খোকা ভাইয়ের মৃত্যুশয্যার পাশে
১৪ নভেম্বর ২০১৯ ২০:১৫
মৃত্যুশয্যা থেকে আমাকে স্মরণ করবেন খোকা ভাইয়ের সাথে আমার এমন সম্পর্ক ছিল না। খোকা ভাই আমাকে স্মরণ করেছিলেন। পুরোপুরি চেতনা হারিয়ে ফেলার তিন দিন আগে ও দুই দিন আগে। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি হাসপাতালে। একেবারেই শেষ অবস্থা। সংকটজনক অবস্থায় ১৮ অক্টোবর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান কাজের ফাঁকে সময় করে প্রায় প্রতিদিন তাকে দেখতে যান। ফিরে আসার পর আমি খোকা ভাইয়ের অবস্থা জানতে চাই। শুনে মন খারাপ লাগে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন জনপ্রিয় ও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নেতা কমই আছেন। ওয়াজেদ ভাই যেদিন বললেন, খোকা ভাই আমার কথা জানতে চেয়েছেন, আমি নীরব ছিলাম। পরের দিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে আবারও বললেন, খোকা ভাই আমার কথা বলেছেন। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কোথায় আমি তার খোঁজ নেব, উল্টো তিনিই আমার খোঁজ নিচ্ছেন। নিউইয়র্ক সিটিতে তার রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুসারী ও শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা অগণন। এতো চেনা মানুষের মাঝেও আমাকে তার মনে পড়েছে ভেবে আমি অনেকটা বিহ্বল, হতচকিত। অপরাধবোধ ও গ্লানি চেপে ধরে আমাকে। মৃত্যুপথযাত্রী অথবা মারাত্মক ব্যাধিগ্রস্ত চিকিৎসাধীন রোগী দেখতে যাওয়া আমি এড়িয়ে চলি। মরণাপন্ন অতি ঘনিষ্টজনকেও আমি দেখতে যাই না। রোগীর আপনজনেরা এতে কষ্ট পান, ক্ষুব্ধ হন। কিছু ব্যতিক্রম যে ঘটেনি তা নয়।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি থেকে রাতে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই আমার মায়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাই। ভোর হওয়ার অপেক্ষা না করে রাতেই রওয়ানা হই। পাঁচ ঘন্টার দূরত্ব পেরিয়ে ভোর রাতে হাসপাতালে পৌঁছে মায়ের মৃত্যুর আগে কয়েক মিনিট তাকে সাহচর্য দিয়েছি। ২০১০ সালে নিউইয়র্কের এক হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে অসুস্থ গিন্নির শয্যাপাশে সারারাত বসে কাটিয়েছি। তা সত্ত্বেও হাসপাতালের বেডে শায়িত রোগীর দেহজুড়ে তার, নল এবং চিকিৎসাযন্ত্রের মাঝে আটকে থাকা রোগীর প্রাণবায়ু বের হওয়ার অপেক্ষার চেয়ে কঠিনতর সময় আর হতে পারে না। খোকা ভাইয়ের অবস্থা এমনই। শুধুই প্রতীক্ষা। যিশুর অলৌকিকত্ব ছাড়া সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। চিকিৎসাযন্ত্র ও খোকা ভাইয়ের শরীরের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী তার ও নলগুলো খুলে দিলেই তিনি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাবেন। আল্লাহ স্বয়ং এ-কথাই বলেছেন, ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান, আর তোমরা সবাই তারই কাছে ফিরে যাবে।’
হাসপাতালে খোকা ভাইকে ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালে দেখতে যাওয়া আমার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ালো। বুধবার ৩০ অক্টোবর কাজ শেষে ওয়াজেদ ভাইকে বললাম, খোকা ভাইকে দেখতে যাবো। তা না হলে বাকী জীবন আমাকে মানসিক পীড়ন ও অপরাধবোধ নিয়ে কাটাতে হবে। ম্যানহাটানে অবস্থিত মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতাল বিশ্বসেরা ক্যান্সার হাসপাতাল। ২০১২ সালে এই হাসপাতালে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও ইন্তেকাল করেন। আমি আগে কখনো এই হাসপাতালে যাইনি। জ্যাকসন হাইটস থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার ফরহাদ আহমেদ, বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা আলী ইমাম শিকদার এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও কমিউনিটি নেতা কাজী আশরাফ নয়ন। রাত এগারোটা। ৫১১ নম্বর রুম ও লবিতে তখনো হাসপাতালে বিএনপির নেতাকর্মী ও খোকা ভাইয়ের আপনজনদের ভিড়। কয়েকজন বের হয়ে আসার পর আমরা কেবিনে প্রবেশ করলাম। খোকা ভাইয়ের চোখ বন্ধ, নাকে মুখে নলের ওপর মাস্ক পরানো। হাত ও পায়ের যেটুকু বের হয়ে আছে, বুঝা গেল বেশ ফুলে গেছে। তার ফুসফুসে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। দু’দিন আগে একটি ফুসফুসের অংশবিশেষ কেটে ফেলা হয়েছে। যান্ত্রিক উপায় ছাড়া নিঃশ্বাস নেয়ার উপায় নেই। ওয়াজেদ ভাই তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। অষ্ফুট কন্ঠে খোকা ভাই বলছেন, তা আমার কানেও আসছে। তিনি বলছেন, ‘আমি বেইমান হিসেবে মরতে চাই না। আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে। আমার লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।’ হাসপাতালে যাওয়ার আগেও তিনি ওয়াজেদ ভাইকে একান্তে ডেকে এ-কথাটি বলেছেন। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি ওয়াজেদ ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন নিউইয়র্কে আসার পর থেকেই। ওয়াজেদ ভাই দু’একটা কথা বলছেন। মাঝে মাঝে চোখ মুছছেন। আমি খোকা ভাইয়ের কাছে গেলাম। তিনি চোখ খুলেছেন। আমাকে দেখে বোধহয় স্মিত হাসলেন। মাথা নাড়লেন। আমি তার ডান হাত ধরলাম। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, দোয়া করবেন। আমি বললাম, সবসময় দোয়া করছি। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হবে। চিন্তা করবেন না। এ-কথা শুধু নিজেকে আশ্বস্ত করার জন্য। আহা! যদি সত্যিই উনি ফিরে আসেন। তার সাথে সময় কাটাতে পারবো।
এক মাস আগে রাত একটায় তাকে দেখতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি এবং ঢাকায় আমার দুই সহকর্মী সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের ও আহমেদ মূসা। তিনি জেগেই থাকেন। টিভিতে খেলা দেখেন, খবর শোনেন। আমরা গেলে তিনি রাজনীতি, খেলা নিয়ে কথা বলেন। আমরা তার শরীরের অবস্থা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করি না। এর আগেও অনেকবার তার বাসায় গেছি। কখনো দিনে, কখনো গভীর রাতে। খোকা ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্টতা নিউইয়র্কেই। ২০১৪ সালের মে মাসে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে আসার পর নিয়মিতই দেখা হতো তার সাথে। ঢাকায় কালেভদ্রে তার সাথে দেখা হয়েছে। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে, অথবা বিয়ে, দুই ঈদে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মতো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। সালাম বিনিময় ও টুকটাক কথাবার্তা ছাড়া কখনো বৈঠকী আলোচনা হয়নি। সদা হাসিখুশী মানুষ বলে তাকে ভালো লাগতো। নিউইয়র্কে তার অফুরন্ত সময় ছিল। অনেক সময় দু’চার জন সঙ্গীকে নিয়ে রাতের বেলায় তিনি আমাদের অফিসে চলে এসেছেন। আড্ডা দিয়েছি। রেষ্টুরেন্টে বসে খেয়েছি। তবে রেষ্টুরেন্টে বসা তার জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাকে চিনেন। ভিড় করেন। ছবি তুলতে চান। সেদিক থেকে অফিসের আড্ডা ভালো জমতো। চা খেতে খেতে আমরা কথা বলতাম। প্রায়ই তিনি বলতেন ম্যাডামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর কোনোটির ভিত্তি নেই। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিএনপি’র নয়াপল্টনের অফিস হোক, আর জিয়া অরফ্যানেজ হোক। প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু দুর্নীতি অভিযোগ রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত। তিনি বিশ্বাস করতেন, আদালত স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারলে তাকে দন্ড দেয়ার সুযোগ নেই।
২০১৬ সালের একদিন একসাথে গাড়িতে যাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে তার সাথে রসিকতা করার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাকে বললাম, খোকা ভাই, মৃত্যুকে কী খুব ভয় পান? তিনি বললেন, মানুষ তো, মনের ভেতর তো মৃত্যু ঘুরপাক করে। তার ওপর রোগটা খুব খারাপ। সবসময় মানুষের মাঝে ছিলাম। মানুষজন থেকে বিচ্ছিন্নতা বেশি যন্ত্রণা দেয়। আমি বলি, আপনি একটা মুভি দেখবেন, তা হলে মৃত্যু চিন্তা আপনাকে কাতর করবে না। তিনি জানতে চান, কী মুভি? আমি তাকে অমিতাভ বচ্চন ও রাজেশ খান্না অভিনীত ‘আনন্দ’ মুভির কথা বলি। ১৯৭১ সালে নির্মিত এই মুভি আমি প্রথম দেখেছি ১৯৭৪ সালে। মুভিটি দেখার পর থেকে মৃত্যুভয় আমার মাঝে আর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। ঘনিষ্টজনদের মধ্যে যারাই তাদের দুরারোগ্য ব্যাধির কথা বলে দুঃখ করেন, পরিজনের ভবিষ্যৎ ভেবে হাহুতাশ করেন, আমি তাদেরকে ‘আনন্দ’ দেখার পরামর্শ দেই, বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটানোর কথা বলি।
স্কুল জীবন থেকে আমার সহপাঠি ছিল আবদুল ওয়াহাব। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে আমার পরে। ওয়াহাব আড়াই হাজার কলেজের সমাজ কল্যাণের শিক্ষক। তার স্ত্রী বিদ্যুৎ নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। ঢাকার এতো কাছে অবস্থান করা সত্ত্বেও প্রায় দশ বছর আমাদের মাঝে কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। আমি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস)। ২০০৬ সালের মে মাসের এক রাতে ওয়াহাব ওর স্ত্রী এবং আরো তিন-চার জন আমার অফিসে হাজির। কেউ কারো খোঁজ না নেয়ার অভিযোগ অনুযোগ ছিল। একসময় বিদ্যুৎ ভাবী বললেন, আপনার বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ। সরাসরি ক্যান্সার বলেননি তিনি। একিউট লিম্ফোব্লাষ্টিক ধরনের কিছু বলেছেন এবং আমিও ধরে নিয়েছি, ওয়াহাব ক্যান্সারে আক্রান্ত। ওয়াহাব সবসময় রসিকতা করে। কিন্তু তখন নীরবতা পালন করছিল। আমি ওকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য বলি, তোমরা দু’জন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও তখন তোমাদের একটা মুভির কথা বলেছিলাম, মনে আছে। ওয়াহাবের মনে ছিল না, কিন্তু বিদ্যুতের মনে আছে। ওয়াহাবকে বলি, বাসায় গিয়ে মুভি’টি একবার দেখে নিও। সবাইকেই তো মরতে হবে। আনন্দের সাথে বিদায় নেয়াই উত্তম। ওরা চলে যাওয়ার পর ভাবতে থাকি কথাটা কী এভাবে বলা ঠিক হয়েছে? কতোদিন পর দেখা হলো। আর আমি অশুভ কথা বলে বিদায় দিলাম। বাসায় এসে গিন্নিকে বললাম। গিন্নি আমার কথাবার্তার ধরনে সবসময় বিরক্ত। অতএব সে বিরক্তিই প্রকাশ করলো। পরদিন নারায়ণগঞ্জে ওর বাসায় গেলাম। ওয়াহাব বাসায় ছিল না। ঢাকায় ডাক্তারের কাছে গেছে। বিদ্যুৎ ভাবীকে বললাম, মৃত্যু নিয়ে আমার ভাবনা তো আপনি আগে থেকেই জানেন। অসুস্থ কারো কাছে আমার কথা রূঢ় মনে হতে পারে। ওয়াহাবকে বলবেন, যাতে আমার কথায় মন খারাপ না করে। দু’তিনদিন পর খবর পেলাম ওয়াহাবকে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দেখতে গেলাম। দেখে বুঝার উপায় নেই সে মরণাপন্ন। পরদিনই খবর পেলাম, গ্রীন রোডে একটি কিডনি ডায়ালিসিস সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানেও গেলাম। ওর বেডে বসে আগের মতোই হাসিঠাট্টা করলাম। পুরনো বন্ধুদের নিয়ে কথা বললাম। বেশ উৎফুল্ল ছিল সে। পরদিন খবর পেলাম, ওয়াহাব মারা গেছে। আমার অফিসে ওয়াহাবের আসা এবং ওর মারা যাওয়ার মধ্যে খুব বেশি হলে দশ দিনের ব্যবধান। যার সাথে দশ বছর দেখা-সাক্ষাত বা টেলিফোনে পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি, মৃত্যুর দেড় সপ্তাহ আগে হুট করে আমার অফিসে এসে তার অসুস্থতার খবর জানিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমার কাছে খুব ব্যতিক্রম লাগেনি। মৃত্যুর আগে প্রায়-মৃত্যুর অবস্থায় মানুষের স্মৃতি প্রখর হয়ে উঠে। অনেক পুরনো ঘটনা ভিড় করে স্মৃতিতে। ১৯৯৮ সালে আমার ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছিল, যখন আমি প্রায় মৃত্যুর পর্যায়ে উপনীত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউ’তে কাটিয়েছি।
চিকিৎসক যখন কাউকে জানিয়ে দেন যে, ক্যান্সার তার শরীরে বাসা বেঁধেছে এবং তা ষ্টেজ ফোর এ, রোগী ও তার পরিবারের অবস্থা কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমান করা যায়। ষ্টেজ ফোর থেকে রোগীর ফিরে আসা কঠিন। শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ক্যান্সার। হৃষিকেশ মুখার্জির কাহিনীতে নির্মিত ‘আনন্দ’ মুভিতে আনন্দ সায়গল (রাজেশ খান্না) অন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত; ব্যতিক্রমী ধরনের ক্যান্সার ‘লিম্ফোসারকোমা’। সর্বোচ্চ ছ’মাস বেঁচে থাকবেন জানার পরও তিনি আনন্দে, রসিকতায় এবং পরিচিত, অপরিচিত সকলকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন। ডা. ভাস্কর ব্যানার্জি (অমিতাভ বচ্চন) সদ্য পাস করা ক্যান্সার চিকিৎসক। আনন্দের চিকিৎসক ডা. কুলকার্নি তাকে ভাস্করের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তারা দু’জন ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হন। আনন্দের অবস্থার অবনতি ঘটে, তা সত্ত্বেও জীবনে অবশিষ্ট সময় তিনি হাসপাতালের বেডে কাটাতে চান না। বরং তিনি ঘুরে বেড়ান, প্রত্যেককে সাহায্য করেন। তিনি ডা. ভাস্করকে নিজের সম্পর্কে বলেন যে, সবাই যাতে তাকে একজন প্রাণোচ্ছল মানুষ হিসেবে মনে রাখে, ক্যান্সার রোগী হিসেবে নয়। শেষ সময় আসে এবং বন্ধুবান্ধবের মাঝে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পরও প্রত্যেকে তাকে নিজেদের মাঝে দেখতে পায়, অনুভব করে। খোকা ভাই মুভিটি দেখেছিলেন কিনা, তা আর জানতে চাইনি। কিন্তু বয়স ও ব্যাধির চাপ ছাড়া তাকে বিমর্ষ দেখিনি।
প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার সনাক্ত করার পর চিকিৎসা ও ক্যান্সারাক্রান্ত অংশ বা টিউমার কেটে ফেলার কয়েক বছর বা অনেক রোগীর ক্ষেত্রে আরো দীর্ঘ সময় পর ষ্টেজ ফোর সনাক্ত হতে পারে। খোকা ভাই দীর্ঘদিন ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন। পাঁচ বছর আগে নিউইয়র্কে আসার আগে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেন। সেখানে তার একটি কিডনি অপসারণ করা হয়। এরপর নিউইয়র্কে বিরামহীনভাবে চিকিৎসা চলছিল। ঢাকা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা নিউইয়র্কে এলে তারা খোকা ভাইয়ের সাথে অবশ্যই সাক্ষাত করতেন। নিউইয়র্কে যারা দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করেন, তারা দাওয়াত করেন। খোকা ভাইও সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কোনো কোনোটিতে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছি। এসব দাওয়াতে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আলমগীর কবির, এমরান সালেহ প্রিন্স, ডা. রফিক চৌধুরী, দিনাজ খান, বেবী নাজনীন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা ছাড়াও বিশিষ্টজনদের সাথে সাক্ষাত হতো। খোকা ভাইয়ের পাশেই বসার চেষ্টা করতাম। টুকটাক কথা বলতাম। তিনি মৃদুভাষী। আমি অবাক হতাম, কী করে তিনি এক কোটির অধিক জনসংখ্যার একটি নগরীকে পরিচালনা করেছেন? ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার পক্ষে কী করে শেখ হাসিনার মতো একজন নেত্রীকে ৩৯ হাজারের অধিক ভোটে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল? কতোটা জনপ্রিয় হলে সাদেক হোসেন খোকার পক্ষে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের তার ঢাকার আসন দখলে রাখা সম্ভব হয়েছিল, যখন ঢাকায় বিএনপির আর কোনো প্রার্থী জয়লাভ করেননি। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা নগরীর হিন্দু প্রধান এলাকায় দাঙ্গাহাঙ্গামার যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল তা ঠেকানোর ক্ষেত্রে সাদেক হোসেন খোকার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে শেষ পর্যন্ত ঢাকার হিন্দুরা তাকে সমর্থন করেছেন এবং তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করার পেছনে নগরীর উন্নয়ন ও সুষ্ঠুভাবে নগরীকে পরিচালনা করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সাদেক হোসেন খোকার জনপ্রিয়তা। সুষ্ঠূ কোনো নির্বাচনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাদেক হোসেন খোকার জনপ্রিয়তাই ঢাকার মেয়র হিসেবে বিএনপির প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য যথেষ্ট বলে আওয়ামী মহলে সংশয় ছিল।
খোকা ভাইকে হাসপাতালে দেখে আসার পরদিন বৃহস্পতিবার তিনি কথা বলতে পেরেছেন। শুক্রবার থেকে তার কথা বন্ধ হয়ে যায়, চেতনা বিলুপ্ত হয়। এ অবস্থায় তিনদিন কাটানোর পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। একজন ভালো মানুষের মৃত্যু হলে পৃথিবীতে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। খোকা ভাইয়ের অবর্তমানে দীর্ঘদিন সেই শূন্যতা বিরাজ করবে। তার ভক্ত-অনুরক্তদের মাঝে তিনি টিকে থাকবেন। তার ভালো কাজগুলোও টিকে থাকবে।তিনি জীবনভর মানুষের যে সেবা করেছেন, আল্লাহ তাকে এর প্রতিদান দেবেন, আমিও দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করি।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক