‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত?’
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৫:১৩
দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিনিধি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়শই বিভিন্ন কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়। আর সেই সংবাদ কাভার করেন গণমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা। শতভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশেষ করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়, সে বিভাগের শিক্ষার্থীদের যারা ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা করতে চান; তারা বিশ্ববিদ্যালয়েই সাংবাদিকতায় হাত পাকান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদের অনেকেই ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা করেন, অনেকে আবার পেশা বদলে ফেলেন। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিতের অনেকেই এখন দেশসেরা সাংবাদিক। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই তারা ভালোভাবে হাত পাকাতে পেরেছিলেন। তবে বিষয়টা যখন সাংবাদিকতা, তখন সবক্ষেত্রেই তা একই নিয়ম মেনে হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদেরও সেই নিয়ম মেনেই সাংবাদিকতা করতে হয়।
শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা দুইই আছে। সুবিধা হলো, সেই শিক্ষার্থী তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়ি-নক্ষত্র সব জানবে, পথঘাট চেনে। আবার অসুবিধা হলো, কোনো রিপোর্ট বিপক্ষে গেলে ক্ষুব্ধ হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা কোনো শিক্ষক বা উপাচার্য। আর একজন শিক্ষার্থীকে টাইট দেয়ার মত অসংখ্য অস্ত্র আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে। পরীক্ষায় নাম্বার কম দেওয়া থেকে শুরু করে বহিস্কার করা- অস্ত্রের কমতি নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো সাংবাদিকতা করা সত্যি কঠিন। এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইলি সানের প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য তিনি অনুসন্ধান করছিলেন। নানা খোঁজখবর করছিলেন, নানা জনের সাথে কথা বলছিলেন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সোর্সের সাথে তার ইনবক্স আলাপ অন্যায়ভাবে ফাঁস করে, সেটাকে অজুহাত হিসেবে দাড় করিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।
অবশ্য গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বহিস্কার রোগ আছে। এ যেন বিশ্ববিদ্যারয় নয়, কারাগার। পান থেকে চুন খসলেই বহিষ্কার বা বহিষ্কারের হুমকি দেয়া হয়। গত এক বছরে ২৭ জন এ ধরনের হুমকি পেয়েছেন। ধানের দাম নিয়ে মানববন্ধন করার অপরাধেও বহিস্কার করা হয়েছে। সেই মানববন্ধনে নাকি সরকারের বিরোধিতা করা হয়েছে। আমার মনে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সরকার বিরোধিতা কবে থেকে অপরাধ? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। সেটা সরকারের পক্ষে যাবে না বিপক্ষে যাবে; সেটা বিচারের ভার কেউ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দেয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। মতপ্রকাশ বিষয়টি তারা বোঝেন বলেও মনে হয় না। ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার অপরাধেও অনেককে বহিস্কারের নোটিশ দেয়া হয়েছে।
ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিস্কারের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করা এবং আগেও বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনকে নিয়ে তার দেওয়া ফেসবুক পোস্ট এবং কমেন্টসে বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করার প্রবণতা পাওয়া গেছে। তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করা হলেও সে সাবধান হয়নি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফেসবুক আইডি হ্যাক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচল অবস্থা সৃষ্টি করার হুমকি দিয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রীতিমত মাস্তানি কায়দায় এক ছাত্রকে মারধোর করে তার মোবাইল ফোন থেকে ইনবক্সের আলাপ নিয়ে আরেক ছাত্রীকে বহিস্কার করাটা বেআইনী। সেই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। আর আপনি যদি খারাপ কাজ করেন, সেটা বললে তো আপনার মানহানি হবেই। মানহানি না হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো অন্যায় কিছু না করা। কোনো কাজ না করেই কোটি কোটি ব্যয়
দেখাবেন আর সেটা বললে আপনাদের হেয় করার অভিযোগ আনবেন, এটা তো হবে না। সাংবাদিকরা সত্যিটা তুলে ধরবেন, সেটা কার পক্ষে না বিপক্ষে সেটা দেখার দায়িত্ব তো সাংবাদিকের নয়। প্রকাশিক সংব্রাদে কোনো ভুল থাকলে, তার প্রতিবাদ করা যাবে, কিন্তু সাংবাদিকতার অপরাধে কোনো শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করা যাবে না।
তবে ফাতেমা-তুজ-জিনিয়ার মূল অপরাধ প্রশ্ন করা। তিনি একটি লেখার তথ্য সংগ্রহ করতে গত ১০ আগস্ট ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রশ্ন রেখেছিলেন ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত?’ তার প্রশ্নে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল না। কিন্তু ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’র মত জ্বলে উঠেছেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন। ২২ আগস্ট জিনিয়া তার অফিসে গেলে উপাচার্য তাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?… ফাজিল কোথাকার…বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তুমি জানো না? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তোমাদের মতো বেয়াদব তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তোর আব্বার কাছে শুনিস। গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন? আমি খুলছি বলেই তো তোর চান্স হইছে। না হলে তো তুই রাস্তা দিয়া ঘুরে বেড়াতি। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে।’ চোরের সাক্ষি যেমন মাতাল। তেমনি সেই উপাচার্যের এই অশালীন বক্তব্যের সাফাই গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আশীকুজ্জামান ভূইয়া বলছেন, ‘কাছের সাংবাদিক
হওয়ার পরেও বিভিন্ন পরিকল্পনা ও বাজেট নিয়ে খোঁজ’ নিতে যাওয়ায় উপাচার্য স্যার একটু বকে দিয়েছেন। পিতা-মাতা রেগে গেলে অটোমেটিক্যালি এরকম হয়ে যায়।’
প্রথম কথা হলো, সাংবাদিকরা কখনোই কারো কাছের বা দূরের হননা। তারা সত্যিটা লেখেন। আর মূল কথা হলো উপাচার্য যে ভাষায় একজন শিক্ষার্থীর কথা বলেছেন, তাতে এক্ষুনি তাকে অপসারণ করা উচিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো দূরের কথা, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক হওয়ার অধিকারও তার নেই।
তবে ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া নিজের অজান্তেই একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। আসলেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত? যা হওয়া উচিত, সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে কি এখন আদৌ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আদর করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলি বটে, কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? গবেষণা, জ্ঞান বিতরণের যে ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তা কোথায় আছে? বাংলাদেশে বিশ্বদ্যিালয়ের নামে কিছু বড়সড় কলেজ আছে, যেখান থেকে কিছু চাকরিজীবী বের হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, অর্থের বিনিময়ে রোকেয়া হলে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ নিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন সারাদেশের আলোচনার কেন্দ্রে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ছাত্রনেতাদের কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এলেই মনে হয় শাটল ট্রেন খুলে ফেলা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যেন শিবিরের রগ কাটাকাটি। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় কবে গবেষণা বা জ্ঞান বিষয়ক কোনো
প্রসঙ্গে শিরোনাম হয়েছে? কিছু চাকরিজীবী জানানোই যদি লক্ষ্য হবে, তাহলে আর গালভরা নাম ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ দেয়ার দরকার কি। আরো বেশি ভকেশনাল ইনস্টটিউট বানালেই হয়। সেক্ষেত্রে সত্যিকারের জ্ঞানের চর্চা হবে, গবেষণা হবে, মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচিন্তার বিকাশ হবে; এসন অল্প কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হোক। এখন তো চারপাশে শুধু বদ্ধ জলাশয় দেখি, জ্ঞানের সাগর কই?
ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে ধন্যবাদ, এই প্রশ্নটি তোলার জন্য। আমি চাই আমাদের শিক্ষাবিদরা এই প্রশ্নের উত্তর খুজে বের করুন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদন্ড ঠিক করে দিন। খোন্দকার নাসির উদ্দিনের মত কেউ যেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে না পারেন। সরকার বিরোধিতাকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়, এমন কোরনো প্রতিষ্ঠানের নাম যেন বিশ্ববিদ্যালয় না হয়।