যুদ্ধের ভূগোল: ইরানের কাছে হেরে যাচ্ছে আমেরিকা
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:০৫
আমার কাছে অনেকে জিজ্ঞেস করে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে বহুসংখ্যক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটি মূলত ইরানকে লক্ষ্য করেই তৈরি করেছে আমেরিকা। এসব ঘাঁটি থেকে আমেরিকা যদি ইরানের ওপর হামলা চালায় তাহলে ইরান কিভাবে টিকে থাকবে?
আমি যেহেতু ইরানের থেকেছি এবং সেখানে থেকে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি। ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যেহেতু আমি কিছু লেখালেখি করি সে কারণে এসব মানুষ হয়তো ভরসা করেন—আমার কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য পাওয়া সম্ভব, যেটা পশ্চিমা গণমাধ্যম বা পশ্চিমা প্রভাবিত মাধ্যম থেকে সম্ভব নয়। আমার কাছে যেসব মানুষ এই প্রশ্ন করেন, বুঝতে পারি- তাদের ভেতরে ইরানের প্রতি এক রকমের ভালোবাসা আছে; তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগও আছে। এসব মানুষ মনে করেন, আমেরিকার মতো বৃহৎ শক্তির সামনে আসেলই কি ইরান টিকে থাকতে পারবে? ইরানের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা মূলত আমেরিকাই তৈরি করেছে। আমেরিকা যেহেতু সারা বিশ্বে, বিশেষ করে বহুসংখ্যক মুসলিম দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে, সে কারণে ইরান-আমেরিকা সম্ভাব্য যুদ্ধে ইরানের জনগণের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা ভালোবাসার বলয় তৈরি হয়ে যায়। নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসা মনের অজান্তেই তৈরি হয়ে যায়। মুসলিম সেন্টিমেন্ট তো আছেই।
যাইহোক, এ আলোচনার গভীরে ঢোকার আগে আমরা একটু জেনে নিই মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশে আমেরিকার ঘাঁটি আছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় মোট ১৪টি দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটি অবশ্যই ইরানকে লক্ষ্য করে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যে কয়টি দেশের সঙ্গে ইরানের সরাসরি স্থল সীমান্ত রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক ও ইরাক। এছাড়া মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। পাশাপাশি পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ পাড়ে ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন ও সৌদি আরবে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সামরিক ঘাঁটি রয়েছে জর্দানে এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়- অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডেও আমেরিকার একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এছাড়া লেবাননে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে।
এই যে এতগুলো দেশে মার্কিন ঘাঁটি এর সবগুলো দেশ ইরানের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে একেবারে ইরানকে ঘিরে এবং প্রত্যেকটি ঘাঁটি ইরানকে লক্ষ্য করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে মার্কিন সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন এবং এর ভয়াবহতা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, ইরাকে প্রত্যক্ষ করছে, আফগানিস্তানেও প্রত্যক্ষ করছে।
যাইহোক এই যে ইরানকে ঘিরে ধরেছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো, এসব ঘাঁটি কি আসলে ইরানের বিরুদ্ধে খুব কার্যকরি কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে, এমন প্রশ্ন কিন্তু অযৌক্তিক নয়। আমি সবসময় একটা কথা বলি যে; আমেরিকা বা ইসরাইল অথবা ইরানের অন্য কোনো শত্রু দেশ যদি নিশ্চিত হতে পারতো—ইরানের ওপর হামলা করে পার পাওয়া যাবে তাহলে তারা এক সেকেন্ডও দেরি করতো না ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালাতে। এই কথাটি কোনো আবেগ বা উচ্ছ্বাসের কথা নয়, এটি এ সময়ের বড় বাস্তবতা।
চলতি নিবন্ধটির শিরোনাম করেছি- ‘যুদ্ধের ভূগোল: ইরানের কাছে হেরে যাচ্ছে আমেরিকা’ এই শিরোনামের বাস্তবতা কি? আসলে যেসব মানুষ প্রশ্ন করেন যে মার্কিন এতসব ঘাঁটি থেকে হামলার মুখে ইরান টিকে থাকতে পারবে তো তারই জবাব দিয়েছি মূলত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই শিরোনামের ভেতর দিয়ে। এখন বলি কিভাবে এটি সম্ভব অর্থাৎ এতগুলো মার্কিন ঘাঁটি থেকে সামরিক হামলার মুখে ইরান কিভাবে টিকে থাকবে। বাস্তবতা হচ্ছে- এসব দেশে মার্কিন ঘাঁটি থাকলেও প্রত্যেকটি দেশের ঘাঁটিকে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না।
প্রথমেই বলি ইরাকের কথা। ইরাকের অন্তত ১২টি মার্কিন ঘাঁটি আছে। এসব ঘাঁটি থেকে অবশ্যই ইরানে হামলা করা সহজ এবং মার্কিন বাহিনীকে যদি নিরাপদে ইরানে হামলা করতে হয় তাহলে ইরাক থেকেই হামলা করতে হবে। যেকোনো বাহিনীর জন্য স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে একটি নিরাপদ সীমান্ত প্রয়োজন হয়। সে জায়গা থেকে ইরাক হতে পারতো মার্কিন বাহিনীর জন্য অত্যন্ত আদর্শ একটি সীমান্ত, যেখান থেকে তারা ইরানে স্থলে অভিযান চালাতে পারতো। কিন্তু মার্কিন সরকারের বিধি বাম! ইরাকে বর্তমানে যে জোট সরকার রয়েছে, তারা বারবার বলছে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ ও প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল মাহদি থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এবং বহুসংখ্যক সংসদ সদস্য বারবার বলছেন যে, ইরাক থেকে মার্কিন সেনা বহিষ্কার করতে হবে এবং ইরাকের ভূমিকে অবশ্যই ইরানের বিরুদ্ধে হামলার জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তাহলে ইরাকে আমেরিকার যে ১২টি ঘাঁটি রয়েছে সেই ঘাঁটি প্রকৃতপক্ষে ইরান-বিরোধী যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে কোনো সহায়তা দিতে পারবে না।
এবারে আফগানিস্তানের ঘাঁটিগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন এমন যে, তালেবানের সঙ্গে আমেরিকা চুক্তি করছে। এরইমধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর খবর এসেছে, তালেবানের সঙ্গে চুক্তির আওতায় আফগানিস্তানের পাঁচটি ঘাঁটি থেকে আমেরিকা তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। আপনারা নিশ্চয়ই এরইমধ্যে জেনেছেন যে, আফগান তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার যে শান্তি আলোচনা হচ্ছে সেখানে তালেবানরা প্রধান শর্ত দিয়েছে- আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করলে তবেই তারা শান্তি চুক্তি সই করবে। তার মানে হচ্ছে আফগানিস্তানে যদি তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে হয় আমেরিকাকে এবং তারা করবেও বটে; তাহলে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা থাকতে পারবে না। অতএব, ইরানের সঙ্গে যদি আমেরিকার যুদ্ধ বাধে তাহলে আফগানিস্তানে এখন যে সমস্ত ঘাঁটি আছে সেগুলোর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
এবার আরেক প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকানো যাক। গত বেশ কয়েক বছর ধরে পাকিস্তান ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে আসছে। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তান সরাসরি ইয়েমেনে যুদ্ধে সৌদি জোটে যোগ দেয়নি। এছাড়া পাকিস্তান তালেবান ও উগ্র কথিত ইসলামপন্থীদের নিয়ে ক্লান্ত। এরইমধ্যে ইরান, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া মিলে একটি বৃহৎ জোট গঠনের চেষ্টা চলছে এবং এই বলয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় আফগানিস্তানও থাকবে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান ইরানের বিরুদ্ধে হামলা করার জন্য মার্কিন বাহিনীকে তার ঘাঁটি বা তার দেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ দেবে এটা ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই। এছাড়া পাকিস্তানে কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ শিয়া মুসলমানের বসবাস। পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে আমেরিকা যদি ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালায় তাহলে এসব শিয়া মুসলমানকে ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে পাকিস্তান সরকারের জন্য। অতএব, পাকিস্তান এই ভুল করবে না।
এবার আসি মধ্যপ্রাচ্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং ইরানের একেবারে সীমান্তবর্তী দেশ তুরস্কে। তুরস্কে সরাসরি মার্কিন ঘাঁটি নেই, তবে তুরস্কের কয়েকটি ঘাঁটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে। তুরস্ক যেহেতু ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য সেই কারণে তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে। খুব সম্প্রতি তুরস্কের সঙ্গে কয়েকটি ইস্যুতে আমেরিকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এতে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে। রাশিয়া থেকে এস- ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার কারণে আমেরিকা তুরস্ককে এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান দিতে চায়নি। অথচ এই বিমান কেনার ব্যাপারে এরইমধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছে তুরস্ক। আমেরিকার সঙ্গে বর্তমানে যে সংকট তৈরি হয়েছে সেই জায়গায় আমেরিকার সমস্ত অনুরোধ-উপরোধ এবং হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে তুরস্ক রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কিনেছে। নিষেধাজ্ঞার হুমকি উপেক্ষা করে তুরস্ক বলেছে যে, আমেরিকা যদি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান না দেয় তাহলে রাশিয়া থেকে তারা পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ বিমান এসইউ-৫৭ কেনার বিষয়টি বিবেচনা করবে। আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক কিন্তু এখন মোটেই স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই সে কথা আগেই বলেছি। এরইমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেই নিষেধাজ্ঞায় শরিক হতে চায়নি তুরস্ক। বরং তারা বলেছে, ইরান থেকে আংকারা তেল কেনা অব্যাহত রাখবে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে চাইলে আঙ্কারা তাতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন এরা কি করবে ইরান ইস্যুতে? ইরান ইস্যুতে কুয়েত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারা মধ্যস্থতা করে থাকে। এ অবস্থায় কুয়েতের অবস্থান কি হবে তা বলা মুশকিল। তবে সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাহরাইনে মার্কিন বাহিনীর পঞ্চম নৌবহর রয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি। সেটিই হবে ইরান-বিরোধী যুদ্ধের প্রধান ‘লাঞ্চপ্যাড’।
কাতারে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিমান ঘাঁটি। তবে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনে কাতার আমেরিকাকে সে ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর সম্মিলিতভাবে একযোগে কাতারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর পরপরই কাতারের পাশে যে দেশটি মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল সেটি হচ্ছে ইরান। ইরান তার খাদ্যসামগ্রী, সেবাপণ্য ও প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনো আছে। দিন দিন কাতারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক দারুণভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে। কাতারের জন্য ইরান তার নিজের আকাশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে- সে কথা আপনারা নিশ্চয় সবাই জানেন।
কাতার এয়ারলাইন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান সংস্থা কিন্তু সৌদি নেতৃত্বাধীন অবরোধের কারণে কাতারের বিমান কোনো দিক দিয়ে বের হতে পারছিল না। পূর্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে সৌদি আরব এবং বাহরাইন। কাতারের সামনে শুধুমাত্র খোলা ছিল উত্তরে পারস্য উপসাগরের আকাশ। এ অবস্থায় ইরান তার আকাশসীমা উন্মুক্ত করে দিয়ে কাতারকে বিমান সেবা চালু রাখার সুযোগ করে দেয়। সেক্ষেত্রে কাতারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই ইরানের এসব সাহায্য-সহযোগিতার কথা বিবেচনায় নেওয়া হবে।
ওমানও ইরান ইস্যুতে অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে এবং এই দেশ অনেক ক্ষেত্রে কুয়েতের মতো মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে তাদের ঘাঁটি আমেরিকাকে ব্যবহার করতে দেবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
এবার আসা যাক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং কিরগিজস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে এবং সেখানে কয়েকটি ঘাঁটি আছে। কিন্তু এ সমস্ত দেশে যে প্রেক্ষাপটে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এখন সে প্রেক্ষাপট অনেকটা ম্লান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা যে এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিল তাতে মার্কিন বলয়ে অবস্থান নিতে পারাটাই ছিল কারও কারও জন্য অনেকটা গর্বের ব্যাপার। বহু দেশ নিজেকে নিরাপদ করার জন্য এ কাজ করেছিল। কিন্তু এখন সে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। এখন রাশিয়া-চীন-তুরস্ক-ইরান এই বলয়ের দিকে ঝুঁকছে অনেকে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কোনো কোনোটি তেলসমৃদ্ধ যার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আবার এর প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে চীন ও ইরানের সম্পর্ক ভালো। সে ক্ষেত্রে এ সমস্ত দেশের ঘাঁটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হলে এইসব দেশের ভূখণ্ড অনিরাপদ হয়ে উঠবে। রাশিয়ার জন্যও অস্বস্তিকর। এসব বিষয় বিবেচনায় রাখবে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। নিজের প্রভাবও কাজে লাগাবে ইরানের মিত্র রাশিয়া। এছাড়া, বিশ্বের পুঁজিপতি নেতারা যুদ্ধ চাইবেন না কারণ আমেরিকার সঙ্গে ইরানেরে যুদ্ধ শুরু হলে ইরান প্রথমেই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে যা সারা বিশ্বের তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট।
সামগ্রিক আলোচনা থেকে যে কথাটি পরিষ্কার হয় তা হচ্ছে- এই সমস্ত ঘাঁটি থেকে আমেরিকা অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতা পাবে না; আর যদি সহযোগিতা পায় তাহলেও সে সমস্ত দেশ থেকে বিমান হামলা এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো খুব সহজ কাজ হবে না। কারণ ইরানের প্রতিরক্ষা-নীতিতে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ইরানকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবে তেমনি শত্রুর বিরুদ্ধে হামলার জন্যও ব্যবহার করা হবে। সর্বসাকুল্যে এ কথা বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে বহুসংখ্যক ঘাঁটি থাকলেও আমেরিকা সেই সুবিধা খুব বেশি একটা কাজে লাগাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তাকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করতে হবে উন্মুক্ত পারস্য উপসাগরের জলরাশির ওপর। আর পারস্য উপসাগর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে হলে আমেরিকাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ফ্রিগেট, ড্রেস্ট্রয়ার এগুলো ব্যবহার করতে হবে। এসব নৌযানকে ইরান সেকেলে বলে মনে করছে।
মার্কিন নৌবহরের মোকাবেলায় ইরান ব্যাপকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি গড়ে তুলেছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে আমেরিকার জাহাজগুলো টিকতে পারবে কি না তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। ইরান কতটা শক্তি অর্জন করেছে সম্প্রতি তার একটা ছোটখাটো মহড়া দিয়েছে পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশ জাহাজ আটকের সময়। ইরানে হামলার সময় আমেরিকার সামনে নিজের যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান বাঁচানোর প্রশ্ন থাকবে। প্রশ্ন থাকবে মার্কিন সেনাদের জীবন বাঁচানোর। ইরানকে কোনোভাবেই সাদ্দামের দুর্বল ইরাক ভাবলে চলবে না। ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই পারস্য উপসাগর ব্যবহার কোনমতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না-এমনটিই মনে করেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। কারণ আমেরিকার প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ ও প্রতিটি সেনা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে থাকবে। ফলে পারস্য উপসাগর থেকে ইরানে হামলা চালানো সহজ কোনো বিষয় হবে না।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় মার্কিন পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে ঢের প্রশ্ন রয়েছে। ইয়েমেন থেকে হুথি সমর্থিত সেনারা সৌদি আরবে যে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে তা ঠেকানোর ক্ষেত্রে পেট্রিয়ট খুব একটা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। পেট্রিয়ট তৈরি করা হয়েছিল স্বল্প পাল্লার স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলার জন্য। কিন্তু আরও উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন মোকাবেলায় তা খুব একটা কার্যকর নয়।
পাশ্চাত্যের অনেক গবেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞ এই কথা বলছেন যে, ইরানের বিরুদ্ধে পারস্য উপসাগরকে ব্যবহার করে যদি আমেরিকা যুদ্ধ শুরু করে তাহলে জাহাজ ভরে মার্কিন সেনাদের লাশ আনতে হবে। শুধু তাই না, যেসব দেশ বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং সৌদি আরবের মতো যেসব দেশ আমেরিকাকে ইরানে হামলা চালানোর জন্য সাহায্য করবে তাদের দেশের নাগরিক ও তাদের ভূখণ্ড মারাত্মকভাবে বিপদের মুখে পড়বে। একথাটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে যে, ইরানের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিন্তু মোটেই সেকেলে নয় এবং আমেরিকার চেয়ে খুব একটা পিছনে পড়ে নেই। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে ইরান তার প্রমাণ দিয়েছে। যেমন- পারস্য উপসাগরের ইরানি আকাশসীমায় মার্কিন গ্লোবাল হক ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করে এ কাজটি করেছে। আমেরিকা এই ড্রোন তৈরি করে একেবারে নিশ্চিত ছিল যে, এই ড্রোন কেউ শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে না। কিন্তু ইরান খুব সহজেই তা শণাক্ত করে ধ্বংস করেছে। অতএব, আমেরিকার প্রযুক্তির চেয়ে ইরানি অস্ত্র ও ইরানি প্রযুক্তি পিছিয়ে নেই তা তো বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। আরেকটি উদাহরণ দিই। ইরানি ভূখণ্ড থেকে দুই দফায় ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের ভূখণ্ড থেকে ৫০০-৭০০ কিলোমিটার দূরবর্তী অবস্থানে নিখুঁতভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ধার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তাছাড়া একথাও উল্লেখযোগ্য যে, মার্কিন ড্রোন গ্লোবাল হক ভূপাতিত করার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু হামলা শুরুর দশ মিনিট আগে সে নির্দেশ তিনি প্রত্যাহার করে নেন। তিনি দাবি করেন, ইরানের দেড়শ নাগরিক নিহত হবে বলে তিনি হামলার নির্দেশ বাতিল করেছেন। তিনি দাবি করেন, ইরানি নাগরিকদের তিনি হত্যা করতে চাননি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালালে কোনোভাবেই মার্কিন বাহিনী বিপর্যয় এড়াতে পারত না। মার্কিন বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে হামলা করে কোনমতে জীবনে বাঁচা যাবে না। এই হামলা একটুও লাভজনক হবে না, কোনমতেই নিরাপদ হবে না।
ইরানকে মার্কিন বাহিনী সাদ্দামের দুর্বল ইরাক অথবা তালেবানের আফগানিস্তান ভাবতে পারে না। ফলে যেসব মার্কিন ঘাঁটি ইরানের আশপাশে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তৈরি করা হয়েছে, ইরানবিরোধী যুদ্ধে সেসব ঘাঁটি যে খুব একটা কার্যকরী হবে না তা পরিষ্কার হয়ে যায়। আবার এসব ঘাঁটির প্রত্যেকটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে। ফলে একথা বলাই যায় যে, যুদ্ধের ভূগোলে ইরানের কাছে হেরে যাচ্ছে আমেরিকা।
লেখক: রেডিও তেহরানের সাংবাদিক