লাইট অ্যান্ড সাউন্ড থিউরি, এতিমখানা ও কতিপয় গাঁজাখুরি গপ্প
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৫৯
কক্সবাজারের নতুন প্রপার্টিগুলোর মধ্যে সায়মন হোটেল অন্যতম। এইতো সেদিন তিন বছর পূর্তি উদ্যাপন করল হোটেলটা। কাকতালীয়ভাবে আমরাও তখন কক্সবাজারে। রোহিঙ্গাদের মাঝে লিভার রোগের প্রাদুর্ভাবের উপর মাঠ পর্যায়ের একটা সার্ভের জন্য আমাদের কক্সবাজারে আগমন। কাজের ঠেলায় সমুদ্রে ডুব দেয়াতো দুরে থাক, মেরিন ড্রাইভ ধরে কুতুপালং যাওযা-আসা ছাড়া সমুদ্রের দর্শনও করা হযে ওঠেনি। মনটা সঙ্গত কারণেই যথেষ্ট খারাপ। সারাদিনের খাটুনি শেষে কক্সবাজারের বিখ্যাত পৌষী রেস্তোরায় ডিনার বাধ্যতামূলক। ডিনার টেবিলেই কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত এক কলিগের মুখে শুনলাম সায়মন হোটেলের বিচ ভিউ আউটলেটটার খবর। এর খোলা ছাদের কাঠের ডেকে বসে পূর্নিমার রাতে বঙ্গপোসাগরের দৃশ্য দেখার লোভ সামলানো কঠিন হলো। কোনমতে নাকে-মুখে খেয়ে দে ছুট। কেন যেন সায়মন হোটেলে আমার এর আগে কখনোই যাওযা হয়ে ওঠেনি।
অনেকে বলেন বাঙ্গালী নাকি বাড়িয়ে বলে। আপত্য এ প্রবাদ বাক্যটি একেবারে মিথ্যে প্রমাণ হলো হোটেল যেয়ে। হাত বাড়ালেউ যেন ধরা যায় বিচের উপর আছড়ে পরা বঙ্গোপসাগরের একের পর এক ঢেউ। একে পূর্ণিমার রাত, তার উপর জন্মদিন উপলক্ষ্যে সায়মন হোটেল সেজেসে আলোকমালায়। এ সৌন্দর্য ভাষায় তুলে আনার ভাষা আমার জানা নেই। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং কবি হারিসুল হক ভাইয়ের অভাবটা আরেকটু প্রকটভাবে অনুভব করলাম। অবশ্য সায়মনে ঢোকার পর থেকে ভদ্রলোকের অভাবটা অনুভব করছিলাম আমরা সবাই।
ঘড়িয় কাটায় যখন পরদিন, আড্ডা ভাঙল আমাদের। লিফটে নেমে আসার সময় সঙ্গী দেবাশিষের স্বগোতক্তি, ‘খেয়াল করেছেন কি – সমুদ্রের গর্জন কিন্তু আমরা শুনতে পেলাম না’। তাই কি? তাইতো? ‘আলোর জন্য আমরা সমুদ্রের গর্জনটা শুনতে পেলাম না’, বলে চলেছে দেবাশিষ। বেটা বলে কি? মনের সন্দেহের প্রকাশ বোধ করি আমাদের চোখেও। দেবাশিষ বুদ্ধিমান। বুঝতে দেরী হয় না কি ভাবছি আমরা। কিন্তু সে তার ব্যাখ্যায় অটল। ‘খেয়াল করে দেখবেন, রাতের বেলা বাথরুমের কল থেকে টিপ-টিপ করে পরা পানির শব্দ ঘরের আলো না নেভালে শোনা যায় না’। যুক্তি বটে!
কানাডা প্রবাসী বন্ধু ডাঃ মিঠু সেদিন বলছিল, ওদেশে নাকি আগামী পহেলা জুলাই থেকে প্রমোদের উদ্দেশ্যে গাঁজা সেবন সিদ্ধ হতে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় এটি এখন সিদ্ধ আর সেই ২০০১ সালে আমস্টারডামের কেন্দ্রস্থলে ড্যাম স্কয়ারে দেখে এসিেছ সারি সারি ক্যানাবিস বার। চারিদিকে যখন গাজার এতই জয়-জয়কার তখন দেবাশিষের গাজাখুরি যুক্তি না মেনে উপায় কি? আর বেচারা দেবাশিষেরই বা কি দোষ? কতলোকের কত গাঁজাখুরি যুক্তিইতো আমরা সকাল-বিকাল হাসিমুখে মেনে নিচ্ছি।
কদিন আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে থেকে দিনে দুপুরে সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা পুলিশ পিটিয়ে, প্রিজন ভ্যান ভেঙ্গে আসামি ছিনিয়ে নিয়েছেন। ভেঙ্গেছেন পুলিশের রাইফেলও। এমনকি প্রিজন ভ্যান ভাঙ্গার সময় সুন্দর করে পোজ সেলফি তুলেছেন যা ফেসবুকের কল্যাণে ভাইরালও হয়েছে। ভাল কথা, মোটেও গাঁজাখুরি বিষয় নয় এটি। যা হয়েছে তাই লিখছি। আলোর কারণে শব্দ শোনা যাক আর নাই যাক, সরকারি সম্পত্তি ধংস করার সময় সেলফি তোলাটা মোটেও গাঁজাখুরি নয়।
প্রিজন ভ্যানে হামলা নিয়েও আমরা অনেক গাঁজাখুরি গল্প শুনেছি। দলটির একজন বড় নেতা তার বিধ্বংসী নেতা-কর্মীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছের অমন বীরত্বের পাবলিক প্রদর্শনীর জন্য। আবার তার দলেরই তার চেয়েও বড় আরেক নেতা জানিয়েছেন এটা নাকি তাদের বেকায়দায় ফেলার জন্য সরকারি এজেন্টদের কাজ। কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে গাঁজাখুরি, কোনটা যে ধরব আর কোনটাকে ফেলব বোঝা দায়!
বেচারা বিচারকদের জন্য দুঃখই হয়। কত গাজাখুরি কিচ্ছাই না তাদের শুনতে এবং হজম করতে হয়। যে এতিমখানার কোন অস্তিত্বই নেই বলে স্বীকার করে নিয়েছেন সাবেক বিরোধীদলের একজন হেভিওয়েট নেতা কাম হেভিওয়েট আইনজীবি, আমাদের নাকি মেনে নিতে হবে সেই এতিমখানার জন্য বিদেশ থেকে আসা টাকা ব্যক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে নেয়াটা দোষের না। আমাদের বিশ্বাষ করতে হবে এতিমখানার ঠিকাটাটি হচ্ছে দেশের উপ-সেনা প্রধানের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি বাসভবন, তাও আবার একেবারে দেশের প্রধান সেনানিবাসটির কেন্দ্রস্থলে। যাই কই? করিটা কি?
আসলে সবকিছুর যেমন একটা সীমা আছে তেমনি সীমা বেধে দেয়া আছে গাঁজা সেবনেরও। কানাডা, আমেরিকা বা হল্যান্ডে গাঁজা খাওয়া বৈধ হলেও তাতে লাগাম টানা আছে। গাঁজা খাবেন খান, তবে বুঝ করে খেয়েন! রাজনীতির ময়দানে একের পর এক গোল খেতে থাকা ভগ্নদূত নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে একটু-আধটু গাঁজাখুরি গল্প শোনানো যেতেই পারে। এককালে যেহেতু বিরোধী দলের ছাত্র রাজনীতি করেছি, ভালই বুঝি আমি তা! তবে তারওতো একটা সীমা থাকতে হবে। নিষ্কলুশ গাঁজাখুরিতে দোষের তেমন কিছুই নেই। যেমন দোষের কিছু নেই দেবাশীষের ‘লাইট এন্ড সাউন্ড’ তত্ত্বে। সমস্যাটা হয় যখন আমরা তালগোল পাকিয়ে ফেলি। আর সীমাহীন গাঁজাখুরি গপ্পে কখনো কোন কালে কোন লাভ হয় বলে মনে হয় না। তাতে নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হন না। সরকার ফেলে দেয়ার আগ্রহে তখন তারা প্রিজন ভ্যানে হামলা করেন না, ভাঙ্গেন না ভীনদেশে দেশের দুতাবাস। এসব তখন তাদের কাছে শুধুই সেলফি তোলার উপলক্ষ মাত্র।
ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): চিকিৎসক ও লেখক
সারাবাংলা/এমএম
[এই বিভাগের লেখার সকল মতই লেখকের নিজস্ব]