ক্যাসিনো যুগে যুগে
১৪ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:৪৪
ছোটবেলায় আমরা গ্রামের বৈশাখি মেলায় লটারি খেলা দেখতাম, কিন্তু টাকার অভাবে খেলতে পারতাম না। তখন মনে মনে ভাবতাম, আহারে, খেলতে পারলে আর ভাগ্য ভালো হলে হয়তো অনেক টাকা জিতে যেতাম! লটারিতে শুধু জেতার কথাই ভাবতাম, হারার কথা মাথায়ই আসত না। কারণ লটারিতে সর্বস্ব হারানোর আগে কেউই হারে না।
তারপর যখন একটু একটু বড় হলাম, ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম— ওটা আসলে লটারি বা ভাগ্য পরীক্ষা নয়, ওটার আসল নাম হলো জুয়া। ছোটবেলার সেই লটারি বা জুয়ারই আধুনিক সংস্করণ ক্যাসিনো। এটা এ যুগের অর্গানাইজড জুয়া, যা প্রধানত অবৈধ টাকাওয়ালা মানুষেরা বা প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত অর্থের মালিকেরা মদের গ্লাস হাতে নিয়ে প্রায় মাতাল হয়ে প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের মতো আয়েশি এবং রাজকীয় ভঙ্গিতে খেলে থাকে। আর এই তথাকথিত মাতাল রাজা-বাদশাহদের খেলা ক্যাসিনোই এখন দেশের অন্যতম টক অব দ্য টাইম।
ক্যাসিনোতে যারা জুয়া খেলতে যান, তারা জেতার জন্য খেলতে যান কি না জানি না। আমার মনে হয় না যে ক্যাসিনোতে কেউ টাকা জেতার জন্য খেলতে যায়। আমার ধারণা কেউ কেউ হয়তো সময় আর অর্থ ব্যয় করে মনে আনন্দ পাওয়ার জন্য ওখানে যায়। যদিও অর্থ ব্যয় করে গরিবের উপকার বা মানুষের সেবা করার চেয়ে বড় আর কোনো আনন্দ জগতে আছে বলে আমার জানা নেই। জগৎ বিচিত্র, বিচিত্র তার আচরণ; তাই একেকজন মানুষের আনন্দের উৎসও একেকরকম। কেউ হত্যা করে আনন্দ পায়, আবার কেউ সেবা করে পরম আনন্দ পায়। তবে যে যেই উদ্দেশ্যেই ক্যাসিনোতে যান না কেন, ক্যাসিনোতে খেলোয়াড় হিসেবে খেলে টাকা জেতা সম্পূর্ণ অসম্ভব একটি ব্যাপার।
ক্যাসিনোতে খেলার জন্য অনেক উপকরণ আছে। যেমন— তাস বা কার্ড, কয়েন ভেন্ডিং মেশিন, রুলেট হুইল ইত্যাদি ইত্যাদি। পছন্দ অনুযায়ী আপনি যেকোনোটিই খেলতে পারেন। সহজ বোধগম্যতার জন্য রুলেট হুইল অন্যতম জনপ্রিয় গেম, কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এটি খেলা যায়। চক্রাকার হুইলের চারপাশে অনেকগুলো ঘর এবং গর্ত থাকে। গর্তের পাশ দিয়ে একটি ছোট বল হাতের ধাক্কায় ছেড়ে দিলে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরতে থাকে। তারপর যে গর্তে বলটি পরে, সেই ঘরই জিতে। অন্য ঘরগুলো হেরে যায়।
যাদের অঙ্ক শাস্ত্রে সামান্য ধারণা আছে, তাদের জন্য এটা বোঝা মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয় যে ক্যাসিনো থেকে টাকা জেতা যাবে না। মোটেই জেতা যাবে না। লং রানে বা দীর্ঘ মেয়াদে কখনোই জেতা যাবে না। আসুন এবার দেখে নিই, অঙ্ক শাস্ত্র কী বলে, ক্যাসিনোর ফল সম্পর্কে কী ধারণা পাওয়া যায়—
ধরুন, আপনি রুলেট হুইলের একটি ঘর নির্বাচন করে তাতে বিনিয়োগ করলেন বা টাকা দিলেন, যেখানে হুইলের ৫০টি ঘর আছে, কিন্তু প্রতি রানে জিতবে মাত্র একটি ঘরের বিনিয়োগকারী। বাকি ঘরের বিনিয়োগকারীরা হেরে যাবে। কারণ একসঙ্গে একটি বল দুই ঘরে থামতে পারবে না। ৫০টি অপশনের মধ্যে একটি অপশনে বিনিয়োগকারী জিতলে হিসাব অনুযায়ী একজন খেলোয়াড়ের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২ শতাংশ! অন্তত অঙ্ক শাস্ত্র তাই বলে। অর্থাৎ অনেকক্ষণ ধরে খেলা চালিয়ে গেলে প্রতি ১০০ বার খেলে আপনি মাত্র দু’বার জিতবেন! কী সাংঘাতিক আত্মঘাতী খেলা! সুতরাং ২ শতাংশ সম্ভাব্যতায় লোকসান এড়াতে চাইলে যেখানে আপনি বিনিয়োগ করবেন, সেখানের গড় পুরস্কার বা আরওয়াই হতে হবে অন্তত আপনার বিনিয়োগের ৫০ গুণ (১০০ ÷ ২), কারণ সম্ভাব্যতা মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো— ক্যাসিনো মালিকেরা কি গড়ে ৫০ গুণ হারে পুরস্কার দেন? কখনোই নয়।
সাদা চোখে দেখলে, ক্যাসিনো মালিকেরা যদি লাভ খেলোয়াড়কেই দিয়ে দেয়, তাহলে ক্যাসিনোর ব্যাবসা খুলেছে কি চ্যারিটি করার জন্য? লাভ কোথাও দুই গুণ, কোথাও পাঁচ বা ১০ গুণ ইত্যাদি। কিন্তু মোট পুরস্কারের গড় হার কখনোই ৫০ গুণ নয়। ক্যাসিনো যারা চালায় তারা ১০ গুণেরও বেশি দেয় বলে আমার জানা নেই। যেখানে মাত্র ২ শতাংশ জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এবং গড় পুরস্কার হার পাঁচ বা বড় জোর দশ গুণের মতো এবং আদর্শ পুরস্কার হার হওয়া উচিত ৫০ গুণ, সেখানে কোনো জ্ঞানী মানুষের কি বিনিয়োগ করা উচিত? এবার ভাবুন, রুলেট হুইলে যদি ৫০টি ঘরের পরিবর্তে ৮০টি ঘর থাকে, তাহলে জেতার সম্ভাবনা কত? অঙ্কের হিসাবে তা নেমে আসবে মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশে!
সুতরাং ক্যাসিনো থেকে টাকা জেতা অসম্ভব এবং জেতার জন্য খেলতে যাওয়া মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার ওপর বোর্ডগুলোতে অনেক ম্যাগনেটিক এবং ইলেকট্রনিক কারসাজি থাকার সম্ভাবনা থাকে মানুষ ঠাকানোর জন্য। তবে দৈবঘটনা হিসেবে মাঝে মধ্যে কেউ কিছু জিততেই পারে বা কাউকে জিতিয়ে দেওয়া হতে পারে তার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু অনেকদিন বা অনেকক্ষণ ধরে খেললে খেলোয়াড় তার সব টাকা পয়সা হারিয়ে ফকির হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্যাসিনো ব্যাবসা মানুষ স্থাপনই করে লাভ করার জন্য, লোকসান করার জন্য নয়। ওখানে ক্যাসিনোর মালিক জিতবে, আর খেলোয়াড়রা হারবে— এটাই এই খেলার নিয়তি। কারণ অঙ্কের সমীকরণ সেটাই বলে।
শেয়ার বাজারকে আনেকেই ভুল করে জুয়া বা ক্যাসিনোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, বিশেষত যারা শেয়ার বাজার বুঝেন না। অনেকেই বলে বসেন, শেয়ার বাজার আর জুয়া একই কথা। হুজুগে বিনিয়োগ করলে শেয়ার বাজার অবশ্য জুয়ার মতোই। কিন্তু শেয়ার বাজার জুয়া নয়, একটি ফটকা ব্যাবসা, কিন্তু ক্যাসিনো হলো জুয়া। দু’টির মধ্যে পার্থক্য এরকম— শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ একটি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ। কিন্তু ক্যাসিনোতে বিনিয়োগ অনুৎপাদনশীল খাত বা জুয়ায় বিনিয়োগ। আপনি যে শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, সেটি একটি কোম্পানির মূলধন। কোম্পানি সেই মূলধন খাটিয়ে সারাবছর উৎপাদন ও কেনা-বেচা করে মুনাফা করে আপনাকে লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য। বছর শেষে আপনি সেই লভ্যাংশের মালিক বা দাবিদার। অর্থনীতির ভাষায় বললে বলতে হয়, ক্যাসিনো কিছু তৈরি বা উপযোগিতা তৈরি করে না, ক্যাসিনোতে একজন হারে আর অন্যজন জেতে, অর্থ কেবল হাত বদলায় মাত্র। এখানে নতুন অর্থ বা সম্পদ তৈরির সুযোগ নেই। ক্যাসিনোতে খেলোয়াড়েরা যা হারেন, সেটা ক্যাসিনোর মোট মুনাফা। আর সেখান থেকে ক্যাসিনো চালানোর ব্যয় বা ওভারহেড বাদ দিলে যা পাওয়া যায়, সেটাই ক্যাসিনো মালিকের নিট লাভ।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলে রাষ্ট্রের কর্মসংস্থান বাড়ে, রাষ্ট্রের কর ও ভ্যাট আদায় বাড়ে, যা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, দেশের সার্বিক উন্নতি হয়। কিন্তু ক্যাসিনোতে বিনিয়োগ করলে দেশে জুয়ারির সংখ্যা বাড়ে মাত্র।
বিষয়টি আরও সহজ করে বললে এরকম—
ধরুন, আপনারা দুই ভাই নাবালক, তাই দুই ভাইয়ের সব সম্পদের আইনি মালিক আপনার বাবা। আপনার একটি কলম আছে, সেটি উপহার পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। আপনি সেটা আপনার অন্য ভাইয়ের কাছে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেন। তারপর আবার ২০ হাজার টাকায় কিনলেন, আবার ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেন। এভাবে দুই ভাই কেনাবেচা করতে করতে কলমের দাম হল পাঁচ লাখ টাকা। এভাবে যতবারই কেনাবেচা করেন না কেন এবং কলমের দাম ভার্চুয়ালি যতই হোক না কেন, কলম তো যে সেই কলমই আছে। আপনার বাবার মোট সম্পদ বেড়েছে কি? মোটেই নয়। ক্যাসিনোও ঠিক এরকম। এক পকেটের টাকা অন্য পকেটে যায় মাত্র। এতে দেশের কোনো উন্নয়ন হয় না।
২০০৮ সালের কথা, নেপাল ভ্রমণে গিয়ে প্রথম বার ক্যাসিনো দেখি। এভারেস্ট হোটেলের ক্যাসিনোতে অপূর্ব সুন্দর ক্যাসিনোর বোর্ড আর বার ড্যান্স খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল সেদিন আমার কাছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ পাঁচশ টাকার ফ্রি ক্যাসিনো কুপন দিয়েছিল। সেই কুপন দিয়ে খেলা যায়, কিন্তু ভাঙিয়ে টাকা আনা যায় না। খেলতেই হবে, নইলে মিস। ভাবলাম খেলেই দেখি কী হয়। সেদিন ভাগ্যবান ছিলাম বলতে হবে। জিততে শুরু করলাম। খেললেই জিতি। জিততে জিততে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জিতেছিলাম। এরপরই ক্যাসিনো তার স্বমহিমায় আবির্ভূত হলো এবং হঠাৎই হারতে শুরু করলাম। এবারে যতই খেলি, ততই হারি। একপর্যায়ে দেখি হাতে হাজার তিনেক টাকা অবশিষ্ট আছে। ভাবলাম আর জেতার দরকার নেই, বিনা বিনিয়োগে যা জিতেছি তাই ভালো। এবার কেটে পড়ি।
দ্বিতীয়বার আবার যখন নেপাল গেলাম, আগের বারের কথা মনে পড়ল। ওই যে একটি বিষয় আছে, যাকে বলে ‘লোভ’! ভাবলাম আবার পাঁচশ টাকা খেলে দেখি। এবার পকেটের টাকা বিনিয়োগ করলাম। চিন্তা করলাম একশ একশ করে পাঁচ দানে পাঁচশ টাকা খেলব, যেন কম টাকাতেও অনেকক্ষণ খেলা যায়। কিন্তু বিধিবাম, আশপাশে সবাই দেখি একেক দানে পাঁচ-দশ-পঞ্চাশ হাজার করে খেলছে। আমিও লজ্জায় পড়ে একদানেই পাঁচশ টাকা খেললাম। আর যায় কোথায়, একদানেই পথের ফকির!
মনে রাখা জরুরি, আপনি-আমি সার্কাসের অনেক খেলাই খেলতে গেলে প্রাণে মারা যাব। কারণ ওগুলো খেলতে গেলে যে পরিমাণ প্র্যাকটিস ও নিজের প্রতি যে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, সেটা আমাদের সবার নেই। সব মানুষের জন্য সব কাজ সঠিক নয়। মানুষের সব শক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ শক্তি হচ্ছে তার নিজের আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি বা ইচ্ছা শক্তি। নিজের প্রতি যাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে, তারা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু নিজের প্রতি যাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল, তারা অন্য কিছুর বা অন্য ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের শিকার হন। নিজের প্রতি অতি নিয়ন্ত্রণ থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় ঝুঁকি নিতে নেই। তারই একটি হলো জুয়া খেলা, দ্বিতীয়টি নেশা।
ছোটবেলা বইয়ে পড়েছিলাম, যুদ্ধে যিনি স্থির থাকেন, তাকে একবাক্যে বলে যুধিষ্ঠির। মনে রাখা প্রয়োজন, যুদ্ধে স্থির থাকলেও কিন্তু জুয়ার কোর্টে স্থির থাকা যায় না। ইতিহাসই তার প্রমাণ। নেশা ও জুয়ার ঝোঁক বা জেদ মানুষকে কখনো কখনো এমন জেদি করে দেয় যে মনুষ্যত্বের হিতাহিত জ্ঞানই থাকে না। মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের কথা অনেকেরই জানা। পঞ্চপাণ্ডবদের বড় পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার কথাও ইতিহাসে সুস্পষ্ট। দুর্যোধনের মামা শকুনি আর দুর্যোধনের কাছে টাকা-পয়সা সব হারানোর পরও জেদের বশে খেলা ছাড়লেন না যুধিষ্ঠির। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে ক্যাসিনোর বোর্ডে নিজের রাজ্যকে বাজি ধরলেন, হাতে গড়া প্রিয় রাজ্য হারালেন। এরপরও জেতার আশায় নিজের চার ভাইকে একে একে জুয়ার বোর্ডে ধরলেন, হারালেন তাদেরও। বাদ রাখলেন না প্রিয়তমা স্ত্রী দ্রৌপদীকেও। তাকেও জুয়ার বোর্ডে বাজি ধরলেন এবং তাকেও হারালেন। শেষ পর্যন্ত নিজ রাজ্য ছেড়ে ১২ বছর বনবাস ভোগ করলেন।
পাণ্ডবদের ভাগ্য ভালো, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের বন্ধু। তাই তারা ১২ বছর বনবাসের পরও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শ্রী কৃষ্ণের সহায়তায় রাজ্য উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। পাণ্ডবরা রাজ্য উদ্ধার করতে পারলেও আপনার আমার মতো পাপী জুয়ারিকে সহায়তা করার জন্য কোনো ভগবানের আবির্ভাব কিন্তু হবে না। এমনকি ভাই, বন্ধু বা প্রতিবেশীও কিন্তু উঁকি দেবে না, যখন আপনার পকেটে টাকা থাকবে না। বরং জুয়ারি বলে গালি দেবে মানুষ। আপনার সন্তান জুয়ারির সন্তান বলে অন্যের কটাক্ষের স্বীকার হবে, শুধু আপনার ভুলের কারণে। তাই জুয়া না ছাড়লে পাণ্ডবদের মতো কেবল ১২ বছর বনবাস নয়, সব হারিয়ে চিরকালের জন্য বনবাসী হয়ে যেতে হবে। সুতরাং সাধু সাবধান।
লেখক: ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং গান ও কবিতা রচয়িতা
ইমেইল: [email protected]