Thursday 26 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেখ রাসেল: এক অনাগত ভবিষ্যতের যবনিকা!


১৮ অক্টোবর ২০১৯ ১২:২৪

তখন হেমন্তকাল, তারিখটা ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪। নবান্নের নতুন ফসলের উৎসব বাঙালির মাঝে ছিলো না, তখনের হেমন্তে ছিলো লড়াই আর যুদ্ধের আভাস। ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অনিশ্চিত অন্ধকার পথের যাত্রা ছিলো এ অংশের জনগণের নিত্যসঙ্গী। সেই আঁধার পথ অতিক্রম করে তখন আলোর স্বপ্নে বিভোর বাংলার মানুষ। যার হাত ধরে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটবে তাঁর ঘর আলোকিত করে সেদিন জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু। শিশুর নাম রাখা হলো রাসেল। মূলত জন্মের আগেই ঠিক ছিলো যে, ছেলে শিশু হলে নাম রাখা হবে রাসেল। কিন্তু এত নাম থাকতে কেনোই বা রাসেল? এই প্রশ্নের উত্তরে যেতে হলে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার যুদ্ধবিরোধী শান্তিপূর্ণ এক মানবিক সত্ত্বাকে খুঁজে পাবো আমরা।

বিজ্ঞাপন

শেখ রাসেলের জন্মের দু তিন বছর আগ থেকেই কিউবাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিলো। শুধু স্নায়ুযুদ্ধ বললে ভুল হবে বরং গোটা বিশ্ব এ দু’দেশের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা তখন প্রত্যক্ষ করছে। এই স্নায়ুযুদ্ধ তখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনই বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। বার্ট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্ব নেতাও। বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে ‘কমিটি অব হানড্রেড’ গঠনের মাধ্যমে বার্ট্রান্ড রাসেল তখন গোটা বিশ্বে এক আলোচিত নাম। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা দু’জনেই ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। বার্ট্রান্ড রাসেলের বইয়ে বিভোর ছিলেন এই দম্পতি। তাই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে নিজেদের সন্তানের নাম রাখলেন রাসেল। সামনে যুক্ত হয় পারিবারিক টাইটেল, এতে শিশুটির পুরো নাম হলো ‘শেখ রাসেল’।

বিজ্ঞাপন

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে আলোকবর্তিকা হয়ে আসে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল। শিশুটির আগমনে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে তখন আনন্দ ধারা বহমান। নতুন শিশুকে নিয়ে সবাই উৎসবে মেতে ওঠে। যদিও বঙ্গবন্ধু ভবন তখন আজকের রূপে ছিল না, বাড়ির কাজ ছিল চলমান। নীচতলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘরেই রাসেল জন্ম নিয়েছিলো।

জন্মলগ্ন থেকেই রাসেল ছিল চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বাড়ি সব সময় মাথায় তুলে রাখত। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের মাধ্যমে শেখ রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় চার বছর বয়স থেকে। শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণে জানা যায়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়। খুব দুষ্ট প্রকৃতির রাসেলের কথা তার শিক্ষিকাকে শুনতে হতো, নইলে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতো না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলকে আদর করে সে অনুযায়ী শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকার খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল শেখ রাসেল। প্রত্যেক দিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকতো এবং শিক্ষিকাকে তা খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়াকালীন সময়ে শেখ রাসেলকে সময় দিতে না পারার চাপা কষ্টের বর্ণণা যেভাবে বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন তা একজন পাঠকের নিজের অজান্তেই চোখে অশ্রু আনাতে বাধ্য। ভালোবাসার মানুষটির মুখে একটু কষ্টের ছাপ দেখলে মনে হয় পুরো পৃথিবী অন্ধকার, কিন্তু বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই অন্ধকারকে জয় করেছেন বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার মাধ্যমে। বাবা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জেলে বন্দি থাকার কারণে একটা সময় শেখ রাসেল মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেই ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতো। ভেতরের এ কষ্টটাই পিতা মুজিবকে অসংখ্যবার বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শিশু রাসেলের প্রতি সময় না দিতে পারার ভেতরকার এই বেদনাই অনেকবার ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে যখন রাজবন্দি হিসেবে জেলে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সে সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ‘কারাগারের রোজনামচা’তে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন : ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ এই ছিল শেখ রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ যা ফুটে ওঠে জাতির পিতার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে।

শেখ রাসেলের স্মৃতি সর্বদাই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে তাড়া করে বেড়ায়। স্মৃতিচারণ করতে বসলে তাদের গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে যায়। বেশিক্ষণ বলতে পারেন না কিছু। প্রয়াত সংসদ সদস্য, সাংবাদিক এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবি মওদুদের লেখনীর মাধ্যমে জানা যায়, রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আব্বার কাছে যাবে না?’ মা কোনো উত্তর দেন না। শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কি মা?’ মা বলেন, ‘কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’ রাসেল উত্তর দেয়, ‘সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।’ এমনকি বেবি মওদুদের লেখায় উঠে আসে শেখ রাসেলের ‘জয় বাংলা’ বলে উচ্চস্বরে স্লোগান দেয়ার ঘটনাও। রাসেল বেশ অনুভূতিপ্রবণ। গল্প শুনতে ভীষণ ভালো লাগত তার। বাড়ির লাইব্রেরি থেকে বই এনে রাসেলকে গল্প পড়ে শোনাতেন বোনেরা। মজার ব্যাপার হলো, একই গল্প ক’দিন পর রিপিট করতে গিয়ে দুয়েক লাইন বাদ পড়লেই রাসেল ধরে ফেলত, বলত- সেই লাইনটা পড়লে না কেন? সব কিছু নিয়েই যে তার একটা আলাদা চেতনা কাজ করত ওই বয়স থেকে সেটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একদিন একটা কালো বড় পিঁপড়া তাকে কামড় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ দেয়া হয় কিন্তু আঙুলটা ফুলে যায়। তারপর থেকে সে আর কালো পিঁপড়া ধরতে যেত না কিন্তু ওই পিঁপড়ার একটা নাম দিয়ে দিল। কামড় খাওয়ার পর থেকেই কালো বড় পিঁপড়া দেখলে বলত ‘ভুট্টো’!

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। রবীন্দ্রনাথের কথা কতোটুকু সত্য সে প্রসঙ্গে না গিয়ে অন্তত এটুকু বলা যায়, মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণেই বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বড় ধোঁকাটি খেয়েছিলেন! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি সেদিন যেন গণহত্যার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। আর এই ভয়ংকর দৃশ্য মৃত্যুর আগে শেখ রাসেলকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও বিশ্বস্ত কর্মচারীরা রাসেলকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেও অভ্যুত্থানকারীদের চোখে ধরা পড়ে যায়। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রহমান শেখ রমার জবানবন্দীতে শেখ রাসেল হত্যার পুরো বর্ণণা পাওয়া যায়। আতঙ্কিত শিশু রাসেল ভয়ে কর্মচারী মুহিতুল ইসলামের পেছনে পালিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনো কাকুতি-মিনতি কিংবা নিষ্পাপ মুখশ্রী নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তদের মন টলাতে পারেনি। সেই অন্ধকার রাতে রাসেল তাকে জড়িয়ে বলেছিল, ‘ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো?’ মুহিতুল আশ্বস্ত করেছিলেন না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না। হয়তো তিনি নিজেও বিশ্বাস করেছিলেন যে, এ রকম একটি নিষ্পাপ শিশুর শরীরে কোনো জঘন্যতম পাপীও আঘাত করতে পারে না। কিন্তু মুহিতুলের সেই বিশ্বাস ভাঙতে সময় লাগেনি। রাসেল মায়ের কাছে যেতে চাইলে ঘাতকদেরই একজন তাকে সেখানে নিয়ে যায়। রাসেল সেখানে তার মায়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, আমি হাসু আপার কাছে যাব। কিন্তু ইতিহাসের ঘৃণিত ঘাতকদের মন এতে গলেনি। ঘাতকদের একজন এই সময় শিশু রাসেলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জাতি যখন এই নির্মম কাহিনী জানতে পারে তখন কারো পক্ষে চোখের পানি রাখা সম্ভব হয়নি। কোনো মানুষের পক্ষে এ ধরনের অপকাণ্ড করা সম্ভব তা যেন সবার কাছে বিশ্বাসেরও অতীত। আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে শিশু রাসেলের মৃত্যু হলেও শেখ রাসেল আছে এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে।

শেখ রাসেলের শৈশব বিকশিত হবার আগেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। জীবনের উচ্ছ্বাস, আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এই মানবিক বিষয়গুলো বুঝার আগেই ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে ছোট্ট শিশু রাসেল। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা তাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জাতির জনকের রক্তধারাই আজ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত করছে বাংলাদেশকে। আমরা আশা রাখছি, খুব দ্রুতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে যেসব খুনিরা শেখ রাসেলের শৈশব কেড়ে নিয়েছে, সেসব অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে।

মো. আসলামুল হক, সংসদ সদস্য, ঢাকা-১৪

সারাবাংলা/এমএম

আসলামুল হক এমপি টপ নিউজ বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল শেখ হাসিনা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ইউনিয়ন পরিষদ বাতিলের আহ্বান বিএনপির
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৪৫

সম্পর্কিত খবর