Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জয়নাল, দিপালী ও কাঞ্চনের জন্য ভালোবাসা


১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৬:৫৪

‘আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে, বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্রবাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি”- এই ঘোষণা দিয়ে জেনারেল এরশাদের শাসন শুরু হয়। আসলে তো শুরু হয় স্বৈরশাসন।

বিজ্ঞাপন

স্বৈরশাসক এরশাদের কুদৃষ্টি প্রথমেই পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ১৬ জুলাই ১৯৮২ সালে শিক্ষক সমিতির ফেডারেশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি জানান তার সরকার একটা জাতীয় শিক্ষাননীতি গ্রহন করবে। সেই সভাতেই তিনি শিক্ষার মনোন্নয়নে নিজে নেতৃত্ব দেয়ার আগ্রহ দেখান এবং কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষক না হয়েও হয়ে যান সেই ফেডারেশনের চেয়ারম্যান।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড.মজিদ খান ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সালে একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করে। যেখানে ১ম শ্রেণি থেকে আরবি শিক্ষা ও ২য় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই নীতির আরেকটা বিতর্কিত বিষয় ছিল উচ্চশিক্ষানীতি। এই নীতিতে বলা হয়েছিল কোন ছাত্র যদি রেজাল্ট খারাপ করে কিন্তু সে যদি উচ্চশিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় বহন করতে পারে তবে সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য যোগ্য বলে গন্য হবে। শিক্ষাবিদরা একে আইয়ুব খানের শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ভিন্ন মোড়কে নতুন সংস্করণ হিসেবে আখ্যা দেন।

এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন রোধে ছাত্র ও শিক্ষকেরা রাস্তায় নেমে আসে। সে যুগে যখন রাজনীতি বন্ধ ছিল তখন এই শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে আবার শুরু হয় মিটিং মিছিল আন্দোলন। গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সেই আন্দোলন জোরালো মাত্রা পায় ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সভায় সকল ছাত্র সংগঠন মিলিত হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অবৈতনিক ও বৈষম্যহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্রদের ডাকা বিশাল মিছিলে শামিল হয় হাজার হাজার মানুষ। আর এই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্রীরা।

মিছিল যখন হাইকোর্ট গেট ও কার্জন হল সংলগ্ন কাটাতারের সামনে পৌঁছায় তখন শিক্ষার্থীরা সব রাস্তায় বসে পড়েন। নেতারা সব কাঁটাতারের উপর দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ জানাতে থাকেন। ঠিক তখনই নিরীহ ছাত্রদের উপর অতর্কিতে হামলা করে পুলিশ। প্রথমে ছোঁড়া হয় গরম পানি। তাতেও ছাত্ররা হটে না গেলে এরপর ছোঁড়া হয় গুলি। পুলিশের এই গুলিবর্ষণে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন জয়নাল, দিপালীসহ কয়েকজন। দিপালী এসেছিলেন শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আর এসেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। যার লাশ পরে গুম করে ফেলে পুলিশ। আর বুলেটাহত জয়নালের রক্তাক্ত দেহটাকে সেখানে ফেলে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করে তবেই খান্ত হয় পুলিশ।

এতকিছুর পরেও দমে যায়নি ছাত্ররা। ১৫ তারিখে নতুন উদ্যমে রাস্তায় নামে তারা। ফলে আন্দোলন হয় আরও বেগবান আর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। এদিন আন্দোলনে অংশ নিয়ে চট্রগ্রামে নিহত হন কাঞ্চন। এই আন্দোলনই ছিল সূত্রপাত যা একটু একটু করে বড় হতে হতে ১৯৯০ সালে পতন হন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি এরশাদের। শিক্ষানীতির প্রতিবাদের নিহতদের স্মরণ করতে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় “স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস”। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই দিনটি নিবেদিত ছিল শুধুই দিপালী আর জয়নালদের জন্য। তাদের ত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করত সবাই।

এরপর আসল আমদানি করে আনা “বিশ্ব ভালবাসা দিবস”। আর তারপর থেকে এর এতো বেশি প্রচারণা যে সকলে ধীরে ভুলে গেল দিপালী, জয়নাল, কাঞ্চনদের কথা। আসলে ৯৩ এর আগে বাংলার মানুষ খুব একটা জানত না ভ্যালেন্টাইন দিবস কি বা কেন পালিত হয়। তখন পর্যন্ত এটা ছিল শুধুই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস।

বিশ্বায়নের এই যুগে সকল সংস্কৃতিই একে অন্যের সাথে মিলবে মিশবে সেটা অনুমিত। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় গ্লোবালাইজেশনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা শেকড় ভুলে যাচ্ছি। তার মানে এই না যে আমি ভালবাসা দিবসের বিপক্ষি বলছি। কিন্তু আমার মনে হয় ভালবাসা দিবসের সাথে সাথে আমাদের জয়নালদের আত্মত্যাগ মনে রাখার কথা ছিল। জয়নাল, দিপালীদের বুকের রক্তই আস্তে আস্তে জমাট বেঁধেই স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে।

কিন্তু যে শিক্ষার অধিকারের জন্য এই রক্ত ঝরা সে শিক্ষার অধিকার আমরা কতখানি পেয়েছি। আজও কোথায় যেন আমাদের শিক্ষানীতিতে একটা বিশাল শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। আজও প্রতিদিন প্রশ্নফাঁস সহ আরও অনেক বেড়াজালে আটকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন দিনদিন পিছিয়েই যাচ্ছে। কাঞ্চনদের রক্ত যেন বারবার হেরে যাচ্ছে এই ভূমিতে।

সারাবাংলা/এমএম
[এই কলামে তুলে ধরা সকল মতামত লেখকের নিজস্ব]

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর