Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নুসরাত হত্যা মামলার রায়: নারীর লড়াই শেষ হয়নি


২৪ অক্টোবর ২০১৯ ২০:১৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড, সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে নিম্ন আদালতের রায়ও এসেছে। বলছিলাম ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার কথা। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এই রায় ঘোষণা করেন।

গত ৬ এপ্রিল মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় মাদরাসার ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে মারা যান নুসরাত রাফি। ঘটনার পর ৮ এপ্রিল আট জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত চার জনকে আসামি করে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন নুসরাতের ভাই। নুসরাতের মৃত্যুর পর হত্যাচেষ্টা মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।

বিজ্ঞাপন

নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুকে ‘নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় তেজদীপ্ত আত্মত্যাগ’ বলে উল্লেখ করেছেন ফেনীর আদালত। বলেছেন, এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে এরই মধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা।

আরও পড়ুন- নুসরাত হত্যা মামলা: একনজরে ঘটনাপ্রবাহ

ফেনীর আদালত মূল অভিযুক্ত, অধ্যক্ষ সিরাজকে যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য ভেবেছেন, এই হিংস্রতাকে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন, নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করে অথবা কতর্ব্যের সীমা অতিক্রম করেছেন, তাদের ব্যাপারেও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

এই যে এত দ্রুততম সময়ে রায় হওয়া, এই যে আদালতের এমন প্রশংসাবাণী নুসরাতের জন্য— সবই ইতিবাচক। কিন্তু এতে করে নারীর প্রতি সহিংসতা কি কমবে? যে মন নারীকে মানুষ মনে না করে যৌন পুতুল মনে করে, সে মন বদলানো বড় কঠিন। নারীর প্রতি অনেক অসভ্যতা হয়, সবাই পারে না, কিন্তু নুসরাত রুখে দাঁড়িয়েছিল। আর এ কারণেই তাকে হিংস্রতার শিকার হতে হয়েছিল।

অন্যান্য ক্ষেত্রে যা হয়, নুসরাতের বেলায়ও তা হয়েছিল। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাকে গড় অপরাধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কোনো ইচ্ছা পুলিশের সাধারণত থাকে না। নুসরাত হত্যাকাণ্ডেও স্থানীয় ওসি আর এসপি সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিচারের আশ্বাসের বদলে নুসরাতের পরিবার ওসি মোয়াজ্জেমের কাছে থেকে পেয়েছিলেন অশালীন মন্তব্য। সৌভাগ্য এই— আলোচিত ঘটনাটিতে প্রধানমন্ত্রীর নজর ছিল। অন্যাথায় তনু হত্যা বা এমন আরও অজস্র ঘটনার মতো এই ঘটনাও হারিয়ে যেত একসময়।

আরও পড়ুন- যেভাবে পোড়ানো হয় নুসরাতকে, পিবিআইয়ের সচিত্র প্রতিবেদনে যা ছিল

আমরা এমন এক কাঠামো বানিয়েছি যে পুলিশ প্রশাসন নারী নির্যাতনের বেলায় প্রয়োজনীয় সড়াটি দিতে চায় না। নারী নির্যাতনই একমাত্র অপরাধ, যার অভিযোগ দায়ের করতে গেলে নারীর পোশাক, চরিত্র, মতিগতি, ঘোরাফেরা ও অভিযুক্তের মনের অবস্থা, তার কামুকতা বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে পুলিশের কাছে। নারী যদি দরিদ্র পরিবারের হয়, তাহলে তার বা তার পরিবারের বেদনা, ক্ষোভ আর বাস্তবকে বোঝার চেষ্টা আরও থাকে না রাষ্ট্র তথা প্রশাসনের।

উপায় তাহলে কী? সারাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত আক্রমণ, এর পরবর্তী আক্রান্তের চরিত্রহনন পোশাক/আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে হবে। ক্ষুব্ধ, অপমানিত নারী বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল পুরুষের কাজ নয় শুধু মোমবাতি জ্বালানো, মৌনমিছিল করা, গণমাধ্যমে বয়ান দেওয়া। আসলে শিক্ষিত সমাজের ভাবনায় পরিবর্তন আনা দরকার। ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড যতটা চাই, ধর্ষণের শিকার যে নারী, তাকে স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকায় বঞ্চিত দেখলে আমাদের ততটা চিত্তবিকার হয় না।

আরও পড়ুন- রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চাই: নুসরাতের বাবা

পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনীতিকদের হৃদয় পরিবর্তন হোক। কিন্তু নাগরিক সমাজের হৃদয় কোথায়? নারীর প্রতি অশালীন উক্তি করেও হয়তো পুলিশ কর্মকর্তার কিছু হয় না। কিন্তু নাগরিক সমাজে বিচরণকারীরাও যে নারীদের পোশাক বা আচরণবিধির শিক্ষা দিতে গিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতাকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেন, তারাও কিন্তু আসেন শহীদ মিনারে মোমবাতি জ্বালাতে।

নুসরাত হত্যার ঘটনায় তার পরিবার এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট। সমাজও সন্তুষ্ট। কিন্তু এই সন্তুষ্টিই সব নয়। আমরা জানি, নারী-পুরুষ সমান সমান বা সংবিধানে যতই নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হোক না কেন,  প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নারীদের চূড়ান্ত অবহেলিত ও অমর্যাদাকর জীবনযাপনই করে যেতে হচ্ছে। যে নারীশক্তি দ্বারা জগৎ ও সংসার চলমান, সেই নারীশক্তিকে পণ্যে রূপান্তরিত করে নারী অহমিকায় আঘাত হেনে নারীকে অবমাননা করার মধ্যে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোথাও না কোথাও যুদ্ধ জয়ের আনন্দ লাভ করে চলছে। কিন্তু আমাদের সংবিধান নারীর জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারকে স্বীকার করে, হিংসা ও আক্রমণমুক্ত জীবনে নারীর অধিকার জন্মগত। আমাদের দণ্ডবিধি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে দণ্ডনীয় বলে চিহ্নিত করেছে।

আরও পড়ুন- আমি চাই অপরাধীদের পাপের শাস্তি হোক: নুসরাতের মা

নুসরাত প্রতিবাদ করে মারা গেছে। নারীরাও নানা পর্যায়ে লড়াই করে চলেছে। নারীর অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই চলতেই থাকতে হবে, যত দিন না নারীরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে। নারী ভোগ্যপণ্য, পুরুষের সমকক্ষ সে কখনোই নয়— পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনে চেপে বসা ভাবনার এই জগদ্দল পাথর সরাতে যত দিন লাগবে, তত দিন এই লড়াইটা চালাতেই হবে।

লেখক: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি

১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড টপ নিউজ নারীর লড়াই নুসরাত হত্যা নুসরাত হত্যা মামলার রায়

বিজ্ঞাপন

বরিশালে এনসিপির পদযাত্রা
১৬ জুলাই ২০২৫ ০১:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর