্ড স্টাফদের। অফিসে অফিসে স্যানিটাইজার, লিকুইড সোপ আর গ্লভস রাখা হলো। বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদির সাপ্লাই কমে গেছে, ডিম্যান্ড বেড়ে গেছে প্রায় শতগুণ। এসবের দাম বেড়ে গেলো প্রায় পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ ভাগ। চিন্তা করলাম, আমরা না হয় এসব কেনার জন্য ফান্ডিং পেয়েছি, কিন্তু সাধারণ মানুষ কিভাবে এই ডাবল দামে প্রতিরোধ সামগ্রী কিনবে? যেই দেশে বেশীরভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে, সেখানে যতই জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন হোক মানুষ খাবার না কিনে সাবান স্যানিটাইজার কিনবে এমনটা ভাবাই পাগলামি। ছোঁয়াচে এই রোগ ছড়াবে মহামারির আকারে। ক্রাশ প্রোগ্রাম হিসাবে কাসেসে আর বুন্ডিবুজো এলাকায় ব্র্যাকের প্রোগ্রাম বেনিফিসিয়ারিদের প্রতিরোধ ট্রেনিং দেয়া হলো। ডিসট্রিক্ট আর সাবকাউন্টিতে সরকারি কর্মচারীদের ট্রেনিংও হলো। সরকারের যেহেতু রিসোর্স কম, তাই ব্র্যাকের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে কয়েক’শ লিটার স্যানিটাইজার, লিকুইড সোপ, জলের কন্টেইনার আর জিংক দিলাম আমরা।

এদিকে কঙ্গোতে গৃহযুদ্ধ নতুন করে প্রবল হতে শুরু করেছে। গৃহযুদ্ধ আর ইবোলার ভয়ে কঙ্গোলিজরা উগান্ডায় শরণার্থী হতে শুরু করেছে। তাঁবু দিলাম বেশ কটা, যেখানে সীমান্তে শরণার্থীদের ইবোলার প্রাথমিক নিরীক্ষা করা যাবে। কোন অবকাঠামো নেই, একদম খোলা আকাশের নীচে শরণার্থীরা আসছে, ঠিক যেমন রোহিঙ্গারা এসেছিলো বাংলাদেশে। আমাদের কিছু হেলথ স্টাফকে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য নিয়োগ করা হলো। তারা সোশ্যাল মবিলাইজেশনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন। মানুষের আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পোঁছেছে যে তারা স্বাস্থ্য কর্মীদেরও বিশ্বাস করেছে না। সীমান্তের কাছে এক এলাকায় ডাব্লিউএইচওর এক স্বাস্থ্যকর্মীকে ক্ষিপ্ত মানুষেরা মেরেই ফেলেছে।

এদিকে সীমান্ত বন্ধ করার কোন সিদ্ধান্ত উগান্ডা সরকার নেয়নি কিন্তু কড়া নজরে রেখেছে। ট্যাট্যাই বা কড়া নজরে লাভ কী- উগান্ডা, কঙ্গো, রুয়ান্ডা, কেনিয়া, সাউথ সুদানের মানুষদের মধ্যে রুটি রুজির সম্পর্ক। বৈবাহিক সম্পর্কও হরদম। খোলা সীমান্তে কার যাতায়াত নজরে রাখবে সরকার? চিকিৎসার জন্য কঙ্গোর মানুষ উগান্ডা বা রুয়ান্ডায় যায় নিয়মিত। একমাত্র কেউ যদি কঙ্গো থেকে উগান্ডা এসে চিকিৎসা নেয় তবেই তা রেকর্ড হবে। এরকম পরিস্থিতিতে সচেতনতা তৈরিই একমাত্র উপায়।

প্রথম কেস শনাক্ত হওয়ার তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ জুনের শেষ সপ্তাহে আমি রওনা হলাম ইবোলা আক্রান্ত জেলার উদ্দেশ্যে। আমার সহকারী মেয়েটি শুকনো মুখ করে বলার চেষ্টা করে, ”ম্যাম, ইউ হ্যাভ জাস্ট রিটার্নড ফ্রম এ লঙ ট্রাভেল, ইউ হ্যাভ নট রেস্টেড এনাফ, ইউর হেলথ ইজ নট ওয়েল টু ( আমার পায়ের টেন্ডনে আঘাত আর দাঁতের ব্যাথায় কাবু ছিলাম), ডক্টর হ্যাজ এডভাইজড ইউ টু টেইক রেস্ট, নট টু ওয়াক, আই থিংক ইউ সুড নট ট্রাভেল ইন দিজ সিচুয়েশন।” বুঝতে পারি তার আশংকা, নিজের মনের মধ্যেও নার্ভাসনেস কিছু কাজ করে। কিন্তু যেখানে আমার প্রায় পাঁচশ স্টাফ নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রেখে সংস্থার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানে তাদের নেতা ( শব্দটি যদিও অনেক ভারী কিন্তু লিডারের বাংলা প্রতিশব্দ বোধ হয় নেতা) নিরাপদ দূরত্বে বসে কেবল নির্দেশনা দিবে এটা হয় না। আমি কাছে গেলে তাদের মনোবল বাড়বে আর আমার নৈতিক দায়িত্ব আমার সহকর্মীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, তাঁদের কাঁধে আমার হাতটা রাখা।

কাসেসে পোঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্টাফরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কনুই ঠেকিয়ে উইশ করা শেষ করে বসলাম তাদের সঙ্গে মিটিং করতে। সবারই কিছু না কিছু বলার আছে। একে একে সবার কথাই শুনলাম। দু তিনজন প্রেগন্যান্ট স্টাফকে ইবোলা ঝুঁকি এলাকায় কাজ করতে যেতে নিষেধ করলাম। তাদের অন্য ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করার নির্দেশ দিলাম। কিন্তু তারা অন্য কোথাও যেতে রাজী নয়। তারা জানালো, সরাসরি ইবোলা কাজে না রাখলে তারা এলাকা ছেড়ে যাবে না। অবাক হলাম, গর্ব হল, একটু লজ্জা লাগলো। যদিও কোন ট্র্যাভেল ব্যান করা হয়নি তবু হেড অফিস থেকে স্টাফরা এলাকায় আসতে দ্বিধা করছিলো। সঙ্গে করে দুইজন ম্যানেজারকে নিয়ে এসেছিলাম যাতে তারা সরেজমিনে দেখে গিয়ে অন্য নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার ব্যাপারে সক্রিয় হয়। যদিও ডোনারদেরকে জানানো হয়েছে যে ইবোলার কারণে নিয়মিত কার্যক্রম একটু স্লো হবে।

রাতে যে হোটেলে থাকলাম, সেখানে দেখি ঢুকার মুখেই হাত ধোওয়ার জন্য সাবান জল রাখা। সেই হোটেলেই অন্য সংস্থার আরেকজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। কনুই ঠেকিয়ে কোলাকুলি করলাম।

পরেরদিন সরকারি কো-অরডিনেশন মিটিংয়ে গেলাম। সে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। ইবোলা প্রতিরোধে ডিসট্রিক্ট চিফ এডমিন অফিসার নাকি হেলথ ডিপার্টমেন্ট লিড রোল নেবে তাই নিয়ে দড়ি টানাটানি। এর মধ্যেই কাম্পালা থেকে প্রজ্ঞাপন এলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু লিড মন্ত্রণালয় তাই জেলা আর সাব-কাউন্টিগুলিতেও হেলথ ডিপার্টমেন্ট লিড নিবে। ইবোলা প্রিভেনশন ফান্ডে সরকারের তরফে এনজিওদের কাছে নগদ টাকা দিতে অনুরোধ করা হচ্ছিলো কিন্তু সম্ভাব্য তসরুপের কথা বিবেচনায় এনে এনজিওরা কেউই নগদ নয় বরং প্রতিরোধ সামগ্রী, লজিস্টিকস এবং ট্রেনিং দিতে ইচ্ছুক। এসব নিয়ে খানিক দর কষাকষি। শেষ পর্যন্ত এনজিওদের দাবীই মেনে নিলো সরকার পক্ষ তবে একটা শর্ত যে ট্রেনিং ইত্যাদিতে সরকারি অংশগ্রহণকারীদের যাতায়াতের বাজেট বাবদ নগদ দেয়া হবে।

বিকেলে গেলাম আমাদের হেলথ প্রোগ্রাম দেখতে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে আমাদের স্বাস্থ্য সেবিকারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এখন আবার তারা ইবোলা প্রতিরোধে একদম ফোরফ্রন্ট বা যুদ্ধের অগ্রগামী সৈন্যের ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, ব্র্যাক উগান্ডার স্বাস্থ্য সেবিকারা সবাই নারী।

আমি যে গ্রামে গেলাম, তা কঙ্গো সীমান্ত থেকে মাত্রই সাত কিলোমিটার দূরের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। আমাদের স্বাস্থ্য সেবিকা ফেইথ (সঙ্গত কারণে ছদ্মনাম), বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, চার সন্তানের মা। বলাই বাহুল্য, স্বামী আরেক নারী নিয়ে আরেক জেলায় সংসার করছেন, আর এদিকে ফেইথই সন্তানদের পালন করছেন। আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় বছর পাঁচেক। উল্লেখ করা জরুরি, এই কমুনিটি হেলথ প্রমোটার বা সাস্থ্যসেবিকারা কিন্তু নিয়মিত বেতনভুক্ত স্টাফ নন, তারা তাদের কাজের জন্য বেতন নয়, কিছু সম্মানী পেয়ে থাকেন, এবং সেটাও সামান্য অংকের টাকা। আমি ফেইথকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইবোলা সংক্রান্ত কাজ করতে তার কি ভয় লাগছে? কিছু ইংরেজি আর কিছু সোয়াহিলি মিশিয়ে তিনি জানালেন, প্রথমে তার ভয় করছিলো, এমনকি ভেবেছিলেন কাজটি করবেন না। কিছু দিনের জন্য তার মায়ের কাছে অন্য জেলায় চলে যাবেন। কিন্তু ট্রেনিংয়ে যখন জানতে পারলেন, উপযুক্ত সাবধানতা নিয়ে কাজ করলে ভয়ের কারণ নেই, তখন একজন বিশ্বাসী ক্রিস্টান হিসাবে মানুষের জীবন রক্ষা করা তার দায়িত্ব। নিশ্চয়ই লর্ড (যিশু) তাকে নিয়োজিত করেছেন এই কাজে নইলে তিনি ব্র্যাকের সঙ্গে জড়িত হবেনই বা কেন আর এই ট্রেনিং ই বা পাবেন কেনো? তার মানে হচ্ছে এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। তার সাধ্যের মধ্যে তিনি মানুষের কাছে ইবোলা ঘাতকের সংহার থেকে বাঁচার মন্ত্র পোঁছে দিচ্ছেন। অবশ্যই যীশু তার সঙ্গে আছেন, আর তিনি (ফেইথ) জয়লাভ করবেন। তার ছোট ছেলেটি মৃত কঙ্গোলিজ শিশুটির সমবয়সী। মৃত শিশুটির মায়ের কাছে কোনও তথ্যই ছিলো না বলেই শিশুটি অকালে মরে গেলো। কিন্তু তার (ফেইথের) কাছে মন্ত্র (ট্রেনিং) আছে, আছে অস্ত্র ( গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার), তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন যাতে অজ্ঞতার কারণে আর কোন শিশু ইবোলায় মারা না যায়। ইবোলা ঘাতক বটে, তবে ঈশ্বর মানুষের সহায়। “আই উইল ট্রাই টিল মাই লাস্ট এন্ড ইবোলা মাইট বি আ কিলার ডিজিজ, বাট নট মাইটিয়ার দ্যান লর্ড। এজ লর্ড হ্যাজ চুজেন মি টু হেল্প পিপল সো হি (লর্ড) উইল মাই সেভিওর। এন্ড লর্ড সেন্ডিং হিজ মারসি ইন দি ফরম অব ইনফরমেশন এন্ড সাপোর্ট থ্রু ব্র্যাক। উই থ্যাঙ্ক ব্র্যাক ফ্রম দি কোর অব আওয়ার হার্ট!”

সকালের মিটিংয়ে সরকারি দফতরের কর্মকর্তাদের নগদ টাকা নিয়ে খানিক লোভী আচরণ আমাকে আহত করেছিলো। ফেইথের কথায় সেই ঘায়ে মলম পড়লো বটে তবে নতুন করে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। আমার মত তথাকথিত পদমর্যাদার কর্মকর্তা যাদের ইবোলা সংক্রমণের আশংকা একদমই মৃদু মাত্রার, তার পরেও কত ধরনের প্রিভেনশন এমনকি ইবোলা ছড়িয়ে পড়লে ইমারজেন্সি ইভাকুয়েশনের ত্বরিত ব্যবস্থা তৈরি রাখা সহ আরও কত কিছু।

ওদিকে এমনকি আমার ফিল্ড স্টাফরাও নিজের জনপদের ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে চায় না, কারণ মানুষকে সাহায্য করা তারা তাদের কর্তব্য ভাবে। কেনো আমি বিশ্বাস করতে পারি না ঈশ্বর আমাকে নিযুক্ত করেছেন মানুষকে সাহায্য করার জন্য তাই ঈশ্বরই আমাকে রক্ষা করবেন?

পুনশ্চ: মোট পাঁচজন ইবোলা রোগী পজিটিভ সনাক্ত হয়েছিল তাঁদের সবাই মারা গেছেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে সীমান্তবর্তী আরুয়া জেলাতে নতুন ইবোলা রোগী সনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কঙ্গোর ইবোলা মহামারিকে পৃথিবীর জন্য এক ‘গ্লোবাল হেলথ চ্যালেঞ্জ’ বলে ঘোষণা করেছে। ব্র্যাক উগান্ডার ইবোলা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালু আছে পুরোদমে। ফেইথ সুস্থ আছেন এবং কাজ করে যাচ্ছেন।

লীনা হাসিনা হক, উন্নয়নকর্মী,

কাম্পালা, উগান্ডা।

ইমেইল: [email protected] 

ইবোলা ইবোলা ভাইরাস আফ্রিকা কাম্পালা উগান্ডা

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর