বিশ্বে অনলাইন সংবাদে ভরসা বাড়ছে, আমরা কী উল্টো হাঁটছি?
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৮:১৩
বিশ্বের ৬২ শতাংশ মানুষ এখন মনে করছে, ডিজিটাল মিডিয়া তাদেরকে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে খুব ভালো করেই আপডেটেড রাখতে পারছে। আর নিউজ মিডিয়াগুলো ব্রেকিং নিউজ সরবরাহেও ভালো করছে। খবরের ব্যাখ্যার চেয়ে খবরটি জানিয়ে দিতে তারা আস্থার সাথে কাজ করতে পারছে (সূত্র: রয়টার্স ইনস্টিটিউট ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট ২০১৯)। আর এটি গবেষণালব্ধ তথ্য। বিশ্বের ৬০টি দেশে পাঠক পর্যায়ে গবেষণা করেই রয়টার্স ইনস্টিটিউট এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সুতরাং ‘অনলাইনের কাজ হলো চাঞ্চল্য তৈরি করা। আর তাদের দ্রুত ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। ফলে খবরটা আদৌ সত্য কি না, যাচাই করা হয়ে ওঠে না,’— এমন মন্তব্য কোনোভাবেই ধোপে টিকবে না।
আমরা খুব আঁকড়ে ধরে থাকতে পছন্দ করি। আমরা যে যেখানে থাকি, সে সেখানকারই লোক হই, কিংবা হয়ে যাই। এসবে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের আরেকটি স্বভাব খুব করে রয়েছে— অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। একটু কঠোর ভাষায় বলতে গেলে ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে যখন আমরা জ্ঞান রাখি না কিংবা আমরা যখন একটু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মৌলবাদী অবস্থানটি নিয়ে নেই, তখনই ওইসব প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ প্রয়োগ করে নিজেকে খুব জাহির করার চেষ্টা করি। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে অন্যকে হেয় করতেও দ্বিধা করি না। এতে নিজের দৈন্যই স্পষ্ট হয়।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে বক্তব্যটির পরের অংশ হচ্ছে— ‘তারা প্রথমে খবর প্রকাশ করে, অনেক সময় পরে যাচাই করে। যদি দেখে খবরটা ভুল, তাহলে তা প্রত্যাহার করে।’ অনলাইন সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে এমন ঢালাও মন্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় বৈকি।
গবেষণাও তো প্রমাণ দিচ্ছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অনলাইন পাঠক এখন ব্রেকিং নিউজের জন্য অনলাইনকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছে। আর তাতে ধীরে ধীরে খবরের কাগজের ওপর নির্ভরতা কমছে। খবর জানতে পরের দিন সকালের সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে থাকবে— এমন মানুষ হয়তো পৃথিবীতে এখন কমই পাওয়া যাবে।
সমস্যাটিও হয়তো সেখানেই। হয়তো সেটা ঈর্ষারও উৎস। ‘বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, সুন্দর হই’ শিরোনামে দেশের একটি দৈনিকে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত ওই মন্তব্য প্রতিবেদনে সেটাই স্পষ্ট করা হয়েছে। কারণ মন্তব্যটির শেষাংশে লেখা হয়েছে— ‘ছাপা কাগজে এমন সুযোগ নেই। প্রমাণ পাওয়ার পরই কেবল কাগজে খবর ছাপা হয়।’
এ বিষয়ে আলোচনায় একটু পেছনে ফিরতে চাই। নিচের উক্তিটি পড়ুন—
‘প্রতিদিন সকালবেলা আমি একটা খবরের কাগজ পড়ে একটি ঘটনা সম্পর্কে তথ্য পাই বা জানি, আরেকটি খবরের কাগজ পড়ে একই বিষয়ে একটি ভিন্ন তথ্য পাই, আর তৃতীয় সংবাদপত্রটি পড়ে ঘটনাটি সম্পর্কে কনফিউজড হয়ে যাই।’
উক্তিটি অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানের। কথাটি আমি স্মৃতি থেকে লিখছি। তবে শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, কথাটি এমনই ছিল। এবং আজ টেলিফোনে কথা হলে অধ্যাপক গোলাম রহমান জানালেন, উদ্ধৃতিটি এমনই ছিল। সংবাদপত্র, তথা গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনায় তিনি অনেকবারই কথাটি বলেছেন।
অধ্যাপক গোলাম রহমান দেশের অন্যতম গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। দেশের তথ্য কমিশনের প্রধান তথ্য কমিশনারের দায়িত্বও পালন করেছেন। সুতরাং তার বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। যদি তাই হয়, তথ্যবিভ্রাট সংবাদপত্রের যুগেও ছিল। সুতরাং প্রিন্ট ইজ প্রুফ, সে কথা সত্য বটে, কিন্তু সংবাদপত্র ভুলভাল খবর দেয় না, তা নয়।
সাংবাদিকতার চর্চা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই বেশি হচ্ছে। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও হচ্ছে ওই তথ্যবিভ্রাট নিয়েই। তথ্যবিভ্রাট ঘটছে এবং তা একটু বেশিই ঘটছে— তাকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটি নতুন মাধ্যমকে অনেকটা ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে কথা আর কারই না জানা। বোঝাই যাচ্ছে, সে সময়টিও এখন অনলাইন সংবাদমাধ্যম পার করে ফেলেছে। রয়টার্স ইনস্টিটিউটের গবেষণা তারই প্রমাণ।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিয়ে সাধারণের ধারণা সামান্যই। কোনটা কোন মিডিয়া? কোনটা সংবাদমাধ্যম? কোনটা সংবাদমাধ্যম নয়?— এগুলো এখনো অনেকেরই বোঝার বাকি। ফলে ঢালাও মন্তব্য করা হচ্ছে।
আরও তথ্য হচ্ছে, বিশ্বের ২৬ শতাংশ মানুষ কিছু কিছু অনলাইনের খবরে তাদের পূর্ণাঙ্গ আস্থা নিতে শুরু করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রেতো এই সংখ্যা ৪০ শতাংশ।
আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি, বিশ্বের মানুষ ধীরে ধীরে অনলাইন সংবাদপত্র সাবস্ক্রাইব করে পড়তে শুরু করেছে। সংখ্যা কিংবা হারটি কম। তবে এটি একটি ট্রেন্ড। একসময় মানুষ খবরের কাগজ যেমন কিনে পড়েছে, তারা অনলাইনে খবর পড়বে পয়সা খরচ করে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সেজন্য সময় লাগবে। রয়টার্স ইনস্টিটিউটের ওই গবেষণাই বলছে, নরওয়ের ৩৪ শতাংশ পাঠক এখন অনলাইনে অর্থ খরচ করে খবর পড়ে, ২০১৬ সালে যা ছিল ২৪ শতাংশ। সুইডেনে২০১৯ সালে এই সংখ্যা ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, ২০১৬ সালে যা ছিল ২০ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭ সালে এ ক্ষেত্রে একটি বড় উল্লম্ফন হয়। সেই হিসাবে এখন সে দেশের ১৬ শতাংশ পাঠক অনলাইনে খবর পড়তে অর্থ ব্যয় করছেন, ২০১৬ সালে সে সংখ্যা ছিল ১০ শতাংশ।
এছাড়াও ২০১৯ সালে এসে ফিনল্যান্ডের ১৬ শতাংশ, ডেনমার্কের ১৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার ১৪ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডের ১২ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসের ১১ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের ১১ শতাংশ, স্পেনের ১০ শতাংশ, অস্ট্রিয়া ও কানাডার ৯ শতাংশ এবং জাপানের ৭ শতাংশ পাঠক অর্থ ব্যয় করেই অনলাইনে খবর পড়ছে।
তবে এখানে একটি কথা রয়েছে— এই পাঠকরা অনলাইনে অন্তত একটি খবরের মাধ্যমকে সাবস্ক্রাইব করেছেন, বাকিগুলো হয়তো বিনা পয়সাতেই পড়েন।
সে যাই হোক, এটা একটা প্রবণতা। পাঠক যখন কোয়ালিটি কনটেন্ট পাবে, তখন তার জন্য অর্থ ব্যয় করবে; সঠিক সময়ে সঠিক খবরটি পাবে, তার জন্যও অর্থব্যয় করবে— এটা অবাস্তব বা অলীক কোনো কল্পনায় আর আটকে নেই। ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমই ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে মানুষের সংবাদপাঠের আশ্রয়স্থল।
এতে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো সাহসীও হয়ে উঠছে। ‘গুড জার্নালিজম’-এর নিশ্চয়তা দিয়ে তারা ফ্রি কনটেন্ট সুবিধাও আটকে দিচ্ছে। নরওয়ের পাঠকরা তো বলেছেন, তারা আর সহজেই সবকিছু ফ্রি পাচ্ছেন না। অন্তত ৭০ শতাংশ পাঠক অনলাইনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা আকর্ষণীয় খবরে ক্লিক করে তাতে বাধা পেয়েছেন। বলা হচ্ছে, সাবস্ক্রাইব করলেই তা কেবল পড়া যাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রে এমনটা ঘটেছে ৫০ শতাংশ পাঠকের ক্ষেত্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক টাইমসের এখন সাবস্ক্রাইবার দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রয়েছে ১৫ লাখ, আর ওয়াশিংটন পোস্ট অনলাইনে কিনে পড়ছেন ১২ লাখ পাঠক।
নরওয়ের দু’টি অনলাইন ভারভেনস গ্যাং ও অ্যাফেনপোস্টেন-এর অনলাইন সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৬০ হাজারের কাছাকাছি। আর সুইডেনের দু’টি অনলাইন সংবাদপত্র অ্যাফটনব্ল্যাডেট ও ড্যাজেস নাহিতারের সাবস্ক্রিপশন ৪ লাখ ১০ হাজারে পৌঁছেছে।
এই গবেষণায় ‘খবরের জন্য প্রথম’ কোন মাধ্যমে মানুষ নির্ভর করছে, তারও একটি তথ্য নেওয়া হয়। আর তাতে দেখা গেছে— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে মানুষ এখন কমই রেডিও, টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রথম চোখ রাখছে। ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে মোবাইল ফোনে প্রথম চোখ রাখার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আর এর মধ্যে খবরের জন্য স্মার্টফোনটি দেখছেন অন্তত ২৮ শতাংশ মানুষ।
এসব পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে— আমাদের আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। অনলাইন সংবাদমাধ্যমেই আসছে ভরসা। ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ’ বলে যে কথাটি রয়েছে, সেটি যুগের আর প্রযুক্তির পরিবর্তনের তোড়ে পৃথিবীর আরও অনেক কিছুর মতোই পুরনো, সেকেলে ও ধীরে ধীরে অপ্রয়োজনীয় উক্তিতে পরিণত হতে শুরু করেছে।
তবে সবকিছুর আগে দরকার মিডিয়া লিটারেসি। সাধারণের মাঝে তা যত বাড়বে, ততই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। তবে যারা নানা কারণে সমাজে অগ্রসর বলে সমাদৃত, তারা যখন মিডিয়া সাক্ষরতার জ্ঞানহীনতায় ভোগেন, তখন হতাশা তৈরি হয়।
ভালো সাংবাদিকতা, উন্নত সাংবাদিকতা, মানসম্মত সাংবাদিকতা— এসব ধীরে ধীরে নিশ্চিত হবে আমাদের সাংবাদিকতা চর্চাতেও। তাতে ধীরে ধীরে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। তখন আর প্রিন্ট ইজ প্রুফ বলে শত চিৎকার করেও মানুষকে ঘুম ভাঙার পর খবরের কাগজের দিকে টেনে রাখা বোধ হয় একটু কমই যাবে।
শেষ কথা হচ্ছে— বইয়ের আবেদন, প্রিন্ট মিডিয়ার আবেদন একেবারে ফুরিয়ে যাবে, তা বলার জো নেই। ওগুলোও থাকবে এবং ভালোভাবেই থাকবে। কিন্তু বই, আর সংবাদপত্রের কথা বলতে গিয়ে অনলাইন সংবাদপত্রকে খাটো করে দেখা কোনো কাজের কথা নয়। মনে রাখতে হবে— এখানেও সাংবাদিকতারই চর্চা চলে, সাংবাদিকতার সব নীতি-নৈতিকতা মেনেই চলে। কেবল মাধ্যমটি ভিন্ন।
আরেকটি কথা, গার্বেজ কনটেন্ট— সে তো সংবাদপত্রের যুগেও ছিল, এখনও রয়েছে। পাঠক তৈরি হলে তারাই বেছে নিতে পারবে কোনটা সঠিক, কোনটা ঠিক নয়, কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট