Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দীপন: ‘সহজে মরে না কারও বাকস্বাধীনতা’


৩১ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১০

আজ চলে গেলো দীপনের মৃত্যুদিন। আরেফিন ফয়সাল দীপন। লিখত কম। লেখা প্রকাশ করত ও। বাংলাদেশের সাহসী প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি ছিল দীপনের। ওর প্রকাশনার ধরনেও ছিল ভিন্নতা। যে কারণেই অভিজিৎ রায়ের বইগুলো একের পর এক বের হয়েছে দীপনের প্রকাশনী থেকেই। এমন অনেক বই— যা প্রচলিত প্রথার দেয়ালে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা দেয় মাথায় জমে থাকা বিশ্বাসের ভাইরাসগুলোতে।

দীপন খুনের পর বছর যায়, আমরা কতিপয় স্মরণ করি। আধিকাংশের স্মরণে থাকলেও থাকে না কোনো বক্তব্য। কারণ একদিকে প্রচলিত প্রথাকে  ভীষণ ভয় মিশ্রিত বিশ্বাস, অন্যদিকে পৈত্রিক ঘাড়টা বাঁচিয়ে যেকোনো কৌশলে টিকে থাকার প্রবল বাসনা। আর সেই বাসনা থাকবেই বা না কেন? যেখানে বারবার দেয়াল তুলে দেখিয়ে দেয়া হয় কথা বলার সীমানা, যেখানে অভিজিৎ রায়সহ যারা জঙ্গিদের চাপাতিতে খুন হয়েছেন— তাদের জন্য একটি স্মারকস্তম্ভ গড়ে ওঠে না। অথচ প্রতিজনই বচনে বিপ্লবী। সেখানে এমন ভয় থাকা নিতান্ত অমূলক নয়।

বিজ্ঞাপন

সে একটা সময় এসেছিল, এই দেশেই। লেখক থেকে পুরোহিত, পীর থেকে যাজক, এমনকি বিদেশি নাগরিক কিংবা অনেক বছর এই মাটিতে চিকিৎসা দেওয়া সাদা চামড়ার চিকিৎসক— প্রতিজন খুন হয়ে যাচ্ছিলেন। আর আমরা কতিপয় মোমবাতি হাতে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছিলাম। প্রতিবাদের সেই আলোকশিখায় ততটা উত্তাপ আমরা তৈরি করতে পারিনি, যাতে বন্ধ হয় সেই ধর্মান্ধ দানবিক চাপাতির প্রকোপ।

দীপন যেদিন খুন হয়, সেদিনই চাপাতির কোপ খেয়ে মরে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের আরো দুই স্বজন— রণদীপম বসু আর আহমেদ রশীদ টুটুল। আজকের দিনটি আসলেই চোখে ভাসে সেই রাতটির কথা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বেডে পড়ে আছেন টুটুল। তার পাশে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা, আমি আর এফ এম শাহীন নীরবে দাঁড়িয়ে আছি। মর্গের সামনে ভিড়। সেখানে দীপন শুয়ে আছে। সেই দীপন, যে লিখত না, লেখাগুলো ছাপত। পৌঁছে দিত অগণিত পাঠকের কাছে। আমরা কাঁদছি। কান্নাটা শুধু শোকের না, পরাজয়েরও। কারণ, তখন অবলীলায় কাউকে খুন করে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল নাস্তিকের ট্যাগ। বিষয়টি এমন ছিল, যেন কেউ একজন কিছু লিখলে, অথবা কেউ লিখেছেন— এমন অভিযোগ তোলা হলেও তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলা যায়। তিনি হোন না বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা টাঙ্গাইলের গ্রামে থাকা একজন দর্জি— তখন সেই হত্যার বিষয়ে কেমন যেন ঢাকঢাক গুড়গুড়। রাষ্ট্র বা সমাজ কারও কাছেই গুরুত্ব নেই লাশগুলোর।

বিজ্ঞাপন

কেন খুন করা হলো দীপনকে? এই প্রশ্নটি এখন প্রচণ্ড রকম জরুরি। কারণ, দীপন তো লেখেননি কিছু, তেমনভাবে সোস্যাল মিডিয়াতেও সোচ্চার ছিল না। তবুও কেন তার ঘাড়ে আর গলায় ধারালো চাপাতির কোপ? এই প্রশ্নের সহজ জবাব— এই গ্রহের সব অন্ধকারের শক্তি সবচেয়ে ভয় পায় চিন্তাকে। যে কারণেই জিওদার্নো ব্রুনো থেকে মালদ্বীপের উদারপন্থি ব্লগার ইয়ামেন রশিদকে নিহত হতে হয়। ব্রুনোকে খুন করে রাষ্ট্র আর ইয়ামেন রশিদ বা অভিজিৎ রায় খুন হয় তাদের হাতে, যারা অন্ধকার দর্শন তৈরি করে আক্রমণ করতে চায় রাষ্ট্রকে, ‘তাগুতি’ আইনে চলা রাষ্ট্রকে নিজেদের মতো করে পরিচালনার করতে চায়। কখনো তারা আল-কায়েদা, কখনো তারা তালেবান, কখনো আইএস, কখনো তারা নুশরা ফ্রন্ট, কখনোবা আল-শাবাব, কখনো জেএমবি নামে মানুষকে কুপিয়ে বা পুড়িয়ে মারতে নামে। সে কারণেই অভিজিৎ রায়, কান্দিল বালোচ, ফয়সাল আরেফিল দীপন বা মুহম্মদ আখলাকের রক্ত এক হয়ে মিশে থাকে মাটিতে।

চিন্তাকে রুদ্ধ করতে হলে, চিন্তা যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকেই বড় নজর রাখতে হয় অন্ধকারের দানবদের। তাদের লক্ষ্য থাকে চিন্তার পথ বন্ধ করা, চিন্তকের কলম বা কণ্ঠ স্তব্ধ করা। দীপনের ব্যাপারেও তারা তাই  করেছিল। ওরা হত্যার পরেও আজও ভয় পায় অভিজিৎ রায়ের লেখা অক্ষর, শব্দ, বাক্যগুলোকে। আর সে কারণেই তারা ভেবেছিল— দীপনকে খুন করলে আর কোনো প্রকাশকের সাহস হবে না সেই বইগুলো ছাপার। আংশিক সত্যও বটে তাদের ধারণা। আমার জানামতে, এখনো আরেক দফা ছাপা হয়নি অভিজিৎ রায়ের অধিকাংশ বই। কিন্তু তাতে কী, থেমে তো থাকেনি চিন্তার চর্চা। থামবেও না কোনোদিন। থামেনি বলেই একজন দীপন চলে গেলে আরও অনেক দীপন আসে প্রকাশনা শিল্পে। একজন চিন্তক মরে গেলেও নেভে না চিন্তার মশাল। জ্বলন্ত সেই মশাল জীবনের বিনিময়ে হলেও জ্বালিয়ে রাখে, বয়ে নিয়ে যায় কেউ কেউ। তারা নতুন দিনের মানুষ, নতুন আলোর দিশারী।

ইন্টারনেটনির্ভর এই সময়ে পিডিএফ হয়ে বারবার পঠিত হচ্ছেন অভিজিৎ রায়। আমরা স্মরণ করি দীপনের সাহসকে। আর একইসঙ্গে দেখি— রাষ্ট্র ক্রমশ গুঁড়িয়ে দিয়ে চলেছে একটির পর একটি জঙ্গি ডেরা। লেজ গুটিয়ে পালাতে পালাতে তাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। কিন্ত আমাদের ভাবনার আকাশ মুক্তই আছে এখনো। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়— ‘চিন্তা সে রক্তবীজের মতোন।’ মুক্তচিন্তারা মরে না কখনো। যেমন কখনোই মরবেন না অভিজিৎ রায় বা আরেফিন ফয়সাল দীপন।

লেখক: এডিটর, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, জিটিভি  [email protected]

অঞ্জন রায় অভিজিৎ রায় দীপন ফয়সাল আরেফিন দীপন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর