ভারতকে বন্দর ব্যবহার করতে দিলে আমাদের কী লাভ, কী ক্ষতি
২৫ অক্টোবর ২০১৯ ২২:০৫
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কিছু ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের জাতীয় স্বার্থ, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই মতামতগুলো বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে এ পর্যন্ত যতগুলো চুক্তি হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করেছি।
এই বিশ্লেষণে বের হয়ে এসেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে মোট ৮৮টি চুক্তি করেছে। এই চুক্তির সবগুলোই বাংলাদেশের স্বার্থে করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার সর্বমোট দীর্ঘ ৩১ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশের স্বার্থে মৌলিক কোনো বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারেননি। এই ৩১ বছরে তারা মোট ৩টি চুক্তি করতে পেরেছিলেন।
ভারতের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যতটুকু অর্জন করেছি তার সবটুকুই পেয়েছি বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার জন্য। এই লেখায় শুধুমাত্র ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে দিলে আমাদের লাভ-ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করছি।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের বিষয়ে বিশেষ মহল যে বক্তব্য দিচ্ছে, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। এর ফলে বাংলাদেশ পাবে পরিবহন ও বীমা থেকে আয় এবং বাড়বে বিনিয়োগ। তাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, আমাদের ওপর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নির্ভরশীলতা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী, এর ফলে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে আমাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে।
কারণ এই ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে যে নির্ভরশিলতা তৈরি হয়, তা ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি তৈরি হলে সেখানে অনেক বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেখানে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ত্রিপুরায় বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধি এবং অর্থনীতির অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং সূচকেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রমাণপত্র হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে এই স্থিতিশীলতার সংরক্ষণসহ এটিকে টেকসই করার ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করলে এই ঘাটতি কিছুটা কমবে।
ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তাদের দু’টি ইস্ট কোস্ট পোর্ট (কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট) ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় তার বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই বন্দরটি ব্যবহারের ফলে তুর্কি এবং ইউরোপের মধ্যে যে উত্তর-দক্ষিণ বহুমুখি পরিবহন কোরিডোর রয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হবে।
আমাদের বন্দর দু’টি ব্যবহার নিয়ে মহলবিশেষ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই পোর্ট ব্যবহারের চুক্তির ফলে এই পোর্ট দু’টি treaty ports এ রূপান্তরিত হচ্ছে না। উনিশ শতকে চীনের বেশ ক’টি পোর্ট কিছু পশ্চিমা দেশ (রাশিয়া, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল ইত্যাদি) সন্ধিবন্দর হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মূলত যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওইসব পোর্টগুলোতে concession right এবং extra territorial jurisdiction প্রয়োগ করতো। চুক্তিতে উল্লেখিত concession period অনেকটা তাদের মালিকানার মতো ছিল। বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত ভারতের সঙ্গে আমাদের চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে কোনো ধরনের concession right দেওয়া হয়নি। এই চুক্তি বাতিল করারও বিধান রয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে শুধু পোর্ট ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কোনো extra territorial jurisdiction দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বে পণ্য পরিবহনে ব্যাপকভাবে খরচ কমে আসবে। বাংলাদেশ সীমানার বাইরে ভারতের চিকেন নেক’র মধ্যে দিয়ে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার। আগরতলা থেকে সাব্রুম হয়ে চট্টগ্রাম পোর্টের দূরত্ব মাত্র ২০৭ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের কারণে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে বিপুল খরচ কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ফি ও চার্জ এবং পণ্য পরিবহনের মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা বাঞ্চণীয়। এই ফি, চার্জ ও পরিবহন মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে cost based pricing এর পরিবর্তে opportunity cost pricing পদ্ধতি নেওয়া সঠিক হবে। বর্তমান অবস্থায় এই পদ্ধতি নেওয়া হলে প্রকৃত অর্থে win win principle বাস্তবায়িত হবে।
পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ তাদের বন্দরগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর ফলে ওইসব দেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক হাব-এ পরিণত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকং তাদের বন্দরগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। জার্মানির বড় ও মাঝারি ১১টি বন্দর থাকার পরেও দেশটি নেদারল্যান্ডের রটারডাম বন্দর ব্যবহার করছে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বর্তমানে এই বন্দর ব্যবহার করছে।
ডেনমার্ক ও সুইডেনের যৌথভাবে স্থাপিত কোপেনহেগেন মালমো পোর্ট (সিএমপি)। ডেনমার্ক, সুইডেন ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলো এই বন্দর ব্যবহারের করায় এটি একটি বাণিজ্যিক হাব-এ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ আগরতলা এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন নগরে যাতায়াত করছে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্যান্য এয়ারপোর্টের তুলনায় ভারতের যে কোনো শহরে যাতায়াতের জন্য সময় ও খরচ বিবেচনায় আগরতলা বিমানবন্দর অনেক বেশি সাশ্রয়ী।
২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। বিবিআইএন অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অধিকতর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটান ভারতের পোর্ট ব্যবহার করছে। ১৯৬০ সালে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে নেপাল ভারতের কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট ব্যবহার করছে। ভুটান বর্তমানে ভারতের কলকাতা পোর্ট ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ভুটান থেকে সড়ক পথে পাঠানো পণ্য আসামের ধুবরি থেকে কার্গো জাহাজের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে (ব্রহ্মপুত্র নদী পথে) বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে আসছে। ২০১৮ সালে ধুবরিকে ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে হলে আমাদের বন্দরগুলো শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ রফতানি ও আমদানিতে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করা হয়। এই বন্দরের ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্যদিকে, মোংলা বন্দরের ধারণ ক্ষমতার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে এই পোর্টের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে।
লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।